‘ইচ্ছাকৃত ঋণ খেলাপি’ চিহ্নিত করতে রাজনৈতিক সদিচ্ছা লাগবে, বিশেষজ্ঞদের অভিমত

ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণের লাগাম টানতে ইচ্ছাকৃত খেলাপিদের চিহ্নিত করতে বাংলাদেশ ব্যাংক যে নীতিমালা করেছে সেটির বাস্তবায়নে রাজনৈতিক সদিচ্ছা লাগবে। অন্যথায় এ উদ্যোগের খুব বেশি সুফল মিলবে না বলেই মত আর্থিক খাতের বিশেষজ্ঞদের। পাশাপাশি ব্যাংক খাতে সুশাসন নিশ্চিত করারও তাগিদ দিয়েছেন তাঁরা। 

গত মঙ্গলবার বাংলাদেশ ব্যাংক ইচ্ছাকৃত খেলাপি চিহ্নিত করতে নতুন নীতিমালা জারি করেছে। সেখানে বলা হয়েছে, ঋণ পরিশোধের সামর্থ্য থাকার পরও যাঁরা পরিশোধ করবেন না, তারা ইচ্ছাকৃত খেলাপি হিসেবে চিহ্নিত হবেন। এ ছাড়া মিথ্যা তথ্য দিয়ে ঋণ নিলে বা ঋণের অর্থ যাঁরা অপব্যবহার করবেন, তাঁরাও ইচ্ছাকৃত খেলাপি হবেন। এ ধরনের খেলাপি চিহ্নিত করতে আগামী ৯ এপ্রিলের মধ্যে দেশের সব ব্যাংককে আলাদা ইউনিট গঠনের নির্দেশ দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। 

ব্যাংক খাতের সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপির বিষয়টি ভারত ও পাকিস্তান ছাড়া বিশ্বের আর কোনো দেশের আইনে নেই। ভারত ও পাকিস্তানের পর এখন বাংলাদেশেও একই উদ্যোগ নেওয়া হলো। 

সালেহউদ্দিন আহমেদ
ছবি : প্রথম আলো

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ঋণ দেওয়ার পর তা ইচ্ছাকৃত খেলাপি হলো, নাকি অনিচ্ছাকৃত সেটি গুরুত্বপূর্ণ নয়। যাঁরা ঋণ নিয়ে ফেরত দেবে না, তাঁরা সবাই ঋণখেলাপি। তাই ঋণ দেওয়ার পর কারা ইচ্ছাকৃত খেলাপি আর কারা অনিচ্ছাকৃত খেলাপি, সেটি না খুঁজে ব্যাংকগুলোর উচিত ভালোভাবে যাচাই-বাছাই করে ঋণ দেওয়া। তা না হলে যেখানে পাঁচ কোটি টাকা ঋণ দরকার, সেখানে হয়তো ১০ কোটি টাকা দেওয়া হবে। তাতে পাঁচ কোটি টাকা লোপাট হয়ে যাবে। 

উন্নত দেশের মতো আমাদের দেশেও ঋণখেলাপিদের শাস্তির আওতায় আনতে হবে। তা না করে যদি এসব মানুষকে নানাভাবে পুরস্কৃত করা হয়, তাহলে ঋণ খেলাপের সংস্কৃতি আরও বাড়বে।
সালেহউদ্দিন আহমেদ, সাবেক গভর্নর, বাংলাদেশ ব্যাংক

এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ইচ্ছাকৃত খেলাপি ঋণ চিহ্নিত করার এই উদ্যোগ মূল বিষয় নয়। মূল বিষয় আমলে নেওয়া হয় না বলেই এ ধরনের উদ্যোগ নিতে হচ্ছে। ব্যাংকগুলোকে ইচ্ছাকৃত খেলাপি ঋণগ্রহীতা চিহ্নিত করতে আলাদা ‘ইউনিট’ গঠনের কথা বলা হয়েছে। কিন্তু ব্যাংকে এ রকম অনেক কমিটি আছে, যেমন মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ কমিটি। কিন্তু এসব কমিটি কিছু করতে পারে না। 

ব্যাংক খাতে সুশাসন নেই বলেই ঋণ নিয়ে তা ফেরত না দেওয়া নতুন ধরনের ব্যবসায়িক মডেল হয়ে দাঁড়িয়েছে বলে মনে করেন সালেহউদ্দিন আহমেদ। তিনি বলেন, ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিদের খুঁজে বের করা হলে এ ধরনের গ্রাহকেরা কিছুটা মনস্তাত্ত্বিক চাপে থাকবেন। 

খাতসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, বিশ্বের বেশির ভাগ দেশে এ ধরনের কোনো বিধান নেই। কিন্তু বেশির ভাগ দেশে খেলাপি ঋণ–সংক্রান্ত আইনকানুন খুবই কঠোর। খেলাপি হলে আদালতে যেতে হয়, সেখানে মামলাও ঝুলে থাকে না। আদালতের রায়ে কেউ একবার খেলাপি হলে তার স্বাভাবিক জীবনযাপন কঠিন হয়ে যায়। নানা ধরনের বিধিনিষেধের মধ্যে পড়তে হয়। তাই যাঁরা খেলাপি হন, তাঁরা দ্বিতীয়বার ঋণ নিতে পারেন না। 

 সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, উন্নত দেশের মতো আমাদের দেশেও ঋণখেলাপিদের শাস্তির আওতায় আনতে হবে। তা না করে যদি এসব মানুষকে নানাভাবে পুরস্কৃত করা হয়, তাহলে ঋণ খেলাপের সংস্কৃতি আরও বাড়বে। 

ভারতে অনেক আগে ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিদের চিহ্নিত করতে নীতিমালা করা হলেও বিশেষ কোনো ফল পাওয়া যায়নি। বরং ‘ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপির’ মধ্যে কেউ কেউ, যেমন বিজয় মালিয়া ও মেহুল চোক্ষীদের মতো রাঘববোয়ালেরা ব্যাংকের ঋণ পরিশোধ না করে বিদেশে পালিয়ে গেছেন। আবার অনেকে দেশে থেকেও ঋণ পরিশোধ করেননি। পরে সে দেশের রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক তাঁদের বিশাল অঙ্কের ঋণ মওকুফ করে দিয়েছে, যা নিয়ে ভারতে তুমুল সমালোচনাও হয়েছে। 

এ ছাড়া গত বছর ভারতে ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিদের ব্যাংকের সঙ্গে সমঝোতা করার বিধান যুক্ত করে নতুন নীতিমালা করা হয়েছে।

এই সমঝোতার এক বছর পর ইচ্ছাকৃত খেলাপিরা নতুন করে ঋণও নিতে পারবেন বলে নিয়ম করা হয়েছে। 

ভারতের এ অভিজ্ঞতার কারণে তাই দেশের বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, নতুন নতুন বিধান বা নীতিমালা করে নয়, খেলাপি ঋণের রাশ টানতে হলে দরকার রাজনৈতিক সদিচ্ছা। 

বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের করা ইচ্ছাকৃত খেলাপিসংক্রান্ত নীতিমালা বাস্তবায়ন করতে গেলে অনেক ক্ষমতাবান মানুষেরা এর আওতায় আসবে। সে জন্য সরকারের রাজনৈতিক সদিচ্ছা ছাড়া এ নীতিমালা বাস্তবায়িত হবে না। বাংলাদেশ ব্যাংক ইচ্ছাকৃত খেলাপিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারলে ধরে নিতে হবে, তারা ‘সিগন্যাল’ পেয়েছে। বাংলাদেশে এখন এই ‘সিগন্যাল’ ছাড়া কিছু হয় না। এ ছাড়া ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণ কমাতে দরকার ব্যাংক খাতের সুশাসন। 

আহসান এইচ মনসুর বলেন, ঋণ দেওয়ার সময়ই যাচাই-বাছাই করতে হবে, খেলাপি হওয়ার উদ্দেশে তা নেওয়া হচ্ছে কি না। যেসব ঋণ খেলাপি হয়, তার বেশির ভাগই সেই উদ্দেশ্যে নেওয়া হয়। ব্যাংকের মালিকেরাই যদি অর্থ লোপাট করে দিতে চান, তাহলে তাদের ঠেকানো মুশকিল। সে জন্য পরিচালনা পর্ষদ নিয়োগ দেওয়ার ক্ষেত্রেও সততা ও দক্ষতার বিষয়টি বিবেচনা করতে হবে। শুধু রাজনৈতিক উদ্দেশে ব্যাংক দেওয়া হলে এই পরিস্থিতি সৃষ্টি হবে। 

এ ছাড়া খেলাপি ঋণ কমাতে আইনি প্রক্রিয়া স্বচ্ছ ও দ্রুততর করার কথা বলেন বিশেষজ্ঞরা। তাঁদের মতে, বাংলাদেশে অনিয়ম এত বেশি যে ইচ্ছাকৃত খেলাপি চিহ্নিত করতে আলাদা উদ্যোগ নিতে হয়। নিয়মকানুনের যথাযথ প্রয়োগ থাকলে এ ধরনের কিছুই করতে হতো না।