ব্যাংকঋণের ১৪ শতাংশ টেকসই খাতে

চলতি বছরের মার্চে টেকসই প্রকল্পে অর্থায়ন বেড়ে হয়েছে ৩৬ হাজার ৬৯৪ কোটি টাকা, যা বিতরণ করা ঋণের ১৩ দশমিক ৭৭ শতাংশ।

জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতিকর প্রভাব পড়ছে সারা বিশ্বে। কার্বন নিঃসরণ কমাতে পরিবেশবান্ধব প্রকল্পে ঝুঁকছে বিভিন্ন দেশ। বাংলাদেশও এ ক্ষেত্রে পিছিয়ে নেই। বাংলাদেশের তৈরি পোশাক ও বস্ত্র খাতে এখন আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত পরিবেশবান্ধব কারখানা ২০০টির বেশি।

বাংলাদেশ ব্যাংক পরিবেশবান্ধব প্রকল্প ও টেকসই অর্থায়নে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে উৎসাহিত করছে। ফলে এসব খাতে অর্থায়নও বাড়ছে। এখন দেশের ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ঋণের প্রায় ১৪ শতাংশই টেকসই খাতে।

টেকসই অর্থায়নের পাশাপাশি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোও পরিবেশবান্ধব কার্যক্রম শুরু করেছে। তারই অংশ হিসেবে অনেক ব্যাংক শাখা ও এটিএমে সৌরবিদ্যুৎ ব্যবহার করা হচ্ছে। বিদ্যুতের ব্যবহার কমিয়ে প্রাকৃতিক আলোর ব্যবহার বাড়ানো হচ্ছে। কাগজের ব্যবহার কমিয়ে আনছে কোনো কোনো ব্যাংক। আবার টেকসই অর্থায়নের আওতায় এমন প্রকল্প যুক্ত হচ্ছে, যেখানে সৌরবিদ্যুৎ ব্যবহৃত হচ্ছে।

এসব উদ্যোগের ফলে পরিবেশ কতটা সুরক্ষিত হচ্ছে, তার কোনো হিসাব যদিও নেই; তবে অর্থায়নের নীতি ও কৌশলের মাধ্যমে পরিবেশের সুরক্ষা দেওয়া সম্ভব বলে মনে করেন বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্টের (বিআইবিএম) অনুষদ সদস্য খোন্দকার মোরশেদ মিল্লাত। তিনি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের টেকসই অর্থায়ন বিভাগের সাবেক পরিচালক। খোন্দকার মোরশেদ মিল্লাত প্রথম আলোকে বলেন, সারা বিশ্বে পরিবেশের সুরক্ষা এখন অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।

এ জন্য দেশের ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে টেকসই অর্থায়নের লক্ষ্য বেঁধে দেওয়া হয়েছে। তবে এখন সময় এসেছে নবায়নযোগ্য জ্বালানি, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, পরিবেশবান্ধব স্থাপনা খাতে ঋণের লক্ষ্য বেঁধে দেওয়ার। পাশাপাশি পরিবেশবান্ধব ইটকারখানাতেও ঋণ দিতে বিশেষ উদ্যোগ নিতে হবে। এতে সরাসরি পরিবেশের ক্ষতি ঠেকানো যাবে। বসবাসের উপযোগী হবে এই ধরণি।

টেকসই রেটিংয়ে এবার কারা

টেকসই অর্থায়নে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে উৎসাহিত করতে তিন বছর বছর ধরে দেশের ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর (এনবিএফআই) টেকসই বা সাসটেইনেবল রেটিং বা মান প্রকাশ করছে বাংলাদেশ ব্যাংক।

টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট অর্জনের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক এই উদ্যোগ নিয়েছে। মূলত পাঁচটি সূচকের ওপর ভিত্তি করে এই মান যাচাই করা হয়। সূচকগুলো হলো টেকসই অর্থায়ন সূচক, সামাজিক দায়বদ্ধতা কার্যক্রম, পরিবেশবান্ধব প্রকল্পে অর্থায়ন, টেকসই কোর ব্যাংকিং সূচক ও ব্যাংকিং সেবার পরিধি।

২০২২ সালের তথ্যের ভিত্তিতে এবার বেসরকারি খাতের সাতটি ব্যাংক ও চারটি আর্থিক প্রতিষ্ঠানকে টেকসই রেটিংয়ে অন্তর্ভুক্ত করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাসটেইনেবল ফাইন্যান্স বিভাগ যে টেকসই ব্যাংকের নাম প্রকাশ করেছে, সেখানে ক্রমতালিকা সাজানো হয়েছে আদ্যক্ষরের ভিত্তিতে। ফলে মানের দিক থেকে কোন ব্যাংক এগিয়ে আছে, তা জানা যায়নি।

টেকসই রেটিংয়ে অন্তর্ভুক্ত ব্যাংকের তালিকায় রয়েছে ব্র্যাক ব্যাংক, যমুনা ব্যাংক, প্রাইম ব্যাংক, শাহ্জালাল ইসলামী ব্যাংক, দি সিটি ব্যাংক, ট্রাস্ট ব্যাংক ও ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংক। চারটি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মধ্যে রয়েছে অগ্রণী এসএমই ফাইন্যান্সিং কোম্পানি, বাংলাদেশ ফাইন্যান্স, আইডিএলসি ফাইন্যান্স ও লংকান অ্যালায়েন্স ফাইন্যান্স লিমিটেড।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাসটেইনেবল ফাইন্যান্স বিভাগ ২০২০ সালের ডিসেম্বরে প্রথম ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর (এনবিএফআই) টেকসই রেটিং প্রকাশের ঘোষণা দেয়। ২০২১ সালে প্রথমবারের মতো রেটিংয়ে থাকা শীর্ষ ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর তালিকা প্রকাশ করে।

বাড়ছে টেকসই ঋণ

বাংলাদেশ ব্যাংক মোট মেয়াদি ঋণের ৫ শতাংশ পরিবেশবান্ধব খাতে বিতরণের জন্য ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে নির্দেশ দিয়েছে। আর মোট ঋণের ২০ শতাংশ টেকসই প্রকল্পে দেওয়ার জন্য বলেছে। টেকসই প্রকল্পের মধ্যে রয়েছে কৃষি, সিএমএসএমই, পরিবেশবান্ধব কারখানা, সামাজিকভাবে দায়িত্বশীল প্রকল্পে অর্থায়ন। টেকসই অর্থায়নের মধ্যে রয়েছে পরিবেশবান্ধব খাতের অর্থায়ন।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২২ সালের মার্চ পর্যন্ত দেশের ব্যাংকগুলো টেকসই প্রকল্পে অর্থায়ন করে ২৫ হাজার ২৯০ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ৯ দশমিক ৮৫ শতাংশ।

ওই সময়ে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো অর্থায়ন করে ৮৫৯ কোটি টাকা, যা তাদের মোট ঋণের ১৪ দশমিক ৭৬ শতাংশ। সব মিলিয়ে ২০২২ সালের মার্চ পর্যন্ত টেকসই প্রকল্পে অর্থায়ন করে ২৬ হাজার ১৪৯ কোটি টাকা, যা মোট বিতরণ করা ঋণের ৯ দশমিক ৯৪ শতাংশ।

চলতি বছরের মার্চে টেকসই প্রকল্পে অর্থায়ন বেড়ে হয়েছে ৩৬ হাজার ৬৯৪ কোটি টাকা, যা বিতরণ করা ঋণের ১৩ দশমিক ৭৭ শতাংশ। এর মধ্যে ৩ হাজার ৬১৫ কোটি টাকা ঋণ পরিবেশবান্ধব খাতে, যা মোট মেয়াদি ঋণের ৫ দশমিক শূন্য ৮ শতাংশ।

ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক হুমায়রা আজম প্রথম আলোকে বলেন, ‘কখনো খেলাপি হয়নি, পরিবেশ দূষণ করেনি—এমন গ্রাহকদেরই আমরা টেকসই অর্থায়ন করছি। এসব কারখানাগুলো পরিবেশবান্ধব ও সৌরবিদ্যুৎ ব্যবহার করে। জাহাজভাঙা কারখানাও পরিবেশবান্ধব হয়ে যাচ্ছে। এতে টেকসই অর্থায়ন বাড়ছে। এসব ঋণ আদায়ের হারও ভালো।’