ঋণখেলাপি, গ্রেপ্তারি পরোয়ানা, তবু পদোন্নতি পেয়ে সচিব

জামানত ছাড়া শুধু মৌখিক আশ্বাসে ২০১০ সালে ঋণ নিয়ে সদ্য সচিব হওয়া খাইরুল ইসলাম বেসিক ব্যাংকের কাছে এখন ৯ কোটি টাকার দেনাদার।

খাইরুল ইসলাম

মো. খাইরুল ইসলাম বেসিক ব্যাংকের একজন ঋণখেলাপি। ব্যাংকের টাকা পরিশোধ না করলেও সরকারি চাকরিতে তাঁর একের পর এক পদোন্নতি হয়েছে। ব্যাংক থেকে ঋণ নেওয়ার সময় ২০১০ সালে ছিলেন উপসচিব। এরপর পদোন্নতি পেয়ে যুগ্ম সচিব, অতিরিক্ত সচিব এবং সর্বশেষ ২ জুলাই সচিব হয়েছেন। এখন তিনি জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওএসডি)। কিন্তু এত পদোন্নতি হলেও ব্যাংকের টাকা আর পরিশোধ করেননি তিনি। ৪ কোটি টাকা ঋণ নিয়ে কিছু ফেরত দিলেও জমতে জমতে সুদাসলে তাঁর দেনা এখন ৯ কোটি টাকা। ঋণও নিয়েছিলেন প্রভাব খাটিয়ে, বেআইনিভাবে এবং সরকারের অনুমতি ছাড়া।

বেসিক ব্যাংক পাওনা আদায়ে খাইরুল ইসলামের বিরুদ্ধে ঢাকা জেলা ও দায়রা জজ আদালতে গত বছরের ১৩ নভেম্বর মামলা করেছে। মামলা নম্বর ১৪০২। এরপর তাঁর নামে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হয়। গত এপ্রিলে তিনি আদালত থেকে জামিন নিয়েছেন। অর্থঋণ আদালতে তাঁর নামে আরেকটি মামলা করার প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে। এ মামলা করার অংশ হিসেবে খাইরুল ইসলামকে কয়েক দফা নোটিশ দিলেও বেসিক ব্যাংককে তিনি কোনো জবাব দেননি। অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ, বাণিজ্যিক অডিট অধিদপ্তর, বেসিক ব্যাংকের প্রধান কার্যালয় এবং শাখা কার্যালয় সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।

সরকারি চাকরিতে সামান্য অজুহাতেও কারও কারও পদোন্নতি আটকে যাচ্ছে, আবার বড় অপরাধেও অনেকের কিছুই হচ্ছে না। বেসিক ব্যাংকের এ ঘটনায় যা হয়েছে বুঝলাম, খাইরুল ইসলাম ছাড়া অন্য কেউ হলে এত দিনে পদোন্নতি তো দূরের কথা, গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে থাকতেন
বাংলাদেশ লোকপ্রশাসন প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের (বিএপিটিসি) সাবেক রেক্টর এ কে এম আবদুল আউয়াল মজুমদার
বেসিক ব্যাংক

বেসিক ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মো. আনিসুর রহমান গত বৃহস্পতিবার প্রথম আলোকে বলেন, ‘জনাব মো. খাইরুল ইসলাম ব্যাংকে এসেছিলেন। তাঁর কাছ থেকে পাওনা আদায়ে আমরা প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিয়েছি এবং নিচ্ছি।’ এর বাইরে কিছু বলতে চাননি তিনি।

বেসিক ব্যাংক কেলেঙ্কারির প্রধান হোতা ব্যাংকটির সাবেক চেয়ারম্যান আবদুল হাই ওরফে বাচ্চু। দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) সম্প্রতি শেখ আবদুল হাইয়ের নামে ৫৬টি মামলার অভিযোগপত্র দিয়েছে। খাইরুল ইসলামের এ বেআইনি ঋণ পাওয়ার ক্ষেত্রে শেখ আবদুল হাইয়ের প্রত্যক্ষ মদদ রয়েছে বলে বাণিজ্যিক অডিট অধিদপ্তরের প্রতিবেদনে উঠে এসেছে।

বেসিক ব্যাংক বলছে, প্রথমে ২ কোটি টাকা করে মোট ৪ কোটি টাকার ঋণ প্রস্তাব পাস হয় খাইরুল ইসলামের নাবালক ছেলে ও মেয়ের নামে। অথচ ব্যাংকের ঋণ কমিটির নীতিমালা অনুযায়ী, জামানত ছাড়া কোনো ঋণ দেওয়া যায় না। ব্যাংকের আইনজীবীও তখন মতামত দেন যে নাবালক ছেলে ও নাবালিকা মেয়ের সঙ্গে ব্যাংক বন্ধকি দলিল করতে পারবে না। ফলে আটকে যায় ঋণ বিতরণ।

শেখ আবদুল হাই ২০০৯ সালের সেপ্টেম্বরে বেসিক ব্যাংকের চেয়ারম্যান হন। খাইরুল ইসলামের ঋণ প্রস্তাব এর ১১ মাস পরের ঘটনা। বেসিক ব্যাংকের প্রধান কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, ব্যাংকের কারওয়ান বাজার শাখায় ৪ কোটি টাকা নাবালক দুই সন্তানের নামে ঋণ চেয়ে আবেদন করেছিলেন প্রধানমন্ত্রীর তৎকালীন এপিএস খাইরুল ইসলাম ওরফে মান্নান। ২০১০ সালের ১৯ আগস্ট অনুষ্ঠিত ব্যাংকের ২৭৬তম পর্ষদ সভায় জামানত ছাড়া খাইরুল ইসলামের ব্যক্তিগত নিশ্চয়তা দিয়ে করা গৃহনির্মাণ ঋণ প্রস্তাব মঞ্জুর হয়ে যায়।

বেসিক ব্যাংক বলছে, প্রথমে ২ কোটি টাকা করে মোট ৪ কোটি টাকার ঋণ প্রস্তাব পাস হয় খাইরুল ইসলামের নাবালক ছেলে ও মেয়ের নামে। অথচ ব্যাংকের ঋণ কমিটির নীতিমালা অনুযায়ী, জামানত ছাড়া কোনো ঋণ দেওয়া যায় না। ব্যাংকের আইনজীবীও তখন মতামত দেন যে নাবালক ছেলে ও নাবালিকা মেয়ের সঙ্গে ব্যাংক বন্ধকি দলিল করতে পারবে না। ফলে আটকে যায় ঋণ বিতরণ।

আরও পড়ুন

এর সাড়ে তিন মাস পর একই বছরের ১১ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত ব্যাংকের ২৮১তম পর্ষদ সভায় তোলা হয় নতুন প্রস্তাব। সেদিনই ছেলেমেয়ের নামের জামানতবিহীন গৃহনির্মাণ ঋণ প্রস্তাব স্থানান্তরিত হয়ে যায় খাইরুল ইসলামের নামে। ঋণ প্রস্তাবের নতুন নাম দেওয়া হয় যেকোনো কাজে ব্যবহারের জন্য ঋণ বা এনি পারপাস লোন। বেসিক ব্যাংকে এ ধরনের কোনো ঋণ পণ্য তখনো ছিল না, এখনো নেই।

পদোন্নতি পেলেও খাইরুল ইসলাম অবসরোত্তর ছুটিতে (পিআরএল) যাবেন ১৫ জুলাই। স্থানীয় সরকার বিভাগে অতিরিক্ত সচিব হিসেবে বরাদ্দ কক্ষে তাঁর সঙ্গে বৃহস্পতিবার প্রথম আলোর কথা হয়। বেসিক ব্যাংক থেকে নেওয়া ঋণের টাকা ফেরত দিচ্ছেন না কেন—এমন প্রশ্নের জবাবে খাইরুল ইসলাম নানা ধরনের কথাবার্তা বলেন। শুরুতেই বলেন, তিনি ঋণ নেননি, তবে জামিনদার হয়েছেন। কার ঋণের জামিনদারের হয়েছেন—এমন প্রশ্নের জবাবে বলেন, পরিবারের সদস্যদের। তিনি এ সময় আরও বলেন, কসবা হাউজিং নামক আবাসন কোম্পানি থেকে ফ্ল্যাট কেনার কথা থাকলেও পরে আর কেনা হয়নি। বেশ কিছু টাকা শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করে ক্ষতির শিকার হয়েছেন তিনি। মামলার আসামি হিসেবে জামিন নেওয়ার কথা অবশ্য অস্বীকার করেন তিনি।

আরও পড়ুন

কে এই খাইরুল ইসলাম

বিসিএস নিরীক্ষা ও হিসাব ক্যাডারের কর্মকর্তা খাইরুল ইসলাম ১৯৯৫ সালে সহকারী মহাহিসাবরক্ষক হিসেবে সরকারি চাকরিতে যোগ দেন। আওয়ামী লীগ সরকারের প্রথম মেয়াদে খাইরুল ইসলাম প্রধানমন্ত্রীর এপিএস পদে নিয়োগ পেলেও বেশি দিন কাজ করতে পারেননি। ২০১২ সালের ১৫ জুলাই প্রধানমন্ত্রীর এপিএস পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয় তাঁকে। এরপর থেকে তিনি ধাপে ধাপে পদোন্নতি পেয়ে এসেছেন। সর্বশেষ সরকার খাইরুল ইসলামকে পদোন্নতি দিয়ে সচিব করে ২ জুলাই জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওএসডি) করেছে।

খাইরুল ইসলামের মতো একজন ঋণখেলাপিকে কীভাবে পদোন্নতি দেওয়া হলো-এমন প্রশ্নের জবাবে জনপ্রশাসনসচিব মোহাম্মদ মেজবাহ্ উদ্দিন চৌধুরী গতকাল মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, ‘চাকরিকালীন অতীত অভিজ্ঞতা ও যোগ্যতার ভিত্তিতে পদোন্নতি দেওয়া হয়। তাঁর ক্ষেত্রেও সেটাই হয়েছে। আর ব্যাংকের কোনো তথ্য আমাদের কাছে থাকে না।’

বাংলাদেশ সচিবালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারী পরিষদের নেতা হিসেবে পরিচিতি রয়েছে খাইরুল ইসলামের। সচিব পদে পদোন্নতি পাওয়ায় বাংলাদেশ সরকারি কর্মচারী জাতীয় পরিষদ গত সোমবার তাঁকে ফুলেল শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন জানায়।

বাংলাদেশ লোকপ্রশাসন প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের (বিএপিটিসি) সাবেক রেক্টর এ কে এম আবদুল আউয়াল মজুমদার বিষয়টি নিয়ে প্রথম আলোকে বলেন, ‘সরকারি চাকরিতে সামান্য অজুহাতেও কারও কারও পদোন্নতি আটকে যাচ্ছে, আবার বড় অপরাধেও অনেকের কিছুই হচ্ছে না। বেসিক ব্যাংকের এ ঘটনায় যা হয়েছে বুঝলাম, খাইরুল ইসলাম ছাড়া অন্য কেউ হলে এত দিনে পদোন্নতি তো দূরের কথা, গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে থাকতেন।’

অথচ বেসিক ব্যাংক কেলেঙ্কারিতে কিছু ব্যবসায়ী ও ব্যাংকার জেল খেটেছেন। যেমন ফারসি ইন্টারন্যাশনালের এমডি ফয়জুন নবী চৌধুরী, এশিয়ান শিপিং বিডির স্বত্বাধিকারী মো. আকবর হোসেন, এমারেল ড্রেসের সৈয়দ হাসিবুল গণি, ভাসাভি ফ্যাশনের ইয়াসির আহমেদ খান, তাহমিনা ডেনিম ও তাহমিনা নিটওয়্যারের এমডি কামাল জামাল মোল্লা প্রমুখ। তাঁরা সবাই পরে হাইকোর্ট থেকে জামিন পান। এর বাইরে কয়েকজন ব্যাংকারকেও গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। যেমন বেসিক ব্যাংকের দুই উপব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. ফজলুস সোবহান ও মো. সেলিম, গুলশান শাখার প্রধান শিপার আহমেদ, মহাব্যবস্থাপক জয়নাল আবেদীন এবং সহকারী ব্যবস্থাপক ইকরামুল বারী। দুই বছর হাজতে থাকার পর তাঁরা জামিন পান।