টাকা ছাপিয়ে সরকার ও ব্যাংককে মূলধন না দেওয়ার পরামর্শ

ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ
ফাইল ছবি

দেশের চলমান অর্থনীতির সংকট সমাধানে অর্থনীতিবিদ ও আর্থিক খাতের বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ নিতে শুরু করেছে সরকার। সরকারের উচ্চপর্যায় থেকে বর্তমান পরিস্থিতিতে করণীয় বিষয়ে পরামর্শ গ্রহণের নির্দেশ দেওয়া হয়। এরপরই বাংলাদেশ ব্যাংক এ ব্যাপারে উদ্যোগ নেয়। গতকাল বৃহস্পতিবার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের শীর্ষ কর্মকর্তারা প্রথম বৈঠকটি করেছেন অর্থনীতিবিদ ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদের সঙ্গে।

চলমান অর্থনৈতিক সংকটের মধ্যে এমন আলোচনার উদ্যোগ এটাই প্রথম। আগামী সপ্তাহে গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) ভাইস চেয়ারম্যান সাদিক আহমেদ ও নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুরের সঙ্গে আলোচনার সূচি রয়েছে। এর পর সাবেক গভর্নর আতিউর রহমান, সাবেক অর্থসচিব মোহাম্মদ তারেকের সঙ্গে আলোচনার কথা রয়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, ধারাবাহিকভাবে গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি), সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিং বা সানেম ও অর্থনৈতিক বিষয়সংক্রান্ত সাংবাদিকদের সংগঠনের সঙ্গে বৈঠকের কথা রয়েছে।

দীর্ঘদিন ধরে অর্থনীতিতে নানামুখী সংকট চললেও বাংলাদেশ ব্যাংক কিংবা অর্থ মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের পক্ষ থেকে বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে এ ধরনের আনুষ্ঠানিক আলোচনার কোনো উদ্যোগ দেখা যায়নি।

দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে করণীয় নির্ধারণে পরামর্শের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকে গতকাল দুপুরে অনুষ্ঠিত এ বৈঠকটি চলে প্রায় তিন ঘণ্টাব্যাপী। বৈঠকে গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার, অর্থসচিব মো. খায়েরুজ্জামান মজুমদার,  আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব শেখ মোহাম্মদ সলীম উল্লাহসহ কেন্দ্রীয় ব্যাংকের শীর্ষ কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।

বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে অর্থনীতির নানা সূচক, নীতি উদ্যোগ ও তার প্রভাব নিয়ে একটি উপস্থাপনা দেন প্রধান অর্থনীতিবিদ হাবিবুর রহমান। সেখানে সংকট কাটাতে সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংক যেসব উদ্যোগ নিয়েছে, তা তুলে ধরা হয়।

আলোচনায় সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ অর্থনীতির বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে নিজের মূল্যায়ন সরকারের কর্মকর্তাদের জানান। বৈঠক শেষে যোগাযোগ করা হলে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির এই সময়ে পণ্যের দাম বেঁধে দিয়ে বাজারে লাগাম টানার আগে ‘মূল্য প্রত্যাশা’র লাগাম টানার পরামর্শ দিয়েছি। পাশাপাশি প্রবৃদ্ধির চেয়ে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেওয়ার কথাও বলেছি।’ এ ক্ষেত্রে দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগ কিছুটা বাধাগ্রস্ত হলেও তাতে দুশ্চিন্তার কিছু নেই বলে জানান এ অর্থনীতিবিদ।

মূল্য প্রত্যাশা নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে বাজার নিয়ন্ত্রণব্যবস্থার বিষয়ে ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বলেন, ‘পণ্যের দাম বাড়বে—এমন প্রত্যাশা যখন স্থায়ী হয়, তখন স্বয়ংক্রিয়ভাবে পণ্যমূল্য বাড়তে থাকে। এমন পরিস্থিতিতে পণ্যের দাম বেঁধে তা নিয়ন্ত্রণ করা যায় না। বরং মূল্য প্রত্যাশা কমাতে সমন্বিত ও বিশ্বাসযোগ্য নীতি গ্রহণ এবং তার মাধ্যমে বাজারে সংকেত দিতে হয়। এ ছাড়া দৃশ্যত যেখানে একচেটিয়া ব্যবসা গড়ে ওঠে, সেখানে তদারকি বা নিয়ন্ত্রণ বাড়ানোর কথা বলেছি।’

কেন্দ্রীয় ব্যাংক সূত্র জানায়, ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নেওয়া বিভিন্ন নীতি উদ্যোগের প্রতি সমর্থন জানান। তবে এই মুহূর্তে টাকা ছাপিয়ে সরকার ও রাষ্ট্রমালিকানাধীন ব্যাংককে কোনো ধরনের মূলধন জোগান না দেওয়ার পরামর্শ দেন তিনি। সেই সঙ্গে আমদানি–রপ্তানি তদারকি অব্যাহত রাখার পরামর্শ দেন।

অর্থনীতিবিদ ও আর্থিক খাতের বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ নিতে এমন একসময়ে সরকারের পক্ষ থেকে এসব বৈঠকের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, যখন দেশে নিত্যপণ্যের দাম দ্রুত বাড়ছে। আগস্ট মাসে খাদ্য মূল্যস্ফীতি সাড়ে ১২ শতাংশ ছাড়িয়েছে। দেড় বছর ধরে চলমান ডলার–সংকটে ব্যবসা–বাণিজ্য বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। খেলাপি ঋণও বাড়ছে। আবার শরিয়াহভিত্তিক কিছু ব্যাংকে চলছে তারল্যসংকট। জানা গেছে, এই সবকিছুই উঠে আসে ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদের সঙ্গে আলোচনায়। করণীয় বিষয়ে তাঁর পরামর্শ শোনেন বৈঠকে উপস্থিত সরকারের প্রতিনিধিরা।

বৈঠক সূত্রে জানা যায়, ডলার–সংকটের এ সময়ে প্রবাসী আয়ের বিপরীতে প্রকৃত অর্থে কত ডলার দেশে আসছে, আর কত ডলার বিদেশে নানাভাবে থেকে যাচ্ছে, তা গভীরভাবে খতিয়ে দেখার পরামর্শ দেন ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ। প্রবাসী আয় আনতে দেশের যেসব ব্যাংক বিদেশে শাখা বা এক্সচেঞ্জ হাউস খুলেছে, প্রয়োজনে তাদের ওপর তদারকি জোরদার করতে হবে।

বৈঠকে ব্যাংকঋণের সুদহারের বর্তমান পরিস্থিতিও তুলে ধরে বাংলাদেশ ব্যাংক। এ বিষয়ে ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদের পরামর্শ ছিল, ঢালাওভাবে সুদহার মুক্ত না করে অগ্রাধিকার খাতে স্বল্প সুদে ঋণ নিশ্চিত করতে হবে।

বৈদেশিক মুদ্রার মজুত বা রিজার্ভ নিয়ে এ অর্থনীতিবিদের পরামর্শ, রপ্তানি ও প্রবাসী আয় বাড়ানোর দিকে নজর দেওয়া, আপাতত রপ্তানি উন্নয়ন তহবিল বা ইডিএফ সুবিধা বন্ধ রাখা। 

বৈঠক শেষে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র মেজবাউল হক সাংবাদিকদের বলেন, ‘দেশের অর্থনৈতিক সংকট নিরসনে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ খুবই জরুরি। তাই আমরা অর্থনীতিবিদসহ খাতসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে আলোচনার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। এসব আলোচনায় যেসব পরামর্শ আসবে, সে অনুযায়ী আগামী মুদ্রানীতি প্রণয়ন করা হবে। গতকালের আলোচনায় ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বর্তমান মুদ্রানীতির যথাযথ বাস্তবায়ন এবং নতুন করে টাকা ছাপিয়ে সরকারকে ঋণ না দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন।