খেলাপি ঋণ বেড়ে সাড়ে ৬ লাখ কোটি টাকা, যেসব ব্যাংক বেশি দায়ী
*মোট খেলাপি ঋণ বেড়ে ৬ লাখ ৪৪ হাজার কোটি টাকা।
*বিতরণ করা মোট ঋণের প্রায় ৩৬ শতাংশ এখন খেলাপি।
*আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুসরণ করে খেলাপি ঋণের তথ্য দিচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
দেশের ব্যাংকগুলো যত টাকা ঋণ দিয়েছে, তার এক-তৃতীয়াংশের বেশিই এখন খেলাপি। মোট খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে প্রায় সাড়ে ৬ লাখ কোটি টাকা।
গত সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ব্যাংক খাতের বিতরণ করা মোট ঋণের পরিমাণ ১৮ লাখ ৩ হাজার ৮৪০ কোটি টাকা। যার ৩৫ দশমিক ৭৩ শতাংশ এখন খেলাপি। গতকাল বুধবার বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ এক প্রতিবেদনে এমন তথ্য উঠে এসেছে।
ব্যাংকাররা বলছেন, ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ কম করে দেখানোর যে প্রবণতা ছিল, তা এখন হচ্ছে না। ফলে খেলাপি ঋণের প্রকৃত চিত্র উঠে আসছে। কিছুদিন পর বরং খেলাপি ঋণের হার আরও বাড়বে।
২০০৯ সালের জানুয়ারিতে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন জোট সরকার গঠিত হওয়ার সময় খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ২২ হাজার ৪৮১ কোটি টাকা।
বাংলাদেশ ব্যাংক খেলাপি ঋণের হিসাব করে থাকে ত্রৈমাসিক ভিত্তিতে অর্থাৎ তিন মাস পরপর। গত জুন মাসে খেলাপি ঋণ ছিল ৬ লাখ ৮ হাজার ৩৪৬ কোটি টাকা। তিন মাসের ব্যবধানে বেড়েছে ৩৬ হাজার ১৬৯ কোটি টাকা।
শেখ হাসিনার টানা সাড়ে ১৫ বছরের শাসনামলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মাধ্যমে খেলাপি ঋণ কম দেখানোর একটা অপপ্রয়াস ছিল। তথ্য বিকৃত করে লুকিয়ে ফেলার চেষ্টা আমরা দেখেছি। সঠিকভাবে হিসাব করায় সেপ্টেম্বর শেষে খেলাপি হার প্রায় ৩৬ শতাংশ হয়েছে। এটা অবিশ্বাস্য হলেও অস্বাভাবিক কিছু নয়। কিছুদিনের মধ্যে এ হার বরং ৪০ শতাংশও ছাড়িয়ে যেতে পারে।মইনুল ইসলাম, সাবেক শিক্ষক, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগ
ব্যাংকাররা বলছেন, আওয়ামী লীগ সরকারের সাড়ে ১৫ বছরে ব্যাংক খাতে অনিয়ম, জালিয়াতি, প্রতারণা ও দুর্নীতি এত বেশি মাত্রায় হয়েছে যে খেলাপি ঋণের এ উচ্চ হার সেই চিত্রেরই প্রমাণ দিচ্ছে। এস আলম গ্রুপ, বেক্সিমকো গ্রুপ, নাসা গ্রুপ, বিসমিল্লাহ গ্রুপ, হল-মার্ক গ্রুপসহ আরও গ্রুপ এবং বেসিক ব্যাংক কেলেঙ্কারির কারণে খেলাপি ঋণ উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বেড়েছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, ১৯৯৯ সালে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের হার ছিল ৪১ দশমিক ১ শতাংশ। ২০১১ সালে খেলাপি ঋণের হার ৬ দশমিক ১ শতাংশে নেমে এলেও বড় বড় কেলেঙ্কারির পরে তা বাড়তে থাকে।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক শিক্ষক মইনুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘শেখ হাসিনার টানা সাড়ে ১৫ বছরের শাসনামলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মাধ্যমে খেলাপি ঋণ কম দেখানোর একটা অপপ্রয়াস ছিল। তথ্য বিকৃত করে লুকিয়ে ফেলার চেষ্টা আমরা দেখেছি। সঠিকভাবে হিসাব করায় সেপ্টেম্বর শেষে খেলাপি হার প্রায় ৩৬ শতাংশ হয়েছে। এটা অবিশ্বাস্য হলেও অস্বাভাবিক কিছু নয়। কিছুদিনের মধ্যে এ হার বরং ৪০ শতাংশও ছাড়িয়ে যেতে পারে।’
করণীয় জানতে চাইলে মইনুল ইসলাম বলেন, ‘বহু বছর ধরে আমি একটা কথা বলে আসছি, আবার বলছি, প্রত্যেক ব্যাংকের শীর্ষ ১০ খেলাপির জন্য আলাদা ট্রাইব্যুনাল করতে হবে। নইলে এ থেকে আমরা মুক্তি পাব না।’
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) পরামর্শে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ও হার নির্ধারণে আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুসরণ করছে বাংলাদেশ ব্যাংক। ব্যাংকাররা বলছেন, এ কারণেও খেলাপি ঋণের পরিমাণ ও হার বেড়েছে।
বৃদ্ধির পেছনে অন্য যে কারণ
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) পরামর্শে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ও হার নির্ধারণে আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুসরণ করছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
ব্যাংকাররা বলছেন, এ কারণেও খেলাপি ঋণের পরিমাণ ও হার বেড়েছে। খেলাপি ঋণ নীতিমালা অনুযায়ী, ঋণের কিস্তি পরিশোধের মেয়াদ শেষ হওয়ার পরদিন থেকে সেই ঋণ বকেয়া হিসেবে বিবেচিত হবে। গত এপ্রিলের আগপর্যন্ত কিস্তি পরিশোধের মেয়াদ শেষ হওয়ার ৯ মাস পর্যন্ত খেলাপি হিসেবে গণ্য করা হতো না। অর্থাৎ ৯ মাস শেষে গিয়ে খেলাপি হিসেবে বিবেচিত হতো। এখন বকেয়া হওয়ার তিন মাস পরেই খেলাপি হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, সেপ্টেম্বর শেষে ব্যাংক খাতে প্রভিশন ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ৩ লাখ ৪৪ হাজার ২৩১ কোটি টাকা। তিন মাস আগে যা ছিল ৩ লাখ ১৯ হাজার ৭২০ কোটি টাকা।
বাড়ছে প্রভিশন ঘাটতিও
খেলাপি ঋণ বৃদ্ধির পাশাপাশি প্রভিশন ঘাটতিও ব্যাপক বাড়ছে। খেলাপি ঋণের বিপরীতে নিরাপত্তাব্যবস্থা হিসেবে ব্যাংক তাদের আয় থেকে নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ সঞ্চিতি হিসেবে রাখে। কোনো কারণে ঋণ আদায় না হলেও গ্রাহকদের আমানতকে সুরক্ষা দেওয়াই হচ্ছে এর অন্যতম কারণ। প্রভিশন ঘাটতি হচ্ছে ব্যাংকের খেলাপি ঋণের বিপরীতে প্রয়োজনীয় নিরাপত্তা সঞ্চিতি বা প্রভিশন রাখতে না পারা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, সেপ্টেম্বর শেষে ব্যাংক খাতে প্রভিশন ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ৩ লাখ ৪৪ হাজার ২৩১ কোটি টাকা। তিন মাস আগে যা ছিল ৩ লাখ ১৯ হাজার ৭২০ কোটি টাকা। তিন মাসের ব্যবধানে প্রভিশন ঘাটতি বেড়েছে ২৪ হাজার ৫১১ কোটি টাকা।
দুই লাখ থেকে চার লাখ কোটি, চার লাখ থেকে ছয় লাখ কোটি আর এখন সাড়ে ছয় লাখ কোটি টাকায় পৌঁছেছে খেলাপি ঋণ। ব্যাংকগুলো বছরের পর বছর খেলাপি ঋণের তথ্য প্রকাশের পরিবর্তে বরং গোপন করেছে এবং তথ্য-উপাত্ত জালিয়াতি করে দেখিয়েছে মুনাফা।সৈয়দ আবু নাসের বখতিয়ার আহমেদ, রাষ্ট্রমালিকানাধীন অগ্রণী ব্যাংকের চেয়ারম্যান
যেসব ব্যাংক বেশি দায়ী
কম-বেশি সব ব্যাংকেই খেলাপি গ্রাহক আছে। তবে বিদেশি ব্যাংকে কম ও রাষ্ট্রমালিকানাধীন ব্যাংকে বেশি। জনতা ব্যাংক, অগ্রণী ব্যাংক, ন্যাশনাল ব্যাংক, আইএফআইসি ব্যাংকে খেলাপির পরিমাণ তুলনামূলক বেশি। তবে মোট খেলাপি বৃদ্ধিতে একীভূত হতে যাওয়া পাঁচ ব্যাংকের দায় কম নয়। ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক, ইউনিয়ন ব্যাংক, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক ও এক্সিম ব্যাংক একীভূত হতে যাচ্ছে। এ পাঁচ ব্যাংকের প্রায় দুই লাখ কোটি টাকা ঋণের মধ্যে দেড় লাখ কোটি টাকা খেলাপি।
এক্সিম ব্যাংক ছাড়া বাকি চারটিই ছিল সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা-গোষ্ঠী এস আলম গ্রুপের নিয়ন্ত্রণে। তারা এসব ব্যাংক থেকে নামে-বেনামে বিপুল পরিমাণ টাকা তুলে নিয়েছে, যা এখন খেলাপি।
রাষ্ট্রমালিকানাধীন অগ্রণী ব্যাংকের চেয়ারম্যান সৈয়দ আবু নাসের বখতিয়ার আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, দুই লাখ থেকে চার লাখ কোটি, চার লাখ থেকে ছয় লাখ কোটি আর এখন সাড়ে ছয় লাখ কোটি টাকায় পৌঁছেছে খেলাপি ঋণ। ব্যাংকগুলো বছরের পর বছর খেলাপি ঋণের তথ্য প্রকাশের পরিবর্তে বরং গোপন করেছে এবং তথ্য-উপাত্ত জালিয়াতি করে দেখিয়েছে মুনাফা।
সৈয়দ আবু নাসের বখতিয়ার আহমেদ বলেন, বিষয়টি আর কিছুই নয়, আগের সরকারের আমলের অনিয়ম-দুর্নীতির ফল। অন্তর্বর্তী সরকার আসার পর বাংলাদেশ ব্যাংক বলে দিয়েছে, খেলাপি ঋণের হিসাব হবে স্বচ্ছ এবং তথ্য-উপাত্তের জালিয়াতি আর করা যাবে না। খেলাপি ঋণের পরিমাণ বাড়লেও সত্য তথ্য উঠে আসছে—এটাই হচ্ছে ইতিবাচক দিক।