পি কে হালদারের সেই কুমিরের খামার বিক্রি হলো ৩৮ কোটি টাকায়

ময়মনসিংহের ভালুকায় দেশের প্রথম কুমিরের খামার চালু করেন লেখক মুশতাক আহমেদ। ২০১৩ সালে সেটি কিনে নেন পি কে হালদার ও তাঁর সহযোগীরা।

ফাইল ছবি

ঋণ শোধ করতে না পারায় অবশেষে বিক্রি হয়ে গেল কুমিরের খামার রেপটাইলস ফার্মস লিমিটেড। প্রায় ৩ হাজার ৭০০ কুমিরসহ ময়মনসিংহের ভালুকায় অবস্থিত ১৩ একর জমির এই খামার বিক্রি হয়েছে প্রায় ৩৮ কোটি টাকায়। আলোচিত প্রশান্ত কুমার (পি কে) হালদারের মালিকানাধীন এই প্রতিষ্ঠান নিলামে সর্বোচ্চ দামে কিনে নিয়েছে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা উদ্দীপন।

সংকটে থাকা আর্থিক প্রতিষ্ঠান ইন্টারন্যাশনাল লিজিং অ্যান্ড ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিস লিমিটেডে রেপটাইলস ফার্মস লিমিটেডের ঋণ ছিল ১১০ কোটি টাকা। ইতিমধ্যে উদ্দীপন প্রায় আট কোটি টাকা জমা দিয়ে খামারটি নেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু করেছে বলে জানিয়েছে ইন্টারন্যাশনাল লিজিং কর্তৃপক্ষ।

খামারটির আসল মালিক পি কে হালদার হলেও নথিপত্রে এর চেয়ারম্যান সিমু রায় ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক রাজীব সোম। তাঁরা সম্পর্কে স্বামী-স্ত্রী। পি কে হালদার বিদেশে পালিয়ে যাওয়ার পর তাঁরাও দেশ ছেড়ে কানাডায় চলে যান। ২০২০ সালে দেশে ছেড়ে যাওয়ার আগে রাজীব সোম প্রথম আলোকে বলেছিলেন, রেপটাইলস ফার্মস লিমিটেডে তাঁরা মূলত পি কে হালদারের প্রতিনিধি।

খামারটি হস্তান্তর করা হলেও ঋণের বাকি টাকা আদায়ে নথিপত্রে থাকা মালিকদের বিরুদ্ধে মামলা চলমান থাকবে বলে জানিয়েছেন ইন্টারন্যাশনাল লিজিংয়ের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (চলতি দায়িত্বে) মো. মশিউর রহমান। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, খামারটির মূল্যমান ৪ কোটি টাকা হলেও পর্যটনের সম্ভাবনা থাকায় এটি ৩৮ কোটি টাকায় বিক্রি হয়েছে। কুমিরগুলোর দেখভাল করায় এটা সম্ভব হয়েছে। খামার বিক্রি করে এখন ঋণের একটা অংশ পরিশোধ করা হবে। বাকি টাকা আদায়ে মামলা চলতে থাকবে।

২০০৩ সালে ময়মনসিংহের ভালুকায় ১৩ দশমিক ৮ একর জমির ওপর দেশের প্রথম কুমির খামার চালু করেছিলেন লেখক ও উদ্যোক্তা মুশতাক আহমেদ। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে গ্রেপ্তার হওয়ার পর ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে তিনি কারাগারে মৃত্যুবরণ করেন। এই খামার প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য ছিল কুমিরের চামড়া রপ্তানি করা। ২০০৪ সালে রেপটাইলস ফার্মটি বাণিজ্যিক কার্যক্রম শুরুর অনুমোদন পায়। ২০০৫ সালে বাংলাদেশ ব্যাংক পরিচালিত সমমূলধন সহায়তা তহবিল বা ইইএফ থেকে ২ কোটি ৪৩ লাখ টাকা বিনিয়োগ পায় খামারটি। এ বিনিয়োগের বিপরীতে খামারটির ৪৯ শতাংশ মালিকানা পায় ইইএফ। আর বাকি ৫১ শতাংশ শেয়ারের মধ্যে ৩৬ শতাংশ শেয়ার ছিল মেজবাহুল হকের ও ১৫ শতাংশ মুশতাক আহমেদের। প্রতিষ্ঠানটির মূলধন ছিল পাঁচ কোটি টাকা। ২০১৩ সালে মুশতাক আহমেদের কাছ থেকে খামারটি কিনে নেন আলোচিত পি কে হালদার ও তাঁর সহযোগীরা।

এরপর খামার সম্প্রসারণ ও উন্নয়ন করতে ইন্টারন্যাশনাল লিজিং থেকে ৫৭ কোটি টাকা ঋণ নেন পি কে হালদার। জামানত হিসেবে খামারের জমি বন্ধক রাখা হয়। ২০১৯ সালে পি কে হালদার পালিয়ে গেলে প্রতিষ্ঠানটির ঋণ খেলাপি হয়ে পড়ে। পি কে হালদার ভারতে আটকের পর হাইকোর্ট রেপটাইলস ফার্ম পরিচালনার জন্য ছয় সদস্যের একটি বোর্ড গঠন করে দেয়। এরপর খামারটি পরিচালনা ও টিকিয়ে রাখতে আরও ঋণ দেয় ইন্টারন্যাশনাল লিজিং।

চলতি বছর নানা প্রক্রিয়া শেষে ঋণের টাকা আদায়ে খামারটি নিলামে তোলে ইন্টারন্যাশনাল লিজিং। জানা গেছে, নিলামে বেসরকারি সংস্থা উদ্দীপন ৩৮ কোটি ২০ লাখ টাকা এবং সি পার্ল সুন্দরবন ইকো রিসোর্ট ৩০ কোটি ১১ লাখ টাকা দাম প্রস্তাব করে। এ ছাড়া আরও দুটি প্রতিষ্ঠান ৩০ কোটি ও ২৮ কোটি টাকা দাম প্রস্তাব করলেও তাদের প্রতিনিধি নিলামের দিন উপস্থিত ছিলেন না এবং কোনো পে–অর্ডারও জমা দেননি। এরপর উদ্দীপনকে খামারটি দেওয়ার সিদ্ধান্ত জানিয়ে গত ২৮ আগস্ট চিঠি দেয় ইন্টারন্যাশনাল লিজিং। টাকা জমা দিতে ৯০ দিন সময় দেওয়া হয়েছে। আগে পে–অর্ডারের মাধ্যমে তিন কোটি টাকা দেওয়ার পর ইতিমধ্যে আরও পাঁচ কোটি টাকা জমা দিয়েছে সংস্থাটি।

রেপটাইলস ফার্মস লিমিটেডের ব্যবস্থাপক আবু সাইম মোহাম্মদ আরিফ প্রথম আলোকে বলেন, ২০১৪ সাল থেকে এ পর্যন্ত ১ হাজার ৫০৭টি কুমিরের চামড়া জাপানে রপ্তানি করা হয়েছে। প্রতিটি কুমিরের চামড়ার আন্তর্জাতিক বিক্রয়মূল্য ৫০০ থেকে ৬০০ ডলার। ২০০৪ সালে মালয়েশিয়া থেকে আমদানি করা ৭৫টি কুমির নিয়ে যাত্রা শুরু হয় খামারটির। খামারটিতে বর্তমানে কুমিরের সংখ্যা ৩ হাজার ৭০০টি।