খোলাবাজার ও ব্যাংকে ডলারের দাম আরও কিছুটা বেড়েছে। খোলাবাজার ও মানি চেঞ্জারে ডলারের দাম গতকাল ১ থেকে ২ টাকা বেড়ে হয়েছে ১০৯-১১০ টাকা। আর ব্যাংকগুলো প্রবাসী আয় আনছে ১০৫ টাকা দরে। ফলে আমদানিকারকদের আমদানি ব্যয় মেটাতে ডলারের বাড়তি দাম গুনতে হচ্ছে।
এদিকে খোলাবাজারে ডলারের দাম নিয়ন্ত্রণে আনতে দ্বিতীয় দিনের মতো গতকালও রাজধানীর বিভিন্ন মানি চেঞ্জার পরিদর্শন করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা সংস্থার (এনএসআই) সদস্যদের সঙ্গে নিয়ে এ পরিদর্শন কার্যক্রম চালাচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। পাশাপাশি অবৈধভাবে ডলার মজুতকারীদের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনার ঘোষণা দিয়েছে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) গোয়েন্দা বিভাগ (ডিবি)। ফলে ডলারের বাজারের দাম নিয়ন্ত্রণে বাংলাদেশ ব্যাংকের পাশাপাশি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীও এখন নানামুখী পদক্ষেপ নিতে শুরু করেছে।
এদিকে ব্যাংক খাতে ডলারের দামে তদারকি আরও জোরদার করা হয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক গতকাল এক নির্দেশনায় বলেছে, এখন থেকে আমদানির ক্ষেত্রে ৩০ লাখ ডলারের বেশি ঋণপত্র খোলার ২৪ ঘণ্টা আগে তা বাংলাদেশ ব্যাংককে জানাতে হবে। আগে ৫০ লাখ ডলারের বেশি ঋণপত্র খোলার ক্ষেত্রে এ বাধ্যবাধকতা আরোপ করা হয়েছিল।
ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের নেতারা গতকাল গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদারের সঙ্গে দেখা করে ডলারের বাজার তদারকিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে আরও সতর্ক ও সচেতন হওয়ার দাবি জানিয়েছেন। ব্যাংকে ডলারের সংকট কাটাতে গতকালও রিজার্ভ থেকে ৫ কোটি ৪০ লাখ ডলার বিক্রি করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। ফলে রিজার্ভ কমে হয়েছে ৩ হাজার ৯৪৭ কোটি ডলার।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র সিরাজুল ইসলাম সাংবাদিকদের বলেন, ডলারের বাজারের জন্য যখন যা প্রয়োজন, বাংলাদেশ ব্যাংক সে অনুযায়ী পদক্ষেপ নিচ্ছে। একটি গোয়েন্দা সংস্থার সহযোগিতায় মানি চেঞ্জার পরিদর্শন চলছে। এতে বিভিন্ন অনিয়ম ধরা পড়ছে। যেসব অনিয়ম ধরা পড়ছে, তার পরিপ্রেক্ষিতে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এ বাজারকে স্বাভাবিক করতে ব্যাংকগুলো যেন সতর্ক পদক্ষেপ নেয়, বাংলাদেশ ব্যাংক সেই আশা করে।
তবে ব্যাংক কর্মকর্তারা বলছেন, বর্তমান বাস্তবতায় নির্দেশ দিয়ে ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে দিয়ে এ বাজার নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়। কারণ, ডলার দেশি পণ্য নয়। বিদেশ থেকে ডলার আসা না বাড়লে দাম বাড়তেই থাকবে।
গতকালের দরদাম
গতকাল মানি চেঞ্জার ও খোলাবাজারের বিক্রেতা ডলার কিনেছেন ১০৯ টাকা ৪০ পয়সায় আর বিক্রি করেছেন ১১০ টাকায়। তবে ঢাকা বিমানবন্দর এলাকায় ১১৫ টাকায়ও ডলার বিক্রির তথ্য পাওয়া গেছে। গত বুধবার খোলাবাজারে ডলারের দাম ১০৮ টাকায় নেমে এসেছিল। এ বাজারের ওপর কোনো নিয়ন্ত্রণ না থাকায় যে যাঁর মতো দামে বিক্রি করছেন। আর সরবরাহসংকট থাকায় ডলার কেনার উৎসও সীমিত হয়ে গেছে।
ব্যাংক কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, গতকাল বিদেশের রেমিট্যান্স হাউসগুলো ১০৪ থেকে ১০৫ টাকা ডলার বিক্রি করেছে। বাংলাদেশের যেসব ব্যাংক এর কম দাম দিয়েছে, তারা ডলার পায়নি। যাদের জরুরি প্রয়োজন ছিল, তারা এ দামে ডলার কিনেছে। তবে রপ্তানি বিল নগদায়ন হয়েছে কিছুটা কম দামে।
একাধিক ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ৫০ লাখ ডলার আমদানির ঋণপত্রের তথ্য বাংলাদেশ ব্যাংকে জমার নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। তাই তথ্য গোপন রাখতে অনেক ব্যাংক ও আমদানিকারক একজোট হয়ে ভেঙে ভেঙে ঋণপত্র খোলা শুরু করেছেন। এ কারণে গতকাল বাংলাদেশ ব্যাংক ৩০ লাখ ডলারের ঋণপত্রের তথ্য জানানোর নির্দেশ জারি করেছে।
দেশে জ্বালানি তেল ও ভোগ্যপণ্যের দাম বেড়ে সার্বিকভাবে আমদানি খরচ বৃদ্ধি পাওয়ায় ডলারের ওপর চাপ পড়েছে। আবার রপ্তানি বাড়লেও তা আমদানির মতো নয়। প্রবাসী আয়ও বাড়েনি, বরং কমেছে। ফলে দেশে ডলারের সংকট তৈরি হয়েছে। এতে প্রতিনিয়ত বাড়ছে আন্তর্জাতিক লেনদেনে ব্যবহৃত প্রধান এ মুদ্রার দাম।
ডলারের ওপর চাপ কমাতে সরকারি কর্মকর্তাদের বিদেশ সফর বন্ধ করেছে সরকার। বাংলাদেশ ব্যাংক ২৭টি পণ্য আমদানিতে ব্যাংকঋণ বন্ধ করে দিয়েছে। ব্যাংকগুলোর খরচ কমাতে গাড়ি কেনা বন্ধসহ নানা পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে ব্যাংকের ডলার ধারণের সীমা (এনওপি) হ্রাস, রপ্তানিকারকের প্রত্যাবাসন কোটায় (ইআরকিউ) ধারণকৃত ডলারের ৫০ শতাংশ নগদায়ন, ইআরকিউ হিসাবে জমা রাখার সীমা কমিয়ে অর্ধেকে নামিয়ে আনা এবং অফশোর ব্যাংকিং ইউনিটের বৈদেশিক মুদ্রার তহবিল অভ্যন্তরীণ ব্যাংকিং ইউনিটে স্থানান্তর। এর ফলে সংকট কিছুটা কমার আশা করেছিলেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা। তবে এসব পদক্ষেপের পরও দাম বাড়ছে
অভিযান জোরদার
বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা গতকাল মোহাম্মদপুর, মিরপুর, বিমানবন্দর ও উত্তরা এলাকার প্রায় ৪০টি মানি চেঞ্জার পরিদর্শন করেছেন। এ সময় তাঁরা নিয়ম মেনে ডলার কেনাবেচা করা হচ্ছে কি না, তা যাচাই করে দেখেন। কিছু কিছু ক্ষেত্রে অনিয়মের প্রমাণ মেলে।
এদিকে গতকাল ডিএমপির মিডিয়া সেন্টারে এক সংবাদ সম্মেলনে ডিএমপির ডিবি প্রধান মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ বলেন, ডলারের মূল্যবৃদ্ধির এ সময়ে কেউ যদি অবৈধভাবে মজুত করেন, তাহলে তাঁদের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করবে ডিবি। আমরা যদি তথ্য পাই কেউ ডলার মজুত করছেন, কারও কাছে অবৈধ ডলার তৈরির মেশিন বা সরঞ্জামাদি আছে, তাহলে অবশ্যই তাঁদের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করব। অবৈধ ডলার মজুতকারীদের তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে বলে জানান হারুন অর রশীদ।