এক ব্যক্তির ৫০ লাখ টাকার বেশি আমানত নিতে পারবে না লিজিং কোম্পানি

বাংলাদেশ ব্যাংক
ছবি: সংগৃহীত

কোনো একক ব্যক্তির কাছ থেকে এখন থেকে আর ৫০ লাখ টাকার বেশি আমানত নিতে পারবে না দেশের কোনো ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠান বা লিজিং কোম্পানি। একই সঙ্গে যৌথ নামে কোনো ব্যক্তি আর্থিক প্রতিষ্ঠানে ১ কোটি টাকার বেশি আমানত রাখতে পারবেন না।

সংশোধিত আর্থিক প্রতিষ্ঠান বা ফাইন্যান্স কোম্পানি আইনে এ বিধান যুক্ত করা হয়েছে। ১৩ নভেম্বর সংশোধিত এ আইনের গেজেট প্রকাশ করা হয়েছে।

নতুন আইনে আরও বিধান করা হয়েছে, কোনো ব্যক্তি, তাঁর পরিবারের সদস্য ও স্বার্থসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান মিলে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে কোনো আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ১৫ শতাংশের বেশি শেয়ারধারণ করতে পারবেন না। পাশাপাশি কোনো আর্থিক প্রতিষ্ঠান অন্য কোনো আর্থিক প্রতিষ্ঠান বা ব্যাংকের উল্লেখযোগ্যসংখ্যক শেয়ারের মালিক হতে পারবে না।

এমনকি কোনো ব্যক্তি বা তাঁর পরিবারের সদস্য ও স্বার্থসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান মিলে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে কোনো আর্থিক প্রতিষ্ঠানের উল্লেখযোগ্য শেয়ারের মালিক হলে ওই ব্যক্তি বা তাঁর পরিবার ও স্বার্থসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান অন্য কোনো আর্থিক প্রতিষ্ঠান বা ব্যাংকের উল্লেখযোগ্য শেয়ারধারণ করতে পারবেন না।

আগে এক ব্যক্তি, তাঁর পরিবার ও স্বার্থসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে শেয়ারধারণের সর্বোচ্চ সীমা ছিল ২৫ শতাংশ। তবে আগে এক আর্থিক প্রতিষ্ঠানের উল্লেখযোগ্য শেয়ার থাকলে অন্য আর্থিক প্রতিষ্ঠান বা ব্যাংকের উল্লেখযোগ্য শেয়ারধারণের বিষয়ে কোনো বাধ্যবাধকতা ছিল না বলে জানান খাত-সংশ্লিষ্টরা।

খাত-সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আমানত সংগ্রহ ও শেয়ারধারণ-সংক্রান্ত নতুন এ বিধানের ফলে দেশের কোনো কোনো আর্থিক প্রতিষ্ঠান সাময়িকভাবে অসুবিধায় পড়তে পারে। কারণ, বর্তমানে একাধিক আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও তার সঙ্গে যুক্ত উদ্যোক্তারা একাধিক আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও ব্যাংকের উল্লেখযোগ্যসংখ্যক শেয়ারের মালিকানায় রয়েছেন। এ ধরনের প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তির ক্ষেত্রে নতুন আইন কার্যকরের দুই বছরের মধ্যে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক শেয়ার ধারককে নির্ধারিত শেয়ারের অতিরিক্ত শেয়ার বিক্রি বা হস্তান্তর করে দিতে হবে।

এ ছাড়া কোনো আর্থিক প্রতিষ্ঠানে এক পরিবার থেকে দুজনের বেশি পরিচালক থাকতে পারবেন না। একজন পরিচালক একটানা সর্বোচ্চ তিন মেয়াদে বা ৯ বছর পরিচালক থাকতে পারবেন।

একাধিক আর্থিক প্রতিষ্ঠানের উদ্যোক্তা ও শীর্ষ কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, উল্লেখযোগ্যসংখ্যক শেয়ারধারণ-সংক্রান্ত নতুন আইনি বিধানটি কার্যকরে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে পরিচালনা পর্ষদের সভা করার নির্দেশ দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।

আমানতের সীমা ও তার প্রভাব

খাত-সংশ্লিষ্টরা বলছেন, একক ব্যক্তির কাছ থেকে সর্বোচ্চ ৫০ লাখ টাকার বেশি আমানত গ্রহণ করতে না পারার বিধানের ফলে সাময়িকভাবে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো আমানত সংগ্রহে সংকটে পড়তে পারে। যাদের ৫০ লাখ টাকার বেশি আমানত রয়েছে, মেয়াদ শেষে তা নবায়নের ক্ষেত্রে এ বিধান কার্যকর হলে অনেক আর্থিক প্রতিষ্ঠানের আমানতে টান পড়বে।

এ বিষয়ে আইপিডিসির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মমিনুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘এ  সিদ্ধান্ত কার্যকর করা হলে তাতে ভালো মানের অনেক আর্থিক প্রতিষ্ঠানের আমানতেও টান পড়বে। এ আশঙ্কার কথা আমরা এরই মধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংককে জানিয়েছি। বাংলাদেশ ব্যাংক আমাদের আশ্বস্ত করেছে ভালো প্রতিষ্ঠান যাতে ক্ষতিগ্রস্ত না হয়, সে উদ্যোগ নেওয়া হবে।’

তবে নতুন আইনে আমানত গ্রহণের সীমা বেঁধে দেওয়ায় দীর্ঘমেয়াদি তা আর্থিক প্রতিষ্ঠানের জন্য ইতিবাচক হবে বলেই মনে করেন একাধিক আর্থিক প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ নির্বাহীরা। তাঁরা বলছেন, আমানত গ্রহণের ক্ষেত্রে এত দিন কোনো বাধ্যবাধকতা না থাকায় বর্তমানে আর্থিক প্রতিষ্ঠানের গ্রাহকভিত্তি অল্প কিছু আমানতকারীর মধ্যে সীমাবদ্ধ।

এখন নতুন বিধানের কারণে অনেকেই নতুন নতুন গ্রাহক খুঁজে বের করতে আগ্রহী হবে। তাতে গ্রাহকভিত্তি বড় হবে। এ ছাড়া ভবিষ্যতে গ্রাহকের আমানত পরিশোধে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে বড় ধরনের কোনো ঝুঁকিতে পড়তে হবে না। গ্রাহকের আমানতও সুরক্ষিত থাকবে।

অর্থনীতিবিদ ও বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পিআরআইয়ের নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, এতে সাময়িকভাবে কিছু প্রতিষ্ঠান যেমন আমানত হারাবে তেমনি নতুন করে কিছু আমানত পাবে। কারণ, কারও বেশি আমানত থাকলে তিনি এখন ভাগ ভাগ করে একাধিক প্রতিষ্ঠানে তা রাখবেন। সে ক্ষেত্রে ভালো আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মধ্যেই ঘুরেফিরে এ আমানত থাকবে।  

সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, একক ব্যক্তির কাছ থেকে ৫০ লাখ টাকার বেশি আমানত না নেওয়ার বিধানটি করা হয়েছে মূলত সাম্প্রতিক সময়ে কিছু আর্থিক প্রতিষ্ঠানের বড় ধরনের অনিয়মের বিষয়টি মাথায় রেখে। ২০১৮ সালের আগে-পরে নানা কেলেঙ্কারির মাধ্যমে নামে-বেনামে শেয়ার কিনে দেশের ৪-৫টি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের নিয়ন্ত্রণ নেন প্রশান্ত কুমার (পি কে) হালদার।

পরে এসব আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে কয়েক হাজার কোটি টাকা বের করে নেন তিনি। এসব আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মধ্যে রয়েছে ইন্টারন্যাশনাল লিজিং, পিপলস লিজিং, বাংলাদেশ ইন্ডাস্ট্রিয়াল ফাইন্যান্স কোম্পানি বা বিআইএফসি, এফএএস ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট, সাবেক রিলায়েন্স ফাইন্যান্স ইত্যাদি। এসব প্রতিষ্ঠানে আমানত রেখে কয়েক হাজার গ্রাহক এখন তা আর ফেরত পাচ্ছেন না। এ ধরনের পরিস্থিতির যাতে পুনরাবৃত্তি না ঘটে, এ জন্য আমানতের সীমা বেঁধে দেওয়ার পাশাপাশি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের শেয়ারধারণ-সংক্রান্ত নতুন বিধান করা হয়েছে।

আর্থিক প্রতিষ্ঠান বা লিজিং কোম্পানিগুলোর শীর্ষ নির্বাহীদের সংগঠন বাংলাদেশ লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্স কোম্পানিজ অ্যাসোসিয়েশনের (বিএলএফসিএ) সভাপতি গোলাম সারওয়ার ভূঁইয়া বলেন, বর্তমানে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর আমানত কিছুসংখ্যক গ্রাহকের মধ্যে সীমাবদ্ধ। ব্যাংকের তুলনায় আর্থিক প্রতিষ্ঠানে কিছুটা বেশি সুদ পাওয়ায় এসব গ্রাহকের বড় অঙ্কের আমানত রয়েছে।

এখন যেহেতু আমানতের সীমা বেঁধে দেওয়া হয়েছে, তাই আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো বেশিসংখ্যক গ্রাহকের কাছ থেকে আমানত সংগ্রহে আগ্রহী হবে। তবে সাময়িকভাবে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর আমানতে কিছুটা ঘাটতি দেখা দিতে পারে।

শেয়ারধারণ বিষয়ে বিধান ও তার প্রভাব

সংশোধিত আইন অনুযায়ী, কোনো ব্যক্তি, তাঁর পরিবারের সদস্য ও স্বার্থসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান মিলে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে কোনো আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ১৫ শতাংশের বেশি শেয়ারধারণ করতে পারবেন না। পাশাপাশি কোনো আর্থিক প্রতিষ্ঠান অন্য কোনো আর্থিক প্রতিষ্ঠান বা ব্যাংকের উল্লেখযোগ্যসংখ্যক শেয়ারের মালিক হতে পারবে না। এ বিধানের ফলে কয়েকটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও ব্যাংকের উদ্যোক্তারা সমস্যায় পড়তে পারেন বলে মনে করছেন খাত-সংশ্লিষ্টরা।

বিডি ফাইন্যান্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক কায়সার হামিদ প্রথম আলোকে বলেন, অতীতে কিছু প্রতিষ্ঠানের অনিয়মের কারণে এ ধরনের বিধান করা হয়েছে। ফলে ভালো কিছু প্রতিষ্ঠানেরও এ ক্ষেত্রে সমস্যা দেখা দিতে পারে।  

বর্তমানে আইপিডিসি ফাইন্যান্সের ২৫ শতাংশ শেয়ার রয়েছে বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাকের হাতে। একই সঙ্গে ডিবিএইচ ফাইন্যান্সেরও প্রায় সাড়ে ১৮ শতাংশ শেয়ার ব্র্যাকের হাতে রয়েছে। এ ছাড়া ব্র্যাক ব্যাংকের সঙ্গেও জড়িত ব্র্যাক।

এ বিষয়ে আইপিডিসির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মমিনুল ইসলাম বলেন, ‘বিষয়টি আমরা শিগগিরই পরিচালনা পর্ষদের সভা ডেকে সেখানে তুলে ধরব। সেখানে যে মতামত উঠে আসবে, তা বাংলাদেশ ব্যাংককে জানাব। শেয়ারধারণের বিষয়ে কোনো সমস্যা দেখা দিলে তা সমাধানের আশ্বাস দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।’

একইভাবে বাংলাদেশ বা বিডি ফাইন্যান্সের ২৪ শতাংশের বেশি শেয়ার রয়েছে আনোয়ার গ্রুপ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের হাতে। পাশাপাশি আনোয়ার গ্রুপ ও তাদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান সিটি ব্যাংক ও মধুমতি ব্যাংকের মালিকানার সঙ্গেও জড়িত রয়েছে। মধুমতি ব্যাংকে আনোয়ার গ্রুপের সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের উল্লেখযোগ্য শেয়ার রয়েছে।

এ বিষয়ে আনোয়ার গ্রুপ ও বিডি ফাইন্যান্সের চেয়ারম্যান মানোয়ার হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘বিভিন্ন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের জন্মলগ্ন থেকেই আমরা যুক্ত হয়েছি। এখন হুট করে যদি আমাদের এসব প্রতিষ্ঠানের শেয়ার বিক্রি করে দিতে বলা হয়, তাহলে তাতে সমস্যা দেখা দিতে পারে। সংশোধিত আইনে কিছু বিধান যুক্ত করা হয়েছে, যেগুলো মাথাব্যথার জন্য মাথা কেটে ফেলার শামিল। তাই আমি মনে করি, এ ধরনের বিধান করার আগে সবার মতামতের ভিত্তিতে করা হলে সেটি আরও ভালো হতো।’