প্রিমিয়ার ব্যাংকের চেয়ারম্যান ও এমডিকে প্রাণনাশের হুমকি এইচ বি এম ইকবালের

ইকবাল সেন্টারে আড়াই দশক ধরে প্রিমিয়ার ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়। ২২তলা ভবনের সিংহভাগ ফ্লোর নিয়েই প্রিমিয়ার ব্যাংকের প্রধান কার্যালয় পরিচালিত হচ্ছে। রাজধানীর বনানীর কামাল আতাতুর্ক অ্যাভিনিউয়েছবি: প্রথম আলো

প্রিমিয়ার ব্যাংকের বর্তমান চেয়ারম্যান ও এমডিকে প্রাণনাশের হুমকি দিয়েছেন সাবেক চেয়ারম্যান এইচ বি এম ইকবাল। পাশাপাশি ব্যাংকটির প্রধান কার্যালয়ের পানি ও বিদ্যুতের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেওয়ার হুমকি দিয়েছেন তিনি। প্রিমিয়ার ব্যাংকের প্রধান কার্যালয় ও বনানী শাখা এইচ বি এম ইকবালের মালিকানাধীন ইকবাল সেন্টারে। এ নিয়ে ব্যাংকটির পক্ষ থেকে বনানী থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করা হয়েছে।

এদিকে ইকবাল সেন্টার ছেড়ে দেওয়ার প্রস্তুতি নিয়েছে ব্যাংকটি। এ জন্য ইতিমধ্যে ভবনের জায়গার খোঁজে আগ্রহপত্র আহ্বান করেছে। পাশাপাশি ব্যাংকটির কর্মকর্তারা গুলশান, বনানী এলাকায় প্রধান কার্যালয়ের জন্য জায়গা খুঁজছে। এমন পরিস্থিতিতে নতুন করে আলোচনায় এসেছে বনানীর ইকবাল সেন্টার। এ ভবনে বিভিন্ন সময় ব্যাংক কর্মকর্তাদের আটকে রাখার খবর ছাপা হয়েছিল প্রথম আলোসহ একাধিক গণমাধ্যমে।

১৯৯৯ সালে প্রতিষ্ঠার পর থেকে প্রিমিয়ার ব্যাংকের চেয়ারম্যান ছিলেন আওয়ামী লীগের সাবেক সংসদ সদস্য এইচ বি এম ইকবাল। গত বছরের আগস্টে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর তিনি প্রিমিয়ার ব্যাংক ছেড়ে দেন। এরপর গত আগস্টে ব্যাংকটিতে নতুন পর্ষদ গঠন করে দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। এর পর থেকে ব্যাংকটিতে এইচ বি ইকবালের বেনামি ঋণ, কেনাকাটা, ভাড়ায় অনিয়মসহ নানা অনিয়ম বের হয়ে আসছে।

প্রিমিয়ার ব্যাংকের চেয়ারম্যান আরিফুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি দীর্ঘদিন পর ব্যাংকে ফিরেছি। এরপর এসে নানা সমস্যা পাচ্ছি। কাজ করতে গিয়ে নানা প্রতিবন্ধকতার মধ্যে পড়তে হচ্ছে, হুমকিও পাচ্ছি। এরপরও কাজ করে যাচ্ছি। খরচ কমাতে প্রধান কার্যালয়সহ একাধিক শাখা সরিয়ে ফেলা হবে।’

জিডিতে যা বলা হয়েছে

প্রিমিয়ার ব্যাংকের অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এএমডি) শাহেদ সেকান্দার গত ১৪ সেপ্টেম্বর ব্যাংকের পক্ষে বনানী থানায় জিডি করেন। এতে তিনি উল্লেখ করেন, সাবেক চেয়ারম্যান এইচ বি এম ইকবাল ১২ সেপ্টেম্বর সকাল ১০টা ৮ মিনিটে ফোন করে প্রথমে ৩১ মিনিট ও একই দিন রাত ১০টা ৪৭ মিনিটে ফোন করে আরও ২ মিনিট কথা বলেন। এ সময় তিনি ইকবাল সেন্টার ও গুলশানের রেনেসাঁ হোটেলে থাকা গুলশান শাখার ভাড়া ১৪ সেপ্টেম্বর বিকেল পাঁচটার মধ্যে পরিশোধ করতে বলেন। অন্যথায় ব্যাংকের চেয়ারম্যান আরিফুর রহমান ও এমডি মোহাম্মদ আবু জাফরের সমস্যা হবে এবং এমডি মোহাম্মদ আবু জাফরের বাড়ি ‘ভ্যানিশ’ করে দেওয়া হবে বলে হুমকি দেন। এ সময় তিনি আরও বলেন, ব্যাংকের পানি ও বিদ্যুতের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হবে। যেকোনো সময় যেকোনো ঘটনা ঘটতে পারে এ কথা জানিয়ে কর্মকর্তাদের নিজ দায়িত্বে অফিসে আসতে বলেন।

এইচ বি এম ইকবাল
ছবি: সংগৃহীত

জিডিতে শাহেদ সেকান্দার আরও উল্লেখ করেন, ১৩ সেপ্টেম্বর বেলা ৩টা ৪৭ মিনিটে এইচ বি এম ইকবাল আবারও তাঁকে ফোন করেন। এ সময় ১৫ সেপ্টেম্বরের মধ্যে ভাড়া পরিশোধ না করলে বর্তমান চেয়ারম্যান ও এমডির জীবননাশের হুমকি দেন এবং যেকোনো ধরনের সহিংস ঘটনার জন্য প্রস্তুত থাকতে বলেন।

ব্যাংকটির কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, এইচ বি এম ইকবাল চেয়ারম্যান থাকাকালীন সময়ে অগ্রিম ভাড়া হিসেবে প্রায় ২০০ কোটি টাকা উত্তোলন করেন। ফলে তাঁকে প্রতি মাসে ভাড়া দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। এ ছাড়া ভবনের ভাড়াও বাজারের তুলনায় দ্বিগুণ নিয়েছেন। এ জন্য তার সব স্থাপনা ছেড়ে দেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু করেছে প্রিমিয়ার ব্যাংক।

এ নিয়ে বক্তব্য জানতে এইচ বি এম ইকবালকে ফোন করা হলে তিনি সাড়া দেননি।

ইকবাল সেন্টার কেন আলোচিত

নব্বইয়ের দশকে গড়ে ওঠা বনানীর কামাল আতাতুর্ক অ্যাভিনিউয়ে ইকবাল সেন্টার শুরু থেকেই প্রিমিয়ার ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়। ভবনটির ২২ তলার মধ্যে ১৯ তলার ভাড়া দেয় প্রিমিয়ার ব্যাংক। অন্য তলার একটিতে এইচ বি এম ইকবালের বুখারা রেস্তোরাঁ, একটিতে তার প্রিমিয়ার গ্রুপ। ১৮ তলার অনুমতি নিয়ে ২২ তলা নির্মাণ করায় একাধিকবার অভিযান চালায় রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ। এ ছাড়া ব্যাংক কর্মকর্তাদের বিভিন্ন সময় ভবনটিতে আটকে রাখার জন্য ভবনটি আলোচিত।

২০১৩ সালের জানুয়ারিতে প্রথম আলোতে ‘প্রিমিয়ার ব্যাংকের এ কী কাণ্ড!’ শিরোনামে একটি সংবাদ প্রকাশিত হয়। এতে বলা হয়, চার দিন নিজেদের কাছে আটকে রাখার পর এক কর্মকর্তাকে পুলিশে দিয়েছে প্রিমিয়ার ব্যাংক কর্তৃপক্ষ। ওই কর্মকর্তাকে ব্যাংকের বনানীর প্রধান কার্যালয়ে আটকে রেখে নির্যাতন করা হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। ওই ব্যাংক কর্মকর্তার নাম শাহিনুর রহমান। তিনি আওয়ামী লীগের সাবেক সাংসদ এইচ বি এম ইকবালের মালিকানাধীন প্রিমিয়ার ব্যাংকের মতিঝিল করপোরেট শাখার ব্যবস্থাপক ছিলেন। তিনিসহ ওই ব্যাংকের পাঁচ কর্মকর্তাকে সাময়িক বরখাস্ত করেছিল ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ। ঘটনার পর থেকে তিনি নিখোঁজ ছিলেন।

ওই প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, বরখাস্ত করার পরদিন বৃহস্পতিবার ওই কর্মকর্তাদের ইকবাল সেন্টারে প্রধান কার্যালয়ে ডেকে নেওয়া হয়। এরপর ১৯ তলা ওই ভবনের নবম তলায় তাঁদের আটকে রাখা হয়। ছয়জন প্রহরী সর্বক্ষণ তাঁদের পাহারা দেন। পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগের জন্য তাঁদের মাঝেমধ্যে মুঠোফোন ব্যবহার করতে দেওয়া হয়। তবে মুঠোফোনে অস্বাভাবিক কোনো কথা বললে কিংবা ঘটনা অন্য কাউকে জানালে তাঁদের ছাদ থেকে ফেলে দেওয়ার হুমকি দেওয়া হয়। শাহিনুর ছাড়াও প্রিমিয়ার ব্যাংকের আরও দুই কর্মকর্তাকে সেখানে আটকে রাখা হয়েছিল।