ফাইল ছবি

ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ বৃদ্ধি আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) চাওয়ার সঙ্গে অসংগতিপূর্ণ। বাংলাদেশকে ৪৫০ কোটি মার্কিন ডলার ঋণ দিতে যেসব খাতের উন্নয়ন চায় আইএমএফ, তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে খেলাপি ঋণ কমানো। কিন্তু ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ না কমে, উল্টো বাড়ছে।

দুই সপ্তাহের সফর শেষে ঢাকা ছেড়ে যাওয়ার আগে গত বুধবার আইএমএফের দল সংবাদ সম্মেলন করে আর্থিক খাতকে শক্তিশালী করার কথা বলে গেছে। আইএমএফ খেলাপি ঋণ কমানোসহ আর্থিক খাতের দুর্বলতা কমানো, তদারকি ব্যবস্থা জোরদার করা, সুশাসন বৃদ্ধি এবং পুঁজিবাজারের উন্নয়নের কথা বলেছে। এ ছাড়া রাজস্ব আয় বৃদ্ধি এবং রাজস্ব প্রশাসনকে ঢেলে সাজানোর পরামর্শও দিয়েছে সংস্থাটি।

একই দিন আলাদা সংবাদ সম্মেলন করেছিলেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল, যেখানে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার। গভর্নর বৈঠকে বলেছিলেন, ‘খেলাপি ঋণের হার ১০ শতাংশের মধ্যে রাখার কথা বলেছে আইএমএফ। তাদের জানানো হয়েছে এ হার ১০ শতাংশের মধ্যেই আছে।’

আইএমএফের সাবেক কর্মকর্তা ও বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘উন্নত দেশগুলোতে খেলাপি ঋণের হার ১ থেকে ২ শতাংশ থাকে। বাংলাদেশের মতো দেশগুলোর জন্য তা ৩ থেকে ৪ শতাংশ থাকাটা সংগত। জানি না কোন বিবেচনায় ১০ শতাংশের প্রসঙ্গটি এসেছে।’

আইএমএফের দলটি চলে যাওয়ার এক সপ্তাহ না যেতেই খবর বেরোল খেলাপি ঋণ বেড়ে এখন দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৩৪ হাজার ৩৯৬ কোটি টাকায়। অথচ গত জুন শেষে তা ছিল ১ লাখ ২৫ হাজার কোটি টাকা। খাতসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, করোনাকালে সরকার ঘোষিত প্রণোদনার অর্থও অনেকে ফেরত দিচ্ছেন না। এত দিন করোনার কারণে বিধিনিষেধ থাকায় তাঁদের খেলাপি হিসেবে চিহ্নিত করা যায়নি। এখন সেই বিধিনিষেধ তুলে দেওয়ায় নতুন করে অনেকে খেলাপি হচ্ছেন।

প্রণোদনা প্যাকেজের আওতায় নেওয়া ঋণের টাকা কি ফেরত দিচ্ছেন না—এমন প্রশ্নের জবাবে খান ব্রাদার্স গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক তোফায়েল কবির খান প্রথম আলোকে বলেন, ‘অন্যদের কথা জানি না। তবে আমরা প্রণোদনা প্যাকেজের টাকা থেকে ৮০ শতাংশ ফেরত দিয়েছি। ডিসেম্বর পর্যন্ত যেহেতু ফেরতের সুযোগ আছে, বাকি ২০ শতাংশও দিয়ে দেব।’

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত ৩০ সেপ্টেম্বর শেষে ব্যাংক খাতে খেলাপির হার দাঁড়িয়েছে ৯ দশমিক ৩৬ শতাংশে। গত জুন শেষে তা ছিল ৮ দশমিক ৯৬ শতাংশ। এরও আগে গত বছরের ডিসেম্বরে ছিল ৭ দশমিক ৯৩ শতাংশ।

অথচ অর্থমন্ত্রী হওয়ার পর পর ২০১৯ সালের জানুয়ারিতে অর্থমন্ত্রী ঘোষণা দিয়েছিলেন, ‘আর এক টাকাও খেলাপি ঋণ বাড়বে না।’ তাঁর ওই ঘোষণার আগে ২০১৮ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত দেশের ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ ছিল ৯৩ হাজার ৯১১ কোটি টাকা।

আর্থিক খাতের উন্নয়ন নিয়ে আইএমএফ বৈঠক করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক, বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি), জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর), অর্থ বিভাগ ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সঙ্গে। সূত্রগুলো জানায়, পুরো ব্যাংক খাতের মধ্যে প্রধানত রাষ্ট্রমালিকানাধীন ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণ পরিস্থিতি নিয়ে আইএমএফের কণ্ঠস্বর বেশি জোরালো।

গত ৩০ জুনের পর থেকে ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত জনতা ব্যাংকের খেলাপি ঋণের হার ২৫ থেকে বেড়ে ২৮ শতাংশ, অগ্রণী ব্যাংকের ১৭ থেকে বেড়ে ১৯ শতাংশ, রূপালী ব্যাংকের ১৭ থেকে বেড়ে ১৭ দশমিক ৫৮ শতাংশ এবং বিডিবিএলের ৩৬ থেকে বেড়ে ৪১ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। সোনালী ব্যাংকের খেলাপির হার আগের মতোই ১৮ শতাংশ এবং বেসিক ব্যাংকের ৫৯ শতাংশ রয়েছে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত সেপ্টেম্বর শেষে রাষ্ট্রমালিকানাধীন ছয় ব্যাংকের মোট খেলাপি ঋণ দাঁড়ায় সাড়ে ৬০ হাজার কোটি টাকার বেশি, যা তিন মাস আগেও ছিল ৫৫ হাজার ৪২৮ কোটি টাকা।

আহসান এইচ মনসুর মনে করেন, খেলাপি ঋণ আরও বাড়বে। কারণ, বাজেট থেকে প্রণোদনা প্যাকেজ দেওয়া হয়েছিল সামান্যই। সরকার ব্যাংকের ঘাড়ে বন্দুক রেখে বেশির ভাগ প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছিল। ফলে একশ্রেণির ঋণগ্রহীতা মনে করছেন এগুলো তো প্যাকেজের টাকা, ঋণের টাকা নয়। এর ফল এখন দেখা যাচ্ছে।