প্রবাসীদের তিন ব্যাংকের একটিতে চেয়ারম্যানই সর্বেসর্বা, আরেকটি তারল্যসংকটে, অন্যটি এমডি–শূন্য

এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংক (এনআরবিসি), গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক (সাবেক এনআরবি গ্লোবাল) ও এনআরবি ব্যাংক

ব্যাংক তিনটি নথিপত্রে প্রবাসীদের (নন–রেসিডেন্ট বাংলাদেশি-এনআরবি) উদ্যোগে গঠিত। তবে দুটির জন্ম নিয়েই রয়েছে নানা বিতর্ক। এখন পরিচালক-চেয়ারম্যানদের অধিকাংশই দেশে স্থায়ীভাবে থাকছেন। কেউ কেউ ব্যাংকে নিয়মিত অফিসও করছেন। পরিচালকদের অনেকেই যেন ব্যাংক পেতেই প্রবাসী সেজেছিলেন। ব্যাংক তিনটি হলো এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংক (এনআরবিসি), গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক (সাবেক এনআরবি গ্লোবাল) ও এনআরবি ব্যাংক।

বিদেশি বিনিয়োগ, প্রবাসী আয় আনাসহ নানা শর্ত দিয়ে ২০১২ সালের ৪ এপ্রিল প্রথমবারের মতো প্রবাসী উদ্যোক্তাদের তিনটি ব্যাংক অনুমোদন দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। অনুমোদনের এক যুগ ও কার্যক্রম শুরুর ১১ বছর অতিক্রম হলেও ব্যাংক তিনটি প্রতিষ্ঠার শর্ত তো পূরণ করছেই না, উল্টো নানা অনিয়মের কারণে ব্যাংক খাতে অস্থিরতা বাড়াচ্ছে।

আরও পড়ুন

এর মধ্যে এনআরবিসি ব্যাংকের অবস্থা প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যানের কারণে খারাপ হওয়ায় নতুন করে আরেক চেয়ারম্যানের হাতে চলে যায়। এখন তিনিই ব্যাংকটির সর্বেসর্বা। ফলে ব্যাংকটির ব্যবস্থাপনা বলতে কিছু নেই।

গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংকটি আলোচিত প্রশান্ত কুমার (পি কে) হালদার ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) হয়ে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে গেছেন, এখনো ব্যাংকটি ভুগছে তারল্যসংকটে। আর এনআরবি ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান ব্যাংকছাড়া। এখন চলছে আরেকটি পক্ষের নিয়ন্ত্রণে। তবে এনআরবি ব্যাংকের আর্থিক অবস্থা, সুশাসন ও সুনাম অন্য দুটির চেয়ে ভালো।

এনজিও হয়ে পড়েছে এনআরবিসি

২০১৩ সালে যাত্রা শুরু করে এনআরবিসি ব্যাংক। ব্যাংকটির প্রতিষ্ঠাকালে চেয়ারম্যান ছিলেন ফরাছত আলী। তাঁর মেয়াদে পরিচালকদের স্বাক্ষর জাল করে ঋণ অনুমোদন, কেন্দ্রীয় ব্যাংককে মিথ্যা তথ্য প্রদান, বেনামি শেয়ারধারণের সুযোগ দেওয়াসহ নানা অভিযোগ ওঠে। মার্কেন্টাইল ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান শহীদুল আহসানকে বেনামে ঋণ দিয়ে ব্যাংকটি বড় ধরনের অনিয়মে জড়ায়। এমনকি পরিচালক না হয়েও নিয়মিত পর্ষদ সভায় অংশ নিতেন শহীদুল আহসান। এর ফলে ফরাছত আলী ও শহীদুল আহসানকে সরিয়ে দেওয়া হয়। পাশাপাশি দুজনকেই ব্যাংক খাতে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে বাংলাদেশ ব্যাংক।

আরও পড়ুন
এস এম পারভেজ তমাল, এনআরবিসি ব্যাংকে চেয়ারম্যান
ছবি: সংগৃহীত

২০১৭ সালের ১০ ডিসেম্বর এনআরবিসি ব্যাংকের পর্ষদ পুনর্গঠন করা হয়। ফরাছত আলীকে সরিয়ে চেয়ারম্যান হন এস এম পারভেজ তমাল। এরপর ব্যাংকটিতে পূর্ণকালীন অফিস করে নতুন রূপ দেওয়ার চেষ্টা করেন তিনি। সূত্র জানায়, ২০১৮ সালের পর ব্যাংকিং অভিজ্ঞতা নেই এমন ব্যক্তিদের ব্যাংকটির শীর্ষ পদে নিয়োগ দেওয়া হয়। কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগ দিতে খোলা হয় আলাদা কোম্পানি। গড়ে তোলা হয়েছে বিশেষ গ্রুপ, যারা ব্যাংকের সব বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়। আবার পরিচালকদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট কোম্পানিতে ঋণ দেওয়া হয়, বাজেয়াপ্ত শেয়ার কেনা ও ব্যাংকের উপশাখার সব ব্যবসা এনজিও এসকেএস ক্ষুদ্রঋণ প্রকল্পনির্ভর করে ফেলা হয়। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের শীর্ষ এক কর্মকর্তার নিকটাত্মীয়কে নিয়োগ দেওয়া হয় শীর্ষ পদে। ফলে নানা অনিয়মের বিষয়ে ব্যাংকটির বিরুদ্ধে বাংলাদেশ ব্যাংকও কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এক কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, এনআরবিসি ব্যাংকের কোনো বিষয়ে খবর নিতে গেলেই এখন একরকম হুমকি দেওয়া হয়। এখন ব্যাংকটির বিষয়ে খোঁজখবর নেওয়ারও অনুমতি মেলে না শীর্ষ পর্যায় থেকে।

বাংলাদেশ ব্যাংক ২০২১ সালে উত্তরবঙ্গে ১৩১টি উপশাখা চালুর অনুমোদন দেয় এনআরবিসিকে। এরপর ব্যাংকটি উপশাখার বদলে ‘পার্টনারশিপ উপশাখা’ নামক হাইব্রিড পদ্ধতি চালু করে। পাশাপাশি সহযোগী হিসেবে শুধু এসকেএস ফাউন্ডেশনকে নির্বাচিত করে। দরপত্র আহ্বান ছাড়াই এসকেএস ফাউন্ডেশনের ১৩১টি টিনশেড বা সেমিপাকা ভবনে উপশাখা চালুর উদ্যোগ নেওয়া হয়। আর এসব উপশাখার সাজসজ্জার কাজ করানো হয় নিজেদের পছন্দের কোম্পানিকে দিয়ে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিদর্শনেই বিষয়টি উঠে আসে।

আরও পড়ুন

গত ডিসেম্বর পর্যন্ত এসকেএস প্রকল্পের মাধ্যমে ব্যাংকটির বিতরণ করা ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৩ হাজার ৩৪৩ কোটি টাকা। এ ছাড়া এসকেএস ফাউন্ডেশন, এসকেএস ইন, এসকেএস হাসপাতালসহ অন্যান্য অঙ্গপ্রতিষ্ঠানের নামে ব্যাংকের বিভিন্ন শাখা-উপশাখা থেকে ২০২ কোটি টাকার ঋণ দেওয়া হয়। তাই ব্যাংকের গ্রাহক হয়ে এসকেএস কীভাবে ব্যাংকের উপশাখার ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে, এ নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। এ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ব্যাংকটি এনজিও–নির্ভর হয়ে পড়েছে।

ব্যাংকটির শাখা এখন ১৩১টি ও উপশাখা ৬৪১টি। ২০২৩ সাল শেষে ব্যাংকের আমানত ছিল ১৭ হাজার ৬১৩ কোটি টাকা আর ঋণ ১৪ হাজার ৪২৫ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপি ঋণ ৬৬৬ কোটি টাকা বা ৪ দশমিক ৬২ শতাংশ।

গত ২৫ মার্চ এনআরবিসি ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ে গেলে দেখা যায়, ব্যাংকটির চেয়ারম্যান এস এম পারভেজ তমাল অফিস করছেন। ব্যাংকটির জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তারা তাঁর কাছে ফাইল নিয়ে যাচ্ছেন। প্রথম আলোর পক্ষ থেকে জানতে চাওয়া হয়, আজ কি ব্যাংকে আপনার কোনো সভা আছে, কেন এসেছেন? জবাবে পারভেজ তমাল বলেন, ‘না, কোনো সভা নেই। আমি না এলে ব্যাংকের কোনো কাজ হয় না। আমি ব্যাংকে না থাকলে সবাই আগেভাগে ব্যাংক থেকে বের হয়ে যান। নতুন ব্যাংক হওয়ায় যোগ্য ও দক্ষ জনবল আমরা পাইনি। যাঁরা ব্যাংকটি চালিয়ে নিতে পারবেন। এ জন্য আসতেই হচ্ছে।’ তাহলে চেয়ারম্যানই কি ব্যাংক চালাচ্ছেন, এর জবাবে চেয়ারম্যান বলেন, ‘না, ব্যাংক এমডি চালান। আমরা শুধু পরামর্শ দিয়ে থাকি।’

আরও পড়ুন

পরিচালক–সংশ্লিষ্ট ঋণ ও এনজিও–নির্ভর উপশাখা নিয়ে পারভেজ তমাল বলেন, ‘আমি কোনো ঋণের মধ্যে নেই। অন্য পরিচালকের দায় আমার নয়। তবে এসব ঋণের বেশির ভাগ নিয়মিত আছে। বিদেশে যেসব রপ্তানি বিল আটকে ছিল, তা–ও ফেরত এসেছে। উপশাখার মাধ্যমে আমরা দ্রুত সারা দেশে সেবা পৌঁছে দিতে পেরেছি। এটা না থাকলে সারা দেশে পৌঁছানো সম্ভব হতো না।’

এনআরবিসি ব্যাংক যে উদ্দেশ্যে অনুমোদন, সেটা কি করছে—এর জবাবে ব্যাংকটির চেয়ারম্যান বলেন, বিনিয়োগ আনতে না পারলেও প্রবাসী আয় আসছে। আবার রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের পাঁচ ঠিকাদারের অর্থ আসছে আমাদের মাধ্যমে।

পি কে–তে ফেঁসে গেছে গ্লোবাল ইসলামী

২০১৩ সালে যাত্রা শুরু করা গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংকের চেয়ারম্যান প্রবাসী নিজাম চৌধুরী হলেও এটির সিংহভাগ মালিকানা ও নিয়ন্ত্রণ এস আলম গ্রুপের হাতে। ব্যাংকটির ৮০ শতাংশ পরিচালকই এস আলম গ্রুপের মালিকের পরিবারের সদস্য ও কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। এই ব্যাংকে ২০১৫ সালে ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) হিসেবে যোগ দেন প্রশান্ত কুমার (পি কে) হালদার। পি কে হালদার বিদেশে পালিয়ে গেলে ব্যাংকটি নাম পরিবর্তন হয়ে গ্লোবাল ইসলামী হয়ে যায়, পাশাপাশি প্রচলিত ধারা থেকে শরিয়াহ ব্যাংকে রূপান্তরিত হয়। এ সময় বাংলাদেশ ব্যাংকের এক পরিদর্শনে ব্যাংকটির বেশির ভাগ ঋণখেলাপিযোগ্য বলে প্রতিবেদনে উঠে আসে।

গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংকের এমডি সৈয়দ হাবিব হাসনাত
ছবি: সংগৃহীত

ব্যাংক–সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানায়, পি কে হালদার চলে যাওয়ার পর নতুন করে বড় কোনো ঋণ দেয়নি ব্যাংকটি। তবে পি কে হালদারের দেওয়া ঋণও আদায় হচ্ছে না। এখন ক্ষুদ্র, মাঝারি ও কৃষিঋণ দিয়ে চলছে ব্যাংকটি। পাশাপাশি এক বছর ধরে তারল্যসংকটে ভুগছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সঙ্গে থাকা ব্যাংকটির হিসাব ঋণাত্মক অবস্থায় পড়েছে। তারপরও বিশেষ ব্যবস্থায় ব্যাংকটির লেনদেন চালু রেখেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

২০১৯ সালে ব্যাংকটির ঋণ ছিল ৮ হাজার ২৩৬ কোটি টাকা। এরপর গত বছর শেষে ঋণ বেড়ে হয়েছে ১৩ হাজার ১০৩ কোটি টাকা, এর মধ্যে খেলাপি ২২৫ কোটি টাকা ১ দশমিক ৭২ শতাংশ। ব্যাংকটির শাখা এখন ১০১টি ও উপশাখা ১৩৬টি।

গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংকের এমডি সৈয়দ হাবিব হাসনাত সম্প্রতি প্রথম আলোকে বলেন, ‘এখন আমরা ছোট ঋণ ছাড়া অন্য কোনো ঋণ দিচ্ছি না। খরচ কমিয়ে এনে ব্যাংকের স্বাস্থ্য ঠিক করার চেষ্টা করে যাচ্ছি। নানা নেতিবাচক প্রচারণার কারণে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সঙ্গে থাকা হিসাবে মাঝেমধ্যে ঘাটতি হচ্ছে। তবে আমরা চেষ্টা করে যাচ্ছি আমানত বাড়িয়ে এই পরিস্থিতি থেকে বের হয়ে আসার।’

দক্ষ ব্যবস্থাপনার অভাব এনআরবিতে

প্রবাসীদের উদ্যোগে গঠিত তিন ব্যাংকের মধ্যে একমাত্র এনআরবি ব্যাংকের বেশির ভাগ উদ্যোক্তা বিভিন্ন দেশে প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী। পাশাপাশি এই ব্যাংকে যে মূলধন, তা বিদেশ থেকে আসে। ফলে শুরু থেকে ব্যাংকটি নিয়ে উচ্চাশা ছিল। তবে দক্ষ ব্যবস্থাপনার অভাবে ব্যাংকটি সেভাবে দাঁড়াতে পারেনি। পাশাপাশি প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান ইকবাল আহমেদ ওবিই ব্যাংকটি ছাড়ার পর এখন সেটি একটি পক্ষের নিয়ন্ত্রণে চলে গেছে। পরিচালকদের কেউ কেউ ব্যাংকে নিয়মিত অফিস করে দৈনন্দিন কাজে হস্তক্ষেপ করছেন। এর মধ্যে ব্যাংকটির এমডি মেয়াদ শেষের আগেই পদত্যাগ করেন।

সাকির আমিন চৌধুরী, এনআরবি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (চলতি দায়িত্ব)
ছবি: সংগৃহীত

গত বছর শেষে এনআরবি ব্যাংকের আমানত ছিল ৬ হাজার ৭০০ কোটি টাকা ও ঋণ ৬ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপি ২৯৯ কোটি টাকা বা ৫ শতাংশ। শাখা ও উপশাখা আছে ৮০টি।

ব্যাংকটির বিষয়ে কথা বলতে সম্প্রতি এনআরবি ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ে গেলে ব্যবস্থাপনা পরিচালক (চলতি দায়িত্ব) সাকির আমিন চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, ‘নাম এনআরবি হলেও অন্য সব ব্যাংকের মতো আমরা সেবা দিয়ে যাচ্ছি। এ জন্য প্রতিযোগিতা করতে হচ্ছে অন্য সব ব্যাংকের সঙ্গে। আমাদের ৬০ শতাংশ ঋণ করপোরেট খাতে ও ৩০ শতাংশ ক্ষুদ্র ও মাঝারি খাতে। আমরা চেষ্টা করে যাচ্ছি সুশাসন বজায় রেখে ব্যাংকের সেবা বাড়ানোর।’