কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নীতি সুদেই ঠিক হবে সব সুদ, আইএমএফের পরামর্শ

আইএমএফ নিট রিজার্ভ রাখার যে শর্ত কেন্দ্রীয় ব্যাংককে দিয়েছিল, তাতেও পরিবর্তন আনতে পারে সংস্থাটি। এটিই অন্যতম শর্ত, যা অর্জন করা সম্ভব হয়নি। 

বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতি সুদহারই ব্যাংকিং খাতের সব ধরনের লেনদেনের সুদহার নির্ধারণ করবে, এমন পরামর্শ দিয়েছে ঢাকা সফররত আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) একটি প্রতিনিধিদল। 

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সূত্রগুলো জানিয়েছে, আইএমএফের পরামর্শ মানা হলে সুদহার নির্ধারণের বর্তমান পদ্ধতি স্মার্ট বা সিক্স মান্থস মুভিং অ্যাভারেজ রেট অব ট্রেজারি বিল বাতিল হয়ে যেতে পারে। প্রতি মাসের শুরুতে এই হার জানিয়ে দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এর ভিত্তিতে বর্তমানে ঋণের সুদহার নির্ধারণ হচ্ছে। 

গতকাল আইএমএফ প্রতিনিধিদলের সঙ্গে কেন্দ্রীয় ব্যাংক কর্মকর্তাদের যে বৈঠক হয়েছে, তাতে আলোচনার অন্যতম বিষয় ছিল ডলারের দাম নির্ধারণে ‘ক্রলিং পেগ’ পদ্ধতি চালু। বিশেষ করে এই পদ্ধতিতে ডলারের মধ্যবর্তী দাম কত হবে, এই বিষয়টি। বর্তমানে বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে ডলারের দাম ১১০ টাকা হলেও ব্যাংকগুলো ডলার লেনদেন করছে ১১৫-১১৬ টাকা দরে। 

বাংলাদেশ ব্যাংকের দুজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, আইএমএফের সঙ্গে গভর্নরের মূল আলোচনা এ মাসেই ওয়াশিংটনে হয়েছে। তবে ঢাকায় যেসব বৈঠক হচ্ছে, তাতে আলোচনার মূল বিষয় হতে পারে ডলারের দাম নির্ধারণের নতুন পদ্ধতি এবং বিভিন্ন সুদহারকে আরও বাজারমুখী করতে প্রয়োজনীয় নীতি গ্রহণ। পাশাপাশি আইএমএফ নিট রিজার্ভ রাখার যে শর্ত কেন্দ্রীয় ব্যাংককে দিয়েছিল, তাতেও পরিবর্তন আনতে পারে সংস্থাটি। কারণ এটিই অন্যতম শর্ত, যা অর্জন করা সম্ভব হয়নি। 

১৭ এপ্রিলের হিসাবে বাংলাদেশ ব্যাংকের মোট রিজার্ভ ছিল ২ হাজার ৫৩০ কোটি ডলার। অন্যদিকে আইএমএফের হিসাব পদ্ধতি বিপিএম ৬ অনুযায়ী রিজার্ভ ছিল ১ হাজার ৯৮৪ কোটি ডলার। তবে জানা গেছে, প্রকৃত বা ব্যবহারযোগ্য রিজার্ভ ছিল ১ হাজার ৫০০ কোটি ডলারের কম, যা দিয়ে তিন মাসের বেশি আমদানি দায় মেটানো যাবে না। 

২০২২ সালের শুরুতে ডলারের সংকট শুরু হওয়ার পর বাংলাদেশ আইএমএফের কাছে ঋণের জন্য আবেদন করে। ২০২৩ সালের শুরুতে সংস্থাটি ৪৭০ কোটি ডলার ঋণ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। তবে এ ক্ষেত্রে নানা শর্তও জুড়ে দেওয়া হয়। ২০২৬ সাল পর্যন্ত মোট সাত কিস্তিতে পাওয়া যাবে এ অর্থ। বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা যায়, এবার আইএমএফের প্রতিনিধিদলের নেতৃত্ব দিচ্ছেন সংস্থাটির গবেষণা বিভাগের উন্নয়ন ও সামষ্টিক অর্থনীতি বিভাগের কর্মকর্তা ক্রিস পাপাজর্জিও। প্রতিনিধিদলটি গতকাল বাংলাদেশ ব্যাংকের বিভিন্ন বিভাগের সঙ্গে পৃথক পৃথক সভা করে। এতে বিভিন্ন পর্যায়ে ডেপুটি গভর্নররাও যোগ দেন। 

সভাগুলোতে আইএমএফ জানতে চায় যেসব শর্ত দেওয়া হয়েছিল, তা কতটা অর্জিত হয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পক্ষ থেকে অর্থনীতির নানা সূচকের তথ্য তুলে ধরা হয়। 

সূত্রগুলো জানিয়েছে, সব ব্যাংক বিল-বন্ডের বিপরীতে চাহিদামতো স্পেশাল রেপো বা স্ট্যান্ডিং ল্যান্ডিং ফ্যাসিলিটি থেকে অর্থ পাবে, গত মার্চ মাসের মধ্যে এ-সংক্রান্ত একটি প্রজ্ঞাপন জারির কথা ছিল। একটি সভায় আইএমএফ প্রতিনিধিদলটি এ বিষয়ে জানতে চেয়েছিল। জবাবে বাংলাদেশ ব্যাংক জানায়, এখন ব্যাংকগুলোর চাহিদার ভিত্তিতে শতভাগ অর্থ সুবিধা দেওয়া না হলেও ৮০-৯০ শতাংশ পর্যন্ত সুবিধা দেওয়া হচ্ছে। 

সূত্রগুলো আরও জানিয়েছে, ব্যাংকগুলোকে প্রতিদিন যে টাকা ধার (রেপো) দেওয়া হয়, তা দৈনিকের পরিবর্তে সাপ্তাহিক ভিত্তিতে চালু করার পরামর্শ দিয়েছে আইএমএফ। এর ফলে ব্যাংকগুলোর ট্রেজারি ব্যবস্থাপনা আরও বাজারভিত্তিক হবে বলে মনে করছে সংস্থাটি। এ ছাড়া শুধু নীতি সুদহার বহাল রেখে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অন্যান্য ধরনের সুদহার উঠিয়ে দেওয়ার পক্ষে মতামত দিয়েছে সংস্থাটি। আইএমএফ মনে করে, এতে তারল্য ব্যবস্থাপনা আরও বাজারভিত্তিক হবে এবং বাজারের ওপর নির্ভর করে নির্ধারিত হবে সব ধরনের সুদহার। 

প্রতিনিধিদলটি ডলারের দাম নির্ধারণে ‘ক্রলিং পেগ’ পদ্ধতি চালু নিয়েও আলোচনা করেছে। সূত্রগুলো বলছে, ডলারের মধ্যবর্তী দাম কত হবে, সেটি এখন মূল আলোচনার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা ডলারের মধ্যবর্তী দাম ১১০ টাকা রাখার পক্ষে, তবে বাজারে ডলার ১১৫-১১৬ টাকা দরে লেনদেন হওয়ায় আইএমএফ মনে করে যে সেটিই মধ্যবর্তী দাম হওয়া উচিত। 

আইএমএফের সঙ্গে সভা নিয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র মেজবাউল হক প্রথম আলোকে বলেন, কিস্তি ছাড়ের আগে পর্যালোচনার জন্য এসেছেন সংস্থাটির কর্মকর্তারা। তাঁদের সফর চলবে আগামী ৮ মে পর্যন্ত। সভাগুলোর পরিপ্রেক্ষিতে যেসব সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে, তা তাঁরা জানিয়ে দেবেন।