অর্থ পাচার মামলা বাদ চায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক

  • বৈদেশিক মুদ্রা নিয়ন্ত্রণ আইনে মামলা হচ্ছে হাজার হাজার, কিন্তু নিষ্পত্তি হয় না। আদালতও এ ধরনের মামলা আমলে নিতে অসম্মতি জানান।

  • ৯৭৬টি রপ্তানি বিলের মূল্য দেশে ফেরত আসেনি।

  • ২০১৩ সাল পর্যন্ত ১১০০ মামলা বিচারাধীন।

  • ২০১৩-২০১৮ সাল পর্যন্ত প্রত্যাবাসন না হওয়া এবং বিল অব এন্ট্রি সমন্বিত না হওয়ার ঘটনা ৩০২৫টি।

দেশে পণ্য আমদানির আড়ালে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা বিদেশে পাচার হচ্ছে। আবার বিদেশে পণ্য রপ্তানির প্রচুর অর্থও দেশে প্রত্যাবাসন হচ্ছে না, অর্থাৎ আসছে না। এ নিয়ে বিদ্যমান বৈদেশিক মুদ্রা নিয়ন্ত্রণ আইন, ১৯৪৭-এর আওতায় মামলাও হচ্ছে হাজার হাজার। কিন্তু নিষ্পত্তি হচ্ছে না। এ ধরনের মামলা আদালত আমলে নিতে অসম্মতি জানাচ্ছেন।

বাংলাদেশ ব্যাংক গত নভেম্বর ও ডিসেম্বর মাসে অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগকে এমন তথ্য জানিয়ে তিন দফা চিঠি দিয়েছে। মামলা নিষ্পত্তি না হওয়ার অন্যতম কারণ চিহ্নিত করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলেছে, পুরোনো ঘটনাগুলো বাদ দিতে হবে এবং বৈদেশিক মুদ্রা নিয়ন্ত্রণ আইনের অধীনে একটি প্রজ্ঞাপন জারি করতে হবে। প্রজ্ঞাপন জারি হলেই আদালত মামলাগুলো আমলে নিতে পারবেন।

বাংলাদেশ ব্যাংক আরও বলেছে, পুরোনো মামলাগুলোর রায় পক্ষে আনতে প্রমাণের দরকার। তা বর্তাবে মামলা দায়েরকারী বাংলাদেশ ব্যাংকের ওপর, যা প্রচুর সময় ও অর্থ ব্যয়সাপেক্ষ। অপরাধ প্রমাণের জন্য প্রয়োজনীয় তথ্যপ্রমাণ যথাযথভাবে পাওয়া যাবে কি না সন্দেহ। তাই কেন্দ্রীয় ব্যাংক মনে করছে, ১২ বছর আগের ঘটনার ক্ষেত্রে মামলা করে কোনো প্রতিকার পাওয়া যাবে না।

বিষয়টি এত দিন কারও নজরে আসেনি, তা অবাক করার বিষয়। মনে হচ্ছে, প্রশাসনিক দুর্বলতার কারণেই এমনটি হয়েছে।
ইফতেখারুজ্জামান, নির্বাহী পরিচালক, টিআইবি।

বাংলাদেশ ব্যাংক চায়, একটি নির্দিষ্ট তারিখের পর থেকে ভবিষ্যতের একটি নির্দিষ্ট তারিখ পর্যন্ত সময় বেঁধে দিয়ে প্রজ্ঞাপন জারি হোক। সে ক্ষেত্রে ভূতাপেক্ষ তারিখের আগের অপরাধ নিয়ে কোনো মামলা করা যাবে না এবং সেগুলো তখন নিষ্পত্তি করা বলে গণ্য হবে।

আইনজীবীর মতামত নিয়ে আমরা সমস্যাটা সমাধানের বিষয় আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগকে জানিয়েছি। শিগগিরই একটা প্রজ্ঞাপন জারি হবে বলে আশা করছি।
মো. সিরাজুল ইসলাম, মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক

জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক মো. সিরাজুল ইসলাম বলেন, ‘একসময় দুর্নীতি দমন ব্যুরো এবং পরে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) বিষয়গুলো দেখত। আইনজীবীর মতামত নিয়ে আমরা সমস্যাটা সমাধানের বিষয় আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগকে জানিয়েছি। শিগগিরই একটা প্রজ্ঞাপন জারি হবে বলে আশা করছি।’

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের চিঠি অনুযায়ী করণীয় নির্ধারণে সচিবালয়ে ১৭ জানুয়ারি আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের অতিরিক্ত সচিব এ বি এম রুহুল আজাদের সভাপতিত্বে একটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে বাংলাদেশ ব্যাংক, দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক), মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ, বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইনটেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ), আইন ও বিচার বিভাগ, লেজিসলেটিভ ও সংসদবিষয়ক বিভাগ এবং স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের প্রতিনিধিরা অংশ নেন।

বিল অব এন্ট্রি হচ্ছে এমন দলিল, যা শুল্ক দপ্তর ইস্যু করে এবং তাতে পণ্যের উৎস ও গন্তব্য দেশ, পণ্যের পরিমাণ, ধরন, মূল্যসহ বিভিন্ন তথ্য উল্লেখ থাকে।

জানা গেছে, বাংলাদেশ ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ যৌথভাবে প্রজ্ঞাপনের একটি খসড়াও দাঁড় করিয়েছে। তাতে বলা হয়েছে, বৈদেশিক লেনদেন-সংশ্লিষ্ট অপরাধ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালত কর্তৃক আমলযোগ্য হবে। অর্থাৎ রপ্তানিপণ্যের মূল্য প্রত্যাবাসন না হওয়া এবং বিল অব এন্ট্রি দাখিল না হওয়ার বিষয়গুলো আমলে নেবেন আদালত।

আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের অতিরিক্ত সচিব এ বি এম রুহুল আজাদ গত সোমবার প্রথম আলোকে বলেন, প্রজ্ঞাপন জারি এখন চূড়ান্ত পর্যায়ে।

বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, স্বাধীনতার পর থেকে ২০১৪ সালের জুলাই পর্যন্ত বৈদেশিক মুদ্রা নিয়ন্ত্রণ আইন লঙ্ঘনের মাধ্যমে ১ হাজার ৩৯০টি বিল অব এন্ট্রি মেয়াদোত্তীর্ণ হয়েছে।

বিল অব এন্ট্রি হচ্ছে এমন দলিল, যা শুল্ক দপ্তর ইস্যু করে এবং তাতে পণ্যের উৎস ও গন্তব্য দেশ, পণ্যের পরিমাণ, ধরন, মূল্যসহ বিভিন্ন তথ্য উল্লেখ থাকে। একই সময়ে ৯৭৬টি রপ্তানি বিলের মূল্য প্রত্যাবাসিত হয়নি, অর্থাৎ ওই রপ্তানির অর্থ দেশে ফেরত আসেনি।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের চিঠিতে আরও বলা হয়েছে, ২০১৩ সাল পর্যন্ত এ ধরনের বিচারাধীন মামলার সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ১০০। এ ছাড়া ২০১৩-২০১৮ সাল পর্যন্ত প্রত্যাবাসন না হওয়া এবং বিল অব এন্ট্রি সমন্বিত না হওয়ার ঘটনা রয়েছে আরও ৩ হাজার ২৫টি। দিন দিন এ ধরনের ঘটনা বাড়ছে। এই অপরাধের বিচারের জন্য লেজিসলেটিভ ও সংসদবিষয়ক বিভাগ যাতে একটি প্রজ্ঞাপন জারি করে, তা বলতে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগকে অনুরোধ করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক।

চিঠিতে বাংলাদেশ ব্যাংক বলেছে, ভূতাপেক্ষ প্রয়োগসহ ২০০৫ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ২০২৫ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত সময়ের জন্য প্রজ্ঞাপন জারি হতে পারে। এর পেছনে যুক্তিগুলো হচ্ছে, পুরোনো মামলা প্রমাণের প্রয়োজনীয় কাগজপত্র ও তথ্যপ্রমাণ না পাওয়া; প্রতিষ্ঠানের অস্তিত্ব না থাকা; দায়ী ব্যক্তিদের খুঁজে না পাওয়া; মামলা তদন্তের জন্য সরকারি প্রতিষ্ঠানের শ্রম ও অর্থ ব্যয়; মামলা পরিচালনার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের অর্থ, কর্মঘণ্টা ও শ্রম ব্যয় ইত্যাদি।

তবে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, ‘বিষয়টি এত দিন কারও নজরে আসেনি, তা অবাক করার বিষয়। মনে হচ্ছে, প্রশাসনিক দুর্বলতার কারণেই এমনটি হয়েছে। তবে দেরিতে হলেও যেহেতু সমস্যা চিহ্নিত হয়েছে, এখন প্রজ্ঞাপন জারি হতে দেরি না হলেই হলো।’