অসহায় পরিবারটি কি তবে বাড়িটিও হারাবে

ঋণগ্রহীতা মারা গেছেন। অসুস্থ স্ত্রী ও দুই মেয়ে মিলে ঋণ পরিশোধের চেষ্টা করছিলেন। এর মধ্যে এক মেয়ে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে মারা যান। ফলে করোনার মধ্যে বন্ধ হয়ে যায় কিস্তি পরিশোধ। এখন গ্রাহকের একমাত্র সম্বল বাড়িটি নিলামে তুলে বিক্রির উদ্যোগ নিয়েছে ব্যাংক। যদিও আরেক মেয়ে ঋণের কিছু টাকা পরিশোধ করেছেন। আরও টাকা পরিশোধের জন্য ব্যাংকে ঘুরছেন। তবে ব্যাংকটি টাকা গ্রহণ করছে না। এমন ঘটনা ঘটেছে পটুয়াখালী জেলা শহরে, উত্তরা ব্যাংকের পটুয়াখালী শাখায়।

বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে এমন একটি অভিযোগ জমা পড়েছে। সেই ঘটনার বিষয়ে উত্তরা ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ের কাছে ব্যাখ্যা চেয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। গ্রাহকের অভিযোগ ও ব্যাংকের নথিপত্র পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, সরকারের সাবেক সহকারী সচিব মো. মহিউদ্দিন ২০১৮ সালের নভেম্বরে উত্তরা ব্যাংকের পটুয়াখালী শাখা থেকে গৃহঋণ বাবদ ২৫ লাখ টাকা নেন। সেই ঋণের মেয়াদ শেষ হবে ২০২৬ সালে। এই ঋণের টাকায় গ্রাহক পটুয়াখালী জেলার কলাতলায় গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষের ২ হাজার ৩৮০ বর্গফুট জায়গার ওপর বাড়ি নির্মাণ শুরু করেন। তবে কাজ অসমাপ্ত থাকা অবস্থায় ২০১৯ সালের এপ্রিলে মো. মহিউদ্দিন হৃদ্‌রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। মৃত্যুর আগে তিনি নিয়মিত কিস্তি প্রদান করেন।

বাড়িটির দিকে নজর পড়েছে ব্যাংকের। টাকা জমা দিলেও তা হিসাবে দেখানো হচ্ছে না। এখন টাকাও জমা নিচ্ছে না। গত দুই বছরে বাবা ও বোনকে হারিয়েছি। এখন বাড়িটি হারানোর পথে।
প্রয়াত মো. মহিউদ্দিনের মেয়ে উম্মে সালমা নাসরিন

মৃত্যুর পর তাঁর স্ত্রী হামিদা বেগম উত্তরাধিকার হিসেবে ঋণের দায়িত্ব নেন। ব্যাংককে জানান, গ্রাহক মারা যাওয়ায় কিস্তি দিতে বিলম্ব হচ্ছে। এ জন্য সুদ মওকুফ ও পরিশোধের মেয়াদ বাড়ানোর আবেদন করেন। পেনশনের টাকা পাওয়া সময়সাপেক্ষ হওয়ায় এর মধ্যে কিস্তি অনিয়মিত হয়ে পড়ে। এরপরও ২০১৯ সালের জুনে ৪৫ হাজার টাকা জমা দেন। স্বামীর মৃত্যুর পর স্ত্রী হামিদা বেগমও অসুস্থ হয়ে পড়েন। তিনি ২০১৯ সালের জুলাইয়ে ব্যাংকের কাছে দেওয়া এক আবেদনে জানান, ঋণের পুরো টাকা বাড়ি নির্মাণের পেছনে ব্যয় করা হয়েছে। স্বামী মারা যাওয়ায় আয়ের পথও বন্ধ হয়ে গেছে। এ অবস্থায় তিনি সুদ মওকুফ ও ঋণ পরিশোধের সময় বৃদ্ধির আবেদন করেন।

কিন্তু ২০১৯ সালের ২৪ নভেম্বর হামিদা বেগমকে ব্যাংকের পক্ষ থেকে জানানো হয়, তাঁর করা আবেদনটি নাকচ করা হয়েছে। এরপর ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে ঋণের কিস্তি বাবদ ৫ হাজার টাকা ও গত বছরের জানুয়ারিতে ২ হাজার টাকা প্রদান করা হয়। এরপর গত বছরের ৮ মার্চ ৫০ হাজার টাকা কিস্তি পরিশোধ করা হয়। কিন্তু ব্যাংকের পক্ষ থেকে গত বছরের ৯ মার্চ কিস্তি জমার জন্য উকিল নোটিশ পাঠানো হয়। নোটিশে বলা হয়, কিস্তি জমা না দিলে বন্ধক রাখা বাড়ি নিলামে তোলা হবে।

ওই নোটিশ দেওয়ার পরের মাস অর্থাৎ গত বছরের এপ্রিলে দেশে করোনার সংক্রমণ বেড়ে যায়। তাতে ঋণের কিস্তি পরিশোধে ছাড় দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। গ্রাহকের অভিযোগ, এরপরও ব্যাংক থেকে ভয়ভীতি দেখানো হয়। এর মধ্যে প্রয়াত মো. মহিউদ্দিনের এক মেয়ে উম্মে হাফসা রুনা ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে ২০২১ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি মারা যান। এতে পরিবারটি ভয়াবহ আর্থিক সংকটে পড়ে।

চলতি বছরের এপ্রিলে ঋণ পরিশোধে দ্বিতীয় দফা উকিল নোটিশ পাঠায় ব্যাংক। যদিও চলতি বছরের মার্চ থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত গ্রাহকের পক্ষ থেকে কিস্তি বাবদ ৩ লাখ টাকা পরিশোধ করা হয়। এর মধ্যে গত সেপ্টেম্বরে গ্রাহকের বন্ধক রাখা বাড়িটি নিলামে তোলার নোটিশ দেয় ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট শাখা। আগামীকাল মঙ্গলবার ওই বাড়ির নিলাম অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে। এখন ব্যাংকে টাকা জমা দিতে গেলেও শাখাটি আর তা গ্রহণ করছে না।

মো. মহিউদ্দিনের আরেক মেয়ে উম্মে সালমা নাসরিন প্রথম আলোকে বলেন, ‘বাড়িটির দিকে নজর পড়েছে ব্যাংকের। টাকা জমা দিলেও তা হিসাবে দেখানো হচ্ছে না। এখন টাকাও জমা নিচ্ছে না। গত দুই বছরে বাবা ও বোনকে হারিয়েছি। এখন বাড়িটি হারানোর পথে।’

এ নিয়ে উত্তরা ব্যাংকের পটুয়াখালী শাখার ব্যবস্থাপকের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। এ বিষয়ে প্রশ্ন করার পর ওই প্রান্ত থেকে সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হয়। পরে আবার ওই নম্বরে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলে মোবাইল বন্ধ পাওয়া যায়। পরে এ বিষয়ে জানতে উত্তরা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়। কিন্তু তিনি ফোন ধরেননি।