আরেক ব্যাংককে জরিমানা

দীর্ঘ তদন্ত শেষে এনআরবি ব্যাংককে ৪৯ লাখ ৫০ হাজার টাকা জরিমানা করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক।

বিমা খাতের কোম্পানি পাইওনিয়ার ইনস্যুরেন্সের প্রতিটি শেয়ারের দাম গত মার্চে ছিল ৬৪ টাকা। এরপর অস্বাভাবিক উত্থানের ফলে ১৪ জুন সেই দাম বেড়ে দাঁড়ায় ২০৯ টাকায়। কোম্পানিটির শেয়ারের অস্বাভাবিক উত্থানে বড় ভূমিকা রেখেছেন বেসরকারি খাতের এনআরবি ব্যাংকসহ কয়েকজন বিনিয়োগকারী। ব্যাংক কোম্পানি আইনের সীমা লঙ্ঘন করে পাইওনিয়ার ইনস্যুরেন্সের শেয়ারে বিনিয়োগ করে ব্যাংকটি।

সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংক শেয়ারবাজারে ব্যাংকটির বিনিয়োগের ক্ষেত্রে অনিয়ম পেয়েছে। এ জন্য তদন্ত শেষে এনআরবি ব্যাংককে ৪৯ লাখ ৫০ হাজার টাকা জরিমানা করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এ ছাড়া শেয়ারে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে আইন লঙ্ঘনের দায়ে অভিযুক্ত ব্যাংকটির প্রধান অর্থ কর্মকর্তা (সিএফও) কামরুল হাসানকে পদ থেকে সরিয়ে দিয়েছে এনআরবি ব্যাংক।

বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, পাইওনিয়ার ইনস্যুরেন্সের বাজারে লেনদেনযোগ্য শেয়ারের বড় অংশই কিনে নেয় ব্যাংকটি। এতে বাজারে কৃত্রিম সংকট তৈরি হয়। তাতে হু হু করে দাম বাড়তে থাকে। তাতে পাইওনিয়ার ইনস্যুরেন্সের শেয়ার থেকে ২৪ কোটি টাকা অবিক্রীত মুনাফাও করে ব্যাংকটি। কয়েক দফায় শেয়ারটি কেনাবেচা করে মুনাফা করলেও বড় অঙ্কের শেয়ার অবিক্রীত থেকে গেছে। এর মধ্যে দামও কমতে থাকে। তাতে জুন শেষে অবিক্রীত থাকা শেয়ারে ব্যাংকের লোকসান হয় ৩৫ কোটি ৭৩ লাখ টাকা। পাইওনিয়ার ইনস্যুরেন্সের শেয়ার দাম গতকাল বৃহস্পতিবার কমে হয়েছে ১৩০ টাকা, যা মার্চের দ্বিগুণ।

এনআরবি ব্যাংকের আগে শেয়ারবাজারে নির্ধারিত সীমার বেশি বিনিয়োগ করার দায়ে চতুর্থ প্রজন্মের এনআরবি কমার্শিয়াল (এনআরবিসি) ব্যাংককে ২৩ লাখ ৫০ হাজার টাকা জরিমানা করেছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। আরও কয়েকটি ব্যাংককে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে এমন ব্যাংকও রয়েছে, যারা পরিচালকদের মালিকানাধীন কোম্পানির শেয়ারে সীমার বেশি বিনিয়োগ করেছে। এসব ব্যাংককেও জরিমানা করার বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন আছে বলে জানিয়েছেন কেন্দ্রীয় ব্যাংক কর্মকর্তারা।

এনআরবি ব্যাংককে জরিমানাসংক্রান্ত কেন্দ্রীয় ব্যাংকের চিঠিতে বলা হয়েছে, শেয়ারবাজারে পাইওনিয়ার ইনস্যুরেন্সের শেয়ারে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে ব্যাংক কোম্পানি আইনের ২৬ক(১) ধারার নির্দেশনা লঙ্ঘনের বিষয়ে ব্যাংকের ব্যাখ্যা গ্রহণযোগ্য হয়নি। তাই আইনের ২৬ক(৩) ধারার আওতায় ৪৯ লাখ ৫০ হাজার টাকা জরিমানা আরোপ করা হলো। তিন দিনের মধ্যে জরিমানা জমা দিতে বলেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। তা না হলে বাংলাদেশ ব্যাংকের মতিঝিল কার্যালয়ে থাকা চলতি হিসাব থেকে এ অর্থ কেটে নেওয়া হবে বলে জানিয়ে দেওয়া হয়। শেয়ারবাজারে বিনিয়োগের শর্ত লঙ্ঘনে ব্যাংক কোম্পানি আইন অনুযায়ী একটি ব্যাংককে সর্বোচ্চ ২০ লাখ টাকা জরিমানা করা যায়। তবে আইনের লঙ্ঘন অব্যাহত থাকলে প্রতিদিনের জন্য অতিরিক্ত ৫০ হাজার টাকা করে জরিমানার বিধান রয়েছে। সেই হিসাবে ব্যাংকটিকে ৪৯ লাখ ৫০ হাজার টাকা জরিমানা করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

ব্যাংক কোম্পানি আইনের ২৬-এর একটি ধারায় বলা হয়েছে, কোনো ব্যাংক তার আদায়কৃত মূলধন, শেয়ার প্রিমিয়াম, সংবিধিবদ্ধ সঞ্চিতি ও রিটেইন আর্নিংয়ের ৫ শতাংশের বেশি অন্য কোম্পানির শেয়ার ধারণ করতে পারবে না, যার হিসাব হবে বাজারমূল্যে। জুন শেষে এনআরবি ব্যাংকের হাতে পাইওনিয়ার ইনস্যুরেন্সের শেয়ার ছিল ৯ দশমিক ৮ শতাংশ।

একই আইনের ২৬-এর আরেক ধারায় বলা আছে, কোনো কোম্পানির আদায়কৃত মূলধনের ১০ শতাংশের বেশি শেয়ার ব্যাংক ধারণ করতে পারবে না। কিন্তু সেই হিসাবে জুন শেষে ব্যাংকটির হাতে পাইওনিয়ার ইনস্যুরেন্সের শেয়ার ছিল ১১ দশমিক ৬ শতাংশ।

জরিমানার বিষয়ে এনআরবি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মামুন মাহমুদ শাহ প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাদের নিজেদের তদন্তে অনিয়ম ধরা পড়ায় গত জুলাইয়ে সিএফওসহ পুরো টিমকে প্রত্যাহার করা হয়। পরে সিএফওকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। বিষয়টি নিয়ে আমরা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে ব্যাখ্যাও দিয়েছিলাম।’

তবে প্রত্যাহার হওয়া সিএফও কামরুল হাসান গত রাতে প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা যখন বিমা কোম্পানিটির শেয়ার কিনেছিলাম, তখন দাম কম ছিল। পরে দাম বেড়ে যাওয়ায় জুন শেষে বিনিয়োগ আইনি সীমা অতিক্রম করেছিল। এ কারণে পরের দুই দিনে তা বিক্রি করে দেওয়া হয়। এই কারণে আমাকে সিএফও পদ থেকে প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়েছিল। তবে ব্যাংকে আছি, এমডির সচিবালয়ে যুক্ত আছি।’

কামরুল হাসান দাবি করেন, ‘তিনি ভালো মৌলভিত্তি দেখে ইনস্যুরেন্স কোম্পানিটির শেয়ারে বিনিয়োগের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। কয়েকবার ওই শেয়ার কেনাবেচা করা হয়। এর বেশি না।’

সূত্র জানায়, চতুর্থ প্রজন্মের এনআরবি ব্যাংক ২০১৩ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। ২০১৩ সালে কার্যক্রম শুরু করলেও ২০১৪ সালের ডিসেম্বর থেকে শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ শুরু করে। গত ২৯ এপ্রিলের পরিচালনা পর্ষদের সভায় শেয়ারবাজারে বিনিয়োগের জন্য ১৯০ কোটি টাকার সীমা অনুমোদন করে। এর মধ্যে গত ৩০ জুন পর্যন্ত মিউচুয়াল ফান্ডে বিনিয়োগ ছিল ২ কোটি টাকা ও সেকেন্ডারি বাজারে বিনিয়োগ ছিল ১৮৭ কোটি টাকা। তবে সেকেন্ডারি বাজারে বিনিয়োগ মূল্য গত জুন শেষে কমে হয় ১৫১ কোটি ১৫ লাখ টাকা। তাতে অবিক্রীত লোকসান ৩৫ কোটি ৭৩ লাখ টাকা। সম্প্রতি এনআরবি ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের সভায় এসব তথ্য উপস্থাপন করা হয়। ব্যাংকটির এমডি মামুন মাহমুদ শাহ বলেন, শেয়ারবাজারে বিনিয়োগের বিপরীতে জুন শেষে যে লোকসান ছিল, এখন তা অনেক কমে এসেছে।