আড়াই লাখ কোটি টাকা আটকা

আদালতে এখন ব্যাংক ও আর্থিক খাতের ২ লাখ ৭৭ হাজার ৯৪টি মামলা নিষ্পত্তির অপেক্ষায় রয়েছে। এসব মামলার বিপরীতে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ২ লাখ ৫১ হাজার ২৬৯ কোটি টাকা আটকে আছে। এই টাকা সর্বশেষ ২০১৯-২০ অর্থবছরে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) আদায় করা রাজস্ব আয়ের চেয়েও বেশি।

অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগে সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংকের পাঠানো এক প্রতিবেদনে এই তথ্য পাওয়া গেছে। প্রতিবেদনটিতে ২০২০ সালের জুন পর্যন্ত ব্যাংক ও আর্থিক খাতের মামলার সংখ্যা ও এর সঙ্গে জড়িত অর্থের পরিমাণ তুলে ধরা হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক ছয় মাস পরপর মামলার হালনাগাদ তথ্যসংবলিত প্রতিবেদন তৈরি করে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগে পাঠায়। প্রতিবেদনে চার ধরনের মামলার কথা বলা হয়েছে—রিট মামলা, অর্থঋণ মামলা, সার্টিফিকেট মামলাএবং দেউলিয়া ও অন্যান্য মামলা। সাধারণত যেসব খেলাপি ঋণ আদায়ের সম্ভাবনা কম থাকে, সেগুলো আদায়ের জন্যই ব্যাংকগুলো আদালতে মামলা করে থাকে।

প্রতিবেদন অনুযায়ী সার্টিফিকেট মামলার সংখ্যাই সবচেয়ে বেশি, ১ লাখ ৫২ হাজার ৬২৬টি। আবার এই সার্টিফিকেট মামলায় জড়িত টাকার পরিমাণ সবচেয়ে কম, ২ হাজার ৪১৯ কোটি টাকা। অর্থঋণ আদালতে বিচারাধীন মামলার সংখ্যা ৬০ হাজার ৯৭৩টি। এসব মামলার বিপরীতে জড়িত রয়েছে ১ লাখ ২৯ হাজার ১১৫ কোটি টাকা। রিট মামলা আছে ৫ হাজারটি, যেগুলোতে জড়িত টাকার পরিমাণ ৩৪ হাজার ৭৮৮ কোটি। এ ছাড়া দেউলিয়া ও অন্যান্য মামলা রয়েছে ৫৮ হাজার ৪৯৫টি, এসব মামলার বিপরীতে জড়িত অর্থের পরিমাণ ৮৪ হাজার ৯০৬ কোটি টাকা।

আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব মো. আসাদুল ইসলামের বক্তব্য জানতে গত সপ্তাহে দুই দফায় তাঁর কার্যালয়ে গেলেও তিনি কোনো জবাব দেননি।

রাষ্ট্রমালিকানাধীন ৬ ব্যাংক

প্রতিবেদনে অনুযায়ী রাষ্ট্রমালিকানাধীন সোনালী, জনতা, অগ্রণী, রূপালী, বেসিক ও বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক লিমিটেডের (বিডিবিএল) আটকে আছে মোট ১ লাখ ৬ হাজার ৩৯৭ কোটি টাকা, মামলার সংখ্যা ৭৯ হাজার ৭৮২টি। তাদের রিট ও অর্থঋণ মামলার সংখ্যা ২০ হাজার ১৩৬টি। এর সঙ্গে জড়িত অর্থের পরিমাণ ৬৬ হাজার ১৭৫ কোটি টাকা। এই ছয় ব্যাংকের সার্টিফিকেট, দেউলিয়া ও অন্যান্য মামলা ৫৯ হাজার ৬৪৬টি। এতে জড়িত অর্থের পরিমাণ ৪০ হাজার ২২ কোটি টাকা।

‘কোভিড-১৯ মামলাগুলোর নিষ্পত্তি পিছিয়ে দিয়েছে। তবে এগুলোকে একটু শৃঙ্খলার মধ্যে আনতে চেষ্টা করছি। অনেক আইন কর্মকর্তা নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। আইনজীবীরাও আগের চেয়ে অনেক বেশি তৎপর।’
শামস-উল ইসলাম, অগ্রণী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক

রাষ্ট্রমালিকানাধীন ব্যাংক খাতে রিট ও অর্থঋণ মামলায় সোনালী ও জনতা ব্যাংকের জড়িত অর্থই প্রায় ৩৯ হাজার কোটি টাকা। সার্টিফিকেট, দেউলিয়া ও অন্যান্য মামলায় এ দুই ব্যাংকের জড়িত অর্থ ৩২ হাজার ৪০২ কোটি টাকা। এ ছাড়া চার ধরনের মামলায় বেসিক ব্যাংকের ১১ হাজার ৯২০ কোটি, অগ্রণী ব্যাংকের ১১ হাজার ৩৫০ কোটি, রূপালী ব্যাংকের ৯ হাজার ৩৫ কোটি এবং বিডিবিএলের ৩ হাজার ২৪৯ কোটি টাকার মামলা নিষ্পত্তির অপেক্ষায় আছে।

জানতে চাইলে অগ্রণী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শামস-উল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘কোভিড-১৯ মামলাগুলোর নিষ্পত্তি পিছিয়ে দিয়েছে। তবে এগুলোকে একটু শৃঙ্খলার মধ্যে আনতে চেষ্টা করছি। অনেক আইন কর্মকর্তা নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। আইনজীবীরাও আগের চেয়ে অনেক বেশি তৎপর।’

১৪ বিশেষায়িত প্রতিষ্ঠান

এই তালিকায় মোট প্রতিষ্ঠান ১৪টি। এর মধ্যে রয়েছে সাতটি বিশেষায়িত ব্যাংক—বিকেবি, রাকাব, কর্মসংস্থান ব্যাংক, প্রবাসীকল্যাণ ব্যাংক, পল্লী সঞ্চয় ব্যাংক, আনসার-ভিডিপি উন্নয়ন ব্যাংক ও বাংলাদেশ সমবায় ব্যাংক। আর বিশেষায়িত আর্থিক প্রতিষ্ঠান সাতটি—বিএইচবিএফসি, আইসিবি, বিএসইসি, এসবিসি, জেবিসি, আইডিআরএ ও এমআরএ। ১৪টি প্রতিষ্ঠানের মামলা ১ লাখ ২৮ হাজার ৭৪৭টি। এগুলোতে জড়িত অর্থের পরিমাণ ৭ হাজার ৭২৫ কোটি টাকা।

সাত বিশেষায়িত ব্যাংকের মধ্যে সর্বোচ্চ ২ হাজার ৮০০ কোটি টাকা আটকে আছে বিকেবির। এর মধ্যে রিট মামলা ও অর্থঋণ মামলাতেই জড়িত ১ হাজার ৯১২ কোটি টাকা। বাকি অর্থ সার্টিফিকেট ও অন্যান্য মামলার। এদিকে আকারে ছোট হলেও কর্মসংস্থান ব্যাংকের ১৭ কোটি ৭৮ লাখ টাকা জড়িত। ব্যাংকটির মামলা রয়েছে ২ হাজার ৭০২টি, যার মধ্যে ২ হাজার ৪৪২টি সার্টিফিকেট মামলা।

বিকেবির এমডি আলী হোসেন প্রধানিয়া বলেন, ‘অনেক মামলা নিষ্পত্তি হয়েছে। আমাদের পর্যবেক্ষণ হচ্ছে, ব্যাংকাররা একটু লেগে থাকলে টাকা আদায় করা যায়। আর এখন আমরা সার্টিফিকেট মামলা পারতপক্ষে করতে চাচ্ছিই না।’

আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে চার ধরনের মামলায় সবচেয়ে বেশি টাকা জড়িত আইসিবির। পরিমাণ ৯৪১ কোটি টাকা।

বেসরকারি ৩৮ ব্যাংক

একসময় নিষ্পত্তির অপেক্ষায় থাকা সব ধরনের মামলায় জড়িত টাকার পরিমাণ বেশি থাকত রাষ্ট্রমালিকানাধীন ও সরকারি ব্যাংকগুলোর। এখন তাদের চেয়ে বেসরকারি ব্যাংকগুলোর বেশি টাকা আটকে আছে, যা পরিমাণে ১ লাখ ২২ হাজার ২৭৪ কোটি টাকা। মামলার সংখ্যা ৬৪ হাজার ৮৬০টি। ব্যাংকাররা বলছেন, ঋণ বিতরণে যথেষ্ট সতর্কতার অভাবে বেসরকারি ব্যাংকগুলোর বেশি টাকা আটকে গেছে, মামলার সংখ্যাও বেড়েছে।

‘মামলাগুলো নিষ্পত্তির ব্যাপারে সরকারের কোনো উদ্ভাবনমূলক উদ্যোগ থাকলে ভালো হতো। বাংলাদেশ ব্যাংকসহ বিভিন্ন ব্যাংক এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠান মিলেও কোনো উপায় বের করতে পারে।’
সালেহউদ্দিন আহমেদ, বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর

মোট ৩৮টি বেসরকারি ব্যাংকের মধ্যে তিনটিরই আটকে আছে প্রায় ২৫ হাজার কোটি টাকা। এ ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ ১৬ হাজার ৪৬৮ কোটি টাকা ন্যাশনাল ব্যাংকের। এবি ব্যাংকের ৮ হাজার ৫৮১ কোটি টাকা ও পদ্মা ব্যাংকের ৫ হাজার ৯২২ কোটি টাকা। তবে সবচেয়ে কম অর্থ জড়িত মধুমতি ব্যাংকের, ৪৩ কোটি টাকা।

বেসরকারি ২৮টি আর্থিক প্রতিষ্ঠান

বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন মতে, বেসরকারি ব্যাংকের বাইরে ২৮টি বেসরকারি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মামলাসংখ্যা ১৭ হাজার ২৩৩। তাদের আটকে আছে ১০ হাজার ৭৭৬ কোটি টাকা। এর মধ্যে ফারইস্ট ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্টের একারই ১ হাজার ৭৪৮ কোটি টাকা।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহউদ্দিন আহমেদের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘মামলাগুলো নিষ্পত্তির ব্যাপারে সরকারের কোনো উদ্ভাবনমূলক উদ্যোগ থাকলে ভালো হতো। বাংলাদেশ ব্যাংকসহ বিভিন্ন ব্যাংক এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠান মিলেও কোনো উপায় বের করতে পারে।’