ইচ্ছাকৃত খেলাপি পদ পাবেন না

ব্যাংক কোম্পানি (সংশোধন) আইন গতকাল মন্ত্রিসভায় অনুমোদিত হয়েছে। এতে দেশে ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি হওয়ার প্রবণতা কমার আশা।

ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে যাঁরা ইচ্ছাকৃতভাবে খেলাপি হয়েছেন, তাঁরা বিদেশ ভ্রমণ করতে পারবেন না। তাঁদের গাড়ি-বাড়ি নিবন্ধন ও ট্রেড লাইসেন্স করার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করবে সরকার। ইচ্ছাকৃত খেলাপিরা রাষ্ট্রীয়ভাবে কোনো সম্মাননা পাবেন না কিংবা রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণের যোগ্য বলেও বিবেচিত হবেন না। এমনকি পেশাজীবী, ব্যবসায়িক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক বা রাজনৈতিক সংগঠনের কোনো পদেও থাকতে পারবেন না তাঁরা।

এসব বিষয় যুক্ত করে ব্যাংক কোম্পানি (সংশোধন) আইন, ২০২১–এর যে খসড়া তৈরি করা হয়েছে সেটি গতকাল সোমবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত মন্ত্রিসভা নীতিগতভাবে অনুমোদন করেছে। বৈঠক শেষে এক ব্রিফিংয়ে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম ব্যাংক কোম্পানি (সংশোধন) আইনের খসড়া অনুমোদনের কথা সাংবাদিকদের জানান।

এ খসড়ায় ব্যাংক কোম্পানি আইনে প্রথমবারের মতো ‘ইচ্ছাকৃত খেলাপি ঋণগ্রহীতা’ নামে নতুন সংজ্ঞা দেওয়া হয়েছে। বলা হয়েছে, যিনি নিজের বা স্বার্থসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের অনুকূলে নামে-বেনামে বা অস্তিত্ববিহীন প্রতিষ্ঠানের নামে ঋণ নিয়ে সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও তা পরিশোধ করবেন না, তিনিই ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি।

আইনটি সংসদে পাস হলে সরকারের বিভিন্ন সংস্থার কাছে ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিদের তালিকা পাঠাবে বাংলাদেশ ব্যাংক। ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি হিসেবে তালিকাভুক্ত ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান ওই তালিকা থেকে অব্যাহতি পাওয়ার পর পাঁচ বছর না যাওয়া পর্যন্ত কোনো ব্যাংক কোম্পানি বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানের পরিচালক হতে পারবেন না।

দুর্বল ব্যাংকের অবসায়ন হবে

খসড়ায় বলা হয়েছে, যদি কোনো দুর্বল ব্যাংক মনে করে যে তার বিদ্যমান আর্থিক অবস্থা, অর্থাৎ তারল্য, সম্পদের গুণগত মান ও মূলধন পরিস্থিতি খারাপ হয়ে গেছে বা সুশাসন বজায় রেখে পরিচালনা করা সম্ভব হচ্ছে না, অথবা ব্যাংকটি আরও সংকটাপন্ন পরিস্থিতির দিকে যাচ্ছে, তাহলে ব্যাংক কর্তৃপক্ষ তা বাংলাদেশ ব্যাংককে জানাবে।

তখন বাংলাদেশ ব্যাংক দুই বছর সময় দিয়ে পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে কি না দেখবে। সেই সঙ্গে ব্যাংকটিকে একটি পুনরুদ্ধার পরিকল্পনাও তৈরি করে দেওয়া হবে। চূড়ান্তভাবে ব্যর্থ হলে অবসায়নই হবে দুর্বল ব্যাংকের অনিবার্য পরিণতি।

এদিকে বাংলাদেশ ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সূত্রগুলো জানায়, আইন পাস হওয়ার পর সেই পরিণতির (অবসায়ন) দিকে এগোতে পারে তিনটি ব্যাংক। এর মধ্যে দুটি সরকারি। একটি বেসরকারি, যেটি ২০১৪ সালে যাত্রা শুরু করে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, সংশোধনের উদ্যোগটি শুভ মনে হচ্ছে। তবে ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি চিহ্নিত করাটাই কঠিন। সরকার ইচ্ছাকৃত বললেও গ্রাহকদের অজুহাত দেখানোর অভাব পড়বে না। আর ব্যাংকের অবসায়নের পরিবর্তনে একীভূত করার চিন্তাই মনে হয় ভালো হবে।

স্বতন্ত্র পরিচালক এক-পঞ্চমাংশ

বর্তমানে বেসরকারি কোনো ব্যাংকে তিনজন স্বতন্ত্র পরিচালক রাখার বিধান রয়েছে। নতুন প্রস্তাবে বলা হয়েছে, স্বতন্ত্র পরিচালকসহ মোট পরিচালক হবেন ন্যূনতম ১১, সর্বোচ্চ ২০ জন। তবে স্বতন্ত্র পরিচালকের অনুপাত অবশ্যই মোট পরিচালকের এক-পঞ্চমাংশ হতে হবে।

শাস্তি বা জরিমানাসংক্রান্ত বিধানগুলো কঠোরতর করা হয়েছে প্রস্তাবিত সংশোধনীতে। কেউ বিভ্রান্তিমূলক, মিথ্যা বা মনগড়া দলিল বা তথ্য সরবরাহ করলে, প্রমাণ সাপেক্ষে তার তিন বছরের কারাদণ্ড অথবা সর্বোচ্চ ৫ লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ডই হবে।

আরও বলা হয়েছে, কোনো চেয়ারম্যান, পরিচালক, ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি), প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) বা দুই স্তর অধস্তন কর্মকর্তা অর্থ, দুর্নীতি বা জালিয়াতি–সম্পর্কিত দোষে সাব্যস্ত হলে সেই ব্যক্তি প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে ব্যাংক কোম্পানির পরিচালনা ও প্রশাসনের কোনো কার্যকলাপে অংশ নিতে পারবেন না।

মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম ব্রিফিংয়ে বলেন, আইনটি হলে ইচ্ছাকৃত খেলাপি ঋণগ্রহীতার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া যাবে। ব্যাংকের পরিচালক বা দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের মোটা অঙ্কের জরিমানাও করা যাবে।

মন্ত্রিসভায় আসার আগপর্যন্ত আইনের যে খসড়া তৈরি করছিল আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ, তাতে ঋণ মওকুফের অংশে পরিবারের সংজ্ঞায় পরিবর্তন আনার কথা ছিল। বিদ্যমান ব্যাংক কোম্পানি আইনের ২৮ ধারায় ঋণ মওকুফের ওপর বাধানিষেধ অংশে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদন ছাড়া কোনো ব্যাংক তার কাছ থেকে নেওয়া কোনো পরিচালক বা তার পরিবারের সদস্যদের ঋণ মওকুফ করতে পারবে না।