ইব্রাহিম খালেদের মতো একজনকে প্রতিদিন খুঁজছি

খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ
ফাইল ছবি

প্রয়াত ব্যাংকার খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদকে নতুন করে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার কিছু নেই। কারণ, সততা ও সাহসিকতা তাঁকে অনন্য করে রেখেছে। আর্থিক খাত, বিশেষত ব্যাংক ও শেয়ারবাজারের যেকোনো দুর্দশা, বাংলাদেশ ব্যাংকের নতজানু অবস্থা দেখলে তিনি সাহসী বক্তব্য দিতেন। সত্য ও যথাযথ মন্তব্য করতেন নির্ভয়ে। আজ খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদের প্রয়াণের এক বছর।

আরও পড়ুন
ইব্রাহিম খালেদের মতো শক্ত করে কেউ অনিয়ম ও অন্যায়ের বিরোধিতা করছেন না। সঠিক পথ বাতলে দিচ্ছেন না। কেউ কেউ দেখেও যেন সবকিছু এড়িয়ে যাচ্ছেন। অনেকেই সুবিধা নিয়ে চুপসে গেছেন।

তাঁর মৃত্যুর পর বলতে গেলে প্রতিদিনই তাঁর কথা মনে হয়। বিশেষ করে যখনই কোনো ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানের অনিয়ম দেখি, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নতজানু অবস্থান দেখি, তখন তাঁর কথা বেশি মনে পড়ে। কারণ, তাঁর মতো শক্ত করে কেউ অনিয়ম ও অন্যায়ের বিরোধিতা করছেন না। সঠিক পথ বাতলে দিচ্ছেন না। কেউ কেউ দেখেও যেন সবকিছু এড়িয়ে যাচ্ছেন। অনেকেই সুবিধা নিয়ে চুপসে গেছেন।

খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ ছিলেন মূলত ব্যাংকার। রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন না। বড় কোনো প্রভাবশালী গ্রুপের আস্থাভাজনও ছিলেন না। আজীবন একাধিক সরকারি-বেসরকারি ব্যাংকের বিভিন্ন পদে চাকরি করেছেন, এমডিও ছিলেন। ছিলেন বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নরও। অবসরের পর অর্থনীতির নানা বিষয় নিয়ে লেখালেখি করতেন। আর জীবনের শেষ দিনটি পর্যন্ত শিরদাঁড়া উঁচু করে সোচ্চার ছিলেন আর্থিক অনিয়মের বিরুদ্ধে।

খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ ছিলেন মূলত ব্যাংকার। রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন না। বড় কোনো প্রভাবশালী গ্রুপের আস্থাভাজনও ছিলেন না।

পেশাগত কারণে তাঁর সঙ্গে একাধিকবার কথা বলার সুযোগ হয়েছিল। ধানমন্ডির বাসা ও সেগুনবাগিচার কচি-কাঁচার মেলা কার্যালয়ে বেশ কয়েকবার গিয়েছি তাঁর সঙ্গে কথা বলতে। মিরপুরের বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্টেও (বিআইবিএম) কয়েকবার দেখা করতে গিয়েছিলাম। দেখা হলেই বলতেন, ‘এত লেখালেখি করেও কোনো উন্নতি হচ্ছে না। এরপরও লেখালেখি ছাড়া যাবে না। নিজের দায়িত্বটি পালন করে যেতে হবে। নিশ্চয়ই একদিন সুদিন ফিরবে।’
তবে মৃত্যুর আগে তাঁর দেওয়া দুটি সাক্ষাৎকার ছিল স্মরণ করার মতো। সাক্ষাৎকার দুটিই নেওয়া হয়েছিল করোনাভাইরাসের প্রকোপ শুরুর পর।

আর্থিক খাতের কেলেঙ্কারির জন্য দেশজুড়ে আলোচিত প্রশান্ত কুমার হালদারের খপ্পরে পড়ে আর্থিক প্রতিষ্ঠান ইন্টারন্যাশনাল লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস লিমিটেড (আইএলএফএসএল) তখন তহবিলশূন্য হয়ে পড়ে। আমানতকারীরা সরকারের বিভিন্ন পর্যায় ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকে গিয়ে টাকা ফেরত পেতে ব্যর্থ হয়। এরপর আদালতে গেলে বিচারপতি মোহাম্মদ খুরশিদ আলম সরকারের একক হাইকোর্ট বেঞ্চ ২০২০ সালের ১৯ জানুয়ারি খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদকে প্রতিষ্ঠানটির নতুন চেয়ারম্যান হিসেবে নিয়োগের আদেশ দেন। পাশাপাশি নতুন চেয়ারম্যানকে সুসজ্জিত স্বতন্ত্র অফিস কক্ষসহ মাসিক সম্মানী হিসেবে তিন লাখ টাকা দেওয়ার নির্দেশ দেন আদালত।

আদালতের আদেশে ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহে ইন্টারন্যাশনাল লিজিংয়ের চেয়ারম্যান হিসেবে যোগ দেন তিনি। তবে তিনি কোনো সম্মানী নেননি। চেয়ারম্যান হিসেবে যোগ দেওয়ার পর পরিচালনা পর্ষদের দুটি সভায় সভাপতিত্ব করেন খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ। এরপর পরিস্থিতি দেখে মার্চের প্রথম সপ্তাহেই পদত্যাগ করেন।

আদালতের আদেশে ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহে প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান হিসেবে যোগ দেন তিনি। তবে তিনি কোনো সম্মানী নেননি। চেয়ারম্যান হিসেবে যোগ দেওয়ার পর পরিচালনা পর্ষদের দুটি সভায় সভাপতিত্ব করেন খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ। এরপর পরিস্থিতি দেখে মার্চের প্রথম সপ্তাহেই পদত্যাগ করেন। তখন করোনার ভয়ে আতঙ্কিত মানুষ বলতে গেলে ঘর থেকে বের হওয়া বন্ধ করে দিয়েছে। পদত্যাগের পরদিন পেশাগত কাজে ফোন করলে তিনি বাসায় যেতে বলেন। তিনি আগে থেকেই অসুস্থ ছিলেন। তাই যাওয়ার আগে কয়েকবার ভাবলাম এ অবস্থায় যাওয়া ঠিক হবে তো! এ নিয়ে কয়েকজনের সঙ্গে পরামর্শও করি। শেষ পর্যন্ত ইব্রাহিম খালেদের বাসায় যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিই।

আরও পড়ুন

বাসায় যাওয়ার পর তিনি ইন্টারন্যাশনাল লিজিংয়ের বিস্তারিত খুলে বলেন। বলেন, পি কে হালদারের পাশাপাশি আর কোন গ্রুপ ইন্টারন্যাশনাল লিজিং থেকে কত টাকা নিয়ে গেছে। এ জন্য এসব টাকা আদায় করা কঠিন বলে তিনি মন্তব্য করেন। আমি তাঁর কাছ থেকে গ্রুপগুলোর নাম শুনে বলি, ‘স্যার, এসব নাম এখন মুখে নিতেও ভয় করে।’

কয়েকটি গ্রুপের কাছে ব্যাংকগুলো জিম্মি ও দখল হয়ে যাওয়া নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেন ইব্রাহিম খালেদ। এ জন্য কয়েকজন জ্যেষ্ঠ অর্থনীতিবিদ মিলে ব্যাংক খাতের উন্নয়নে একটা প্রস্তাব তুলে ধরবেন বলে জানান।

এরপর তিনি ব্যাংক খাতের পরিস্থিতি নিয়ে দুঃখ প্রকাশ করেন। কয়েকটি গ্রুপের কাছে ব্যাংকগুলো জিম্মি ও দখল হয়ে যাওয়া নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেন। এ জন্য কয়েকজন জ্যেষ্ঠ অর্থনীতিবিদ মিলে ব্যাংক খাতের উন্নয়নে একটা প্রস্তাব তুলে ধরবেন বলে জানান। তবে এ নিয়ে কিছু না লেখার জন্য বলেন। এরপর করোনা প্রকট আকার ধারণ করে। সেই আলোচনা আর এগোয়নি বলে মোবাইলে একদিন জানান।
এরপর ২০২০ সালের ২৪ আগস্ট প্রথম আলোর হেড অব অনলাইন শওকত হোসেন ভাইয়ের সঙ্গে সেগুনবাগিচার কচি-কাঁচার মেলা কার্যালয়ে তাঁর সাক্ষাৎকার নিতে যায়। সেদিনও তিনি খোলামনে কথা বলেন। কেন ব্যাংক খাতের বর্তমানে এই দুর্দশা, তা–ও সাহসের সঙ্গে তুলে ধরেন। সেটাই ছিল প্রথম আলোতে প্রকাশিত তাঁর শেষ সাক্ষাৎকার।

আরও পড়ুন

গত বছরের ২৪ ফেব্রুয়ারি তিনি ইহলোক ত্যাগ করেন। এর আগে করোনায় আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন। তাঁর মৃত্যুর পর প্রথম আলোর অনলাইনে ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে মন্তব্য ছিল চোখে পড়ার মতো। প্রথম আলোর অনলাইনে সোলায়মান নামের একজন পাঠক লিখেছিলেন,‘আর্থিক খাতের সবচেয়ে ভালো লোকটিকে হারালাম। এই খাতের দিকনির্দেশনা দিতে ও দুর্নীতি ধরতে আর কেউ থাকল না। বাংলাদেশ ব্যাংকে দুর্নীতির তদন্তে তার মতো একটি লোকের বড়ই প্রয়োজন ছিল। ওপারে ভালো থাকবেন প্রিয় সুহৃদ।’
আকবর আলী নামের একজন পাঠক লিখেছিলেন, ‘তিনি সত্য কথা বলতে সক্ষম লোকদের একজন ছিলেন। তাঁর বিদেহী আত্মার কল্যাণ কামনা করছি।’ মুনিরুল ইসলাম নামের একজন লিখেছিলেন,‘একজন সাহসী, নির্লোভ, আদর্শবান এবং নিরহংকার দেশপ্রেমিক ছিলেন!’

গত এক বছরে ব্যাংক খাতের পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়েছে। ব্যাংকগুলো থেকে বেনামে ঋণ বের হচ্ছে। এসব টাকায় কেউ জমি কিনছে, কেউ বিদেশে পাচার করে আলিশান জীবনের স্বপ্ন বুনছেন। এখন আর কেউ এসব নিয়ে কথা বলছেন না, লিখছেন না।

গত এক বছরে ব্যাংক খাতের পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়েছে। ব্যাংকগুলো থেকে বেনামে ঋণ বের হচ্ছে। এসব টাকায় কেউ জমি কিনছে, কেউ বিদেশে পাচার করে আলিশান জীবনের স্বপ্ন বুনছেন। এভাবে চলতে থাকলে কয়েকটি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের আমানতকারীদের মতো ব্যাংকের আমানতকারীরাও একদিন টাকা ফেরতের জন্য হাহাকার করবেন। এখন আর কেউ এসব নিয়ে কথা বলছেন না, লিখছেন না। এ জন্য এখনো খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদের মতো শুধু একজন নয়, কয়েকজনকে প্রতিদিন খুঁজছি। যাঁদের সাহস ও সততা অনন্য উচ্চতার।

লেখক: জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক, প্রথম আলো
[email protected]