ঋণ-সুদ আদায় বন্ধ, কমছে আয়

  • শুধু ঋণ দেওয়া নয়, করোনায় বন্ধ হয়ে গেছে খেলাপি ঋণ আদায়ও। আবার ঋণ ও সুদ আদায় কমে গেছে, এর ফলে আয়ে বড় ধরনের পতন হয়েছে।

  • এবার পুরো বছরের লক্ষ্যের এক-তৃতীয়াংশও ঋণ দেয়নি সোনালী, অগ্রণী ও রূপালী ব্যাংক।

  • বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ফজলে কবির স্থানীয় পর্যায়ের শাখা বা করপোরেট অফিসের মাধ্যমে ঋণ দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। অতি প্রয়োজন ছাড়া রাজধানীর বাইরের ঋণ স্থানীয় শাখায় না আনতে বলা হয়েছে।

আর্থিক অবস্থা ঠিক করতে এক দশকের বেশি সময় ধরে রাষ্ট্রমালিকানাধীন চার ব্যাংককে লক্ষ্য ঠিক করে দিচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এসব লক্ষ্যের অনেকগুলোই অর্জিত হয় না। ঋণ প্রবৃদ্ধির যে লক্ষ্য ঠিক করে দেওয়া হয়, তা–ও অতিক্রম করে বেশি ঋণ দেয় কোনো কোনো ব্যাংক। তবে এবার পুরো বছরের লক্ষ্যের এক-তৃতীয়াংশও ঋণ দেয়নি সোনালী, অগ্রণী ও রূপালী ব্যাংক।

শুধু ঋণ দেওয়া নয়, করোনায় বন্ধ হয়েছে খেলাপি ঋণ আদায়ও। আবার করোনাভাইরাসের কারণে ব্যাংকের ঋণ আদায় না হলেও গ্রাহক খেলাপি হচ্ছে না। ফলে ঋণ ও সুদ আদায় কমে গেছে। এতে রাষ্ট্রমালিকানাধীন সোনালী, অগ্রণী, জনতা ও রূপালী ব্যাংকের আয়ে বড় ধরনের পতন হয়েছে। বাড়ছে লোকসানি শাখাও।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে চার ব্যাংকের সভায় উপস্থাপিত প্রতিবেদন থেকে এসব তথ্য মিলেছে। ব্যাংকগুলোর সঙ্গে সমঝোতা স্মারক চুক্তির আওতায় ছয় মাস পরপর এ সভা অনুষ্ঠিত হয়। এরই অংশ হিসেবে গত বৃহস্পতিবার অনুষ্ঠিত এ সভায় চার ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক, প্রধান আর্থিক কর্মকর্তাসহ কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।

তবে এত কিছুর পরও কেন্দ্রীয় ব্যাংক নির্দিষ্ট কিছু শাখায় ঋণ কেন্দ্রীভূত হয়ে পড়া নিয়ে চিন্তিত। কারণ, এক শাখায় বেশি ঋণ খেলাপি হয়ে পড়লে শাখাটি নিয়েই সমালোচনা শুরু হয়। হলমার্ক কেলেঙ্কারির কারণে সোনালী ব্যাংকের রূপসী বাংলা শাখা, ক্রিসেন্টের কারণে জনতা ব্যাংকের ইমামগঞ্জ শাখা ও অ্যাননটেক্সের কারণে ভবন শাখা (প্রধান কার্যালয়) আলোচনায় রয়েছে।

এ জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ফজলে কবির স্থানীয় পর্যায়ের শাখা বা করপোরেট অফিসের মাধ্যমে ঋণ দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। অতি প্রয়োজন ছাড়া রাজধানীর বাইরের ঋণ স্থানীয় শাখায় না আনতে বলা হয়েছে।

জানা গেছে, চলতি বছরে সোনালী ব্যাংকের ঋণে ১৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হওয়ার কথা, তবে জুন পর্যন্ত মাত্র ৪ দশমিক ৬৪ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছে। ব্যাংকটি ৭ প্রতিষ্ঠানের ৫৩২ কোটি টাকা ঋণ অধিগ্রহণ করেছে, যার বর্তমান স্থিতি ৮১০ কোটি টাকা। এর মধ্যে ওয়েস্টার্ন মেরিন শিপইয়ার্ডের ১১৬ কোটি টাকা ইতিমধ্যে খেলাপি হয়ে পড়েছে। চলতি বছরে ব্যাংকটি ২৫০ কোটি টাকা খেলাপি ঋণ আদায়ের লক্ষ্য ঠিক করেছিল, তবে জুন পর্যন্ত আদায় হয়েছে মাত্র ৫ কোটি টাকা। আর সোনালীর লোকসানি শাখা ২৭ থেকে বেড়ে হয়েছে ৫০টি। ফলে ব্যাংকটি চলতি বছরের প্রথম ৬ মাসে মাত্র ৯৫ কোটি টাকা নিট মুনাফা করেছে। ২০১৯ সালের পুরো সময়ে নিট মুনাফা হয়েছিল ২৭১ কোটি টাকা।

জনতা ব্যাংকের ঋণে ১২ শতাংশ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে জুন পর্যন্ত ৭ শতাংশ অর্জন করেছে। তবে ব্যাংকটি ১ হাজার কোটি টাকা খেলাপি ঋণ আদায়ের লক্ষ্যের বিপরীতে আদায় করেছে আড়াই কোটি টাকা। লোকসানি শাখা ৫০ থেকে বেড়ে হয়েছে ৭৯। বছরের প্রথম ৬ মাসে ৩ হাজার ৫৪১ কোটি টাকা নিট লোকসান করেছে। অথচ গত বছরে ২৫ কোটি টাকা মুনাফা করেছিল তারা।

জনতা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবদুছ ছালাম আজাদ গত বৃহস্পতিবার বলেন, নিরাপত্তা সঞ্চিতির ঘাটতি হওয়ায় লোকসান হয়েছিল। তবে ছাড় পাওয়ার আগের বছরের একই সময়ের চেয়ে বেশি আয় হয়েছে। তিনি ব্যাংকটির প্রধান আর্থিক কর্মকর্তা এ কে এম শরিয়তউল্লাহর সঙ্গে যোগাযোগের পরামর্শ দেন।
এ কে এম শরিয়তউল্লাহ গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে ১৬৪ কোটি টাকা নিট মুনাফা হয়েছিল। গত বছরের একই সময়ে হয়েছিল ২৪ কোটি টাকা।

তাহলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক কেন ৩ হাজার ৫৪১ কোটি টাকা লোকসানের কথা বলছে? এর জবাবে এ কে এম শরিয়তউল্লাহ বলেন, ‘হিসাবটি ছাড়ের আগে। আমরা বিভিন্ন ছাড় পেয়েছি, ফলে নিট মুনাফা হয়েছে।’

ঋণ আদায় প্রায় বন্ধ। এ জন্য আয় কমে গেছে। তবে আয় কত হলো, তাতে গুরুত্ব না দিয়ে অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারে আমরা বেশি গুরুত্ব দিচ্ছি।
অগ্রণী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ শামস-উল ইসলাম

অগ্রণী ব্যাংকের ঋণে ২০ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হওয়ার কথা, তবে ৬ মাসে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৩ দশমিক ২০ শতাংশ। ব্যাংকটি খেলাপি ঋণের বিপরীতে ২০০ কোটি টাকা আদায়ের লক্ষ্য ঠিক করলেও আদায় করেছে সাড়ে ৬ কোটি টাকা। আর লোকসানি শাখা বেড়ে হয়েছে ১৮ থেকে ৭৮। প্রথম ৬ মাসে নিট মুনাফা করেছে ১৫ কোটি টাকা, গত বছরের পুরো সময়ে হয়েছিল ১০৭ কোটি টাকা। ব্যাংকটি ১২ প্রতিষ্ঠানের ৫৯৭ কোটি টাকা ঋণ অধিগ্রহণ করেছে, যা বেড়ে হয়েছে ৭১৫ কোটি টাকা।

অগ্রণী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ শামস-উল ইসলাম গত বৃহস্পতিবার প্রথম আলোকে বলেন, ‘ঋণ আদায় প্রায় বন্ধ। এ জন্য আয় কমে গেছে। তবে আয় কত হলো, তাতে গুরুত্ব না দিয়ে অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারে আমরা বেশি গুরুত্ব দিচ্ছি।’

পুরো বছরে রূপালী ব্যাংকের ঋণে ২০ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হওয়ার কথা থাকলেও অর্ধেক বছরে মাত্র ৬ দশমিক ২১ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছে। খেলাপি ঋণ থেকে ৩৫০ কোটি টাকার লক্ষ্যের বিপরীতে আদায় করেছে দেড় কোটি টাকা। আর লোকসানি শাখা ১১ থেকে বেড়ে হয়েছে ১৬। ব্যাংকটি ১১ প্রতিষ্ঠানের ২ হাজার ৩৯৩ কোটি টাকা ঋণ অধিগ্রহণ করে, তবে সব ঋণ ভালো আছে। ৬ মাসে নিট মুনাফা করেছে ১৪ কোটি টাকা, আগের পুরো বছরে হয়েছিল ৫৫ কোটি টাকা।

এদিকে কুটির, ক্ষুদ্র, ছোট ও মাঝারিদের জন্য প্রণোদনা প্যাকেজ থেকে যে ঋণ দেওয়ার কথা, চলতি অক্টোবরের মধ্যে তা বিতরণের নির্দেশ দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।

দুশ্চিন্তা ঋণ কেন্দ্রীভূত হওয়া নিয়ে

করোনার কারণে ব্যাংকগুলোর সূচক খারাপ হলেও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রধান দুশ্চিন্তা ঋণ কেন্দ্রীভূত হওয়া নিয়ে। সোনালী ব্যাংকের ৫ শাখায় ঋণের পরিমাণ ১৬ হাজার ৩৩২ কোটি টাকা, যা পুরো ঋণের ৩৪ শতাংশ। জনতা ব্যাংকের ৫ শাখায় ঋণ ৪০ হাজার ২৭০ কোটি টাকা, যা পুরো ঋণের ৭৭ শতাংশ। অগ্রণী ব্যাংকের ৫ শাখায় ঋণ ২২ হাজার ৬১৯ কোটি টাকা, যা পুরো ঋণের ৫৩ শতাংশ। রূপালী ব্যাংকের ৫ শাখায় ঋণ ২০ হাজার ৪৪০ কোটি টাকা, যা পুরো ঋণের ৬৯ শতাংশ। আবার সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কাছেও ব্যাংকগুলো বড় অঙ্কের ঋণ আটকে গেছে। এসব ঋণের অনেকগুলোই আবার খেলাপি হয়ে পড়েছে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মুখপাত্র সিরাজুল ইসলাম বলেন, ব্যাংকগুলোর আর্থিক অবস্থার উন্নতির পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। এজন্য লক্ষ্যও বেঁধে দেওয়া হয়েছে।