ঋণখেলাপি ও দাপুটেদের বছর

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সিদ্ধান্ত নিয়ে বিতর্ক, করোনাজনিত স্থবিরতা, ভয়ভীতি প্রদর্শন, পর্যাপ্ত সুবিধার সঙ্গে অপ্রাপ্তি মিলিয়ে কাটল আরও একটি বছর। গভর্নর ফজলে কবিরকে পদে রাখতে খোদ বাংলাদেশ ব্যাংক অধ্যাদেশে পরিবর্তনও ছিল আলোচনার বিষয়। আর শেষ দিকে এসে অতিরিক্ত ১ শতাংশ অতিরিক্ত নিরাপত্তা সঞ্চিতি (প্রভিশন) রাখার নির্দেশনা। এসবের মধ্য দিয়েই ২০২০ সাল পার করল দেশের ব্যাংক খাত।

বছরের শুরুতে সুদহার নিয়ে বিতর্ক, মার্চে করোনাভাইরাসের কারণে স্থবিরতা, এপ্রিলে কম সুদের প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা ও ঋণ পরিশোধ না করলেও খেলাপি না হওয়ার সুযোগ প্রদান। বছরের মাঝামাঝি সময়ে এক্সিম ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালককে (এমডি) আটকে রেখে গুলি করার ঘটনা বড় বিতর্কের জন্ম দেয়। বছরজুড়ে আলোচনা ছিল এনআরবি গ্লোবাল ও রিলায়েন্স ফাইন্যান্সের সাবেক এমডি প্রশান্ত কুমার (পিকে) হালদারকে নিয়ে। গভর্নর ফজলে কবিরকে পদে রাখতে খোদ বাংলাদেশ ব্যাংক অধ্যাদেশে পরিবর্তনও ছিল আলোচনার বিষয়। আর শেষ দিকে এসে অতিরিক্ত ১ শতাংশ অতিরিক্ত নিরাপত্তা সঞ্চিতি (প্রভিশন) রাখার নির্দেশনা। এসবের মধ্য দিয়েই ২০২০ সাল পার করল দেশের ব্যাংক খাত।

বছরের প্রথম দিকে সুদহার নিয়ে বড় চাপে ছিল ব্যাংক খাত। আর করোনার কারণে সেবা দেওয়াটা চ্যালেঞ্জিং হয়ে দাঁড়ায়। এরই মধ্যে প্রণোদনা প্যাকেজ বাস্তবায়নের দায়িত্ব এসে পড়ে।
ব্যাংক এশিয়ার ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) আরফান আলী

বছরটি কেমন কাটল জানতে চাইলে ব্যাংক এশিয়ার ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) আরফান আলী প্রথম আলোকে বলেন, বছরের প্রথম দিকে সুদহার নিয়ে বড় চাপে ছিল ব্যাংক খাত। আর করোনার কারণে সেবা দেওয়াটা চ্যালেঞ্জিং হয়ে দাঁড়ায়। এরই মধ্যে প্রণোদনা প্যাকেজ বাস্তবায়নের দায়িত্ব এসে পড়ে। নতুন করে খেলাপি না হওয়ায় ব্যাংকগুলো একরকম স্বস্তিতে আছে, তবে অনাদায়ি ঋণের ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তিত। আর ১ শতাংশ অতিরিক্ত সঞ্চিতির সিদ্ধান্তটি ব্যাংকের ভিত্তি মজবুত করবে।

সুদের হার কমানো নিয়ে ২০১৯ সাল থেকে সরকার ও ব্যাংকমালিকদের মধ্যে দফায় দফায় আলোচনা হয়। সিদ্ধান্তও হয়, যদিও ব্যাংকগুলো তা মানেনি। অবশেষে চলতি ২০২০ সালের এপ্রিল থেকে ক্রেডিট কার্ড ছাড়া সব ঋণের সুদহার ৯ শতাংশে নির্দিষ্ট করে দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। সুদহার কমায় ব্যাংকগুলো ঋণ বিতরণ সীমিত করে ফেলে। আমানতের সুদও কমানো শুরু হয়। কোনো কোনো ব্যাংক আমানতের সুদহার কমিয়ে ৪-৫ শতাংশে নামিয়ে আনে। এতে বিপাকে পড়েন সাধারণ আমানতকারীরা।

এরপরও করোনাভাইরাসের মধ্যে ব্যাংকগুলোতে আমানত বাড়ে। ঋণ বিতরণ কমায় ব্যাংকে জমে যায় বিপুল অলস তারল্য। এতে ব্যাংকারদের কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়ে।
করোনাভাইরাসের কারণে সরকার ২৬ মার্চ থেকে ৩০ মে পর্যন্ত সাধারণ ছুটি ঘোষণা করে। তবে এই সময়ে ব্যাংক খোলা থাকায় গ্রাহকদের সেবা দিতে গিয়ে নতুন অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হন ব্যাংকাররা। করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা যান অনেক ব্যাংকার। করোনাকালে প্রায় সব ব্যাংকই ঘরে বসে হিসাব খোলাসহ নতুন নতুন ডিজিটাল সেবা নিয়ে আসে। চালু করে আরও বিভিন্ন ব্যাংকিং সেবা। এতে অনলাইনে লেনদেন বৃদ্ধি পায়।

আরও পড়ুন

করোনাভাইরাসের কারণে ২০২০ সালে নতুন করে কোনো ঋণখেলাপি হবে না বলে জানিয়ে দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। ফলে ঋণ শোধ না করেও এই বছরে খেলাপি হয়নি কেউ। আবার নতুন ঋণও পেয়েছেন। অর্থাৎ পুরো বছরেই ছিল ঋণখেলাপিদের জয়জয়কার।

করোনার কারণে কেউ নতুন প্রকল্প নেওয়ার সাহস করছেন না। ফলে চলতি বছরে ঋণের প্রবৃদ্ধি কম হয়েছে। যদিও আশা করা হয়েছিল, সুদহার কমায় ঋণ বাড়বে। আবার সুদহার কমানোর পরও আমানত বেড়েছে।
ডাচ্-বাংলা ব্যাংকের এমডি আবুল কাশেম মো. শিরিন

এদিকে করোনার মধ্যে নতুন একটি ব্যাংক ও একটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান চালুর অনুমোদন দিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বিস্ময়ের জন্ম দেয়। প্রতিষ্ঠান দুটি হলো সিটিজেন ব্যাংক ও স্ট্র্যাটেজিক ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট। বছরের শুরুতে অনুমোদন পায় বেঙ্গল কমার্শিয়াল ব্যাংক। ফলে দেশে ব্যাংকের সংখ্যা বেড়ে হয় ৬১টি ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান দাঁড়ায় ৩৫টি।

বছরজুড়ে আলোচনায় ছিল এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংক ও রিলায়েন্স ফাইন্যান্সের সাবেক এমডি প্রশান্ত কুমার (পিকে) হালদারের আর্থিক দুর্নীতি। তিনি কয়েকটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে প্রায় সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকা নিয়ে বিদেশে পালিয়ে যান। দেশে ফেরার জন্য চিঠি দিলেও তিনি ফেরেননি। কোনো টাকাও ফেরত দেননি। যে কারণে কমপক্ষে চারটি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের গ্রাহকেরা তাঁদের টাকা ফেরত পাচ্ছেন না।

আরও পড়ুন

মে মাসে সিকদার গ্রুপের মালিক জয়নুল হক সিকদারের দুই ছেলে রন হক সিকদার ও দিপু হক সিকদার এক্সিম ব্যাংকের এমডি মোহাম্মদ হায়দার আলী মিয়া ও অতিরিক্ত এমডি মোহাম্মদ ফিরোজ হোসেনকে গুলি করে হত্যার চেষ্টা চালান। তাঁরা নিজেদের বনানীর বাসায় দুই ব্যাংকারকে জোর করে আটক রেখেও নির্যাতন করেন। এরপর দুই ভাই রোগী সেজে দেশ ছেড়ে যান। এই ঘটনার ব্যাপক সমালোচনা হয়। এটি ব্যাংকারদের মাঝে ভয় ঢুকিয়ে দেয়।

আরও পড়ুন

ডাচ্-বাংলা ব্যাংকের এমডি আবুল কাশেম মো. শিরিন বলেন, ‘করোনার কারণে কেউ নতুন প্রকল্প নেওয়ার সাহস করছেন না। ফলে চলতি বছরে ঋণের প্রবৃদ্ধি কম হয়েছে। যদিও আশা করা হয়েছিল, সুদহার কমায় ঋণ বাড়বে। আবার সুদহার কমানোর পরও আমানত বেড়েছে। মনে করেছিলাম, প্রবাসী আয় কমবে, উল্টো তা বেড়েছে। ১ শতাংশ প্রভিশনিং রাখার সিদ্ধান্ত ভালো উদ্যোগ। এতে মুনাফা কমলেও ব্যাংকের ভিত্তি মজবুত হবে।’