এ পর্যন্ত আসতে অনেক সাহসী হতে হয়েছে, ঝুঁকি নিতে হয়েছে

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক নির্বাহী পরিচালক লীলা রশিদ। নারী হিসেবে ব্যাংকে নিজের কাজের নানা অভিজ্ঞতা ও চ্যালেঞ্জের কথা জানিয়েছেন প্রথম আলোকে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আরিফুর রহমান।

লীলা রশিদ, সাবেক নির্বাহী পরিচালক, বাংলাদেশ ব্যাংক

প্রশ্ন :

নারী হিসেবে ব্যাংকে আপনার কাজের অভিজ্ঞতার কথা বলুন।

আমি কাজ করেছি কেন্দ্রীয় ব্যাংকে। এটি একটি নিয়ন্ত্রক (রেগুলেটরি) সংস্থা, যেটি আর্থিক খাতের নীতিনির্ধারণে কাজ করে। আমি কখনো বাণিজ্যিক ব্যাংকে কাজ করিনি। বাংলাদেশ ব্যাংক আর বাণিজ্যিক ব্যাংক—এই দুটোর মধ্যে বড় ধরনের পার্থক্য রয়েছে। কারণ, বাণিজ্যিক ব্যাংকে কাজ করা নারীদের কর্মপরিবেশের ঝুঁকি তুলনামূলক বেশি। নারী হিসেবে সেই ঝুঁকি কেন্দ্রীয় ব্যাংকে আমাকে নিতে হয়নি।
বাংলাদেশ ব্যাংকে তুলনামূলক নারীবান্ধব পরিবেশ আছে। কিন্তু যতটা নারীবান্ধব পরিবেশ, সেই তুলনায় নারীদের উপস্থিতি কম। কেন্দ্রীয় ব্যাংকে সার্বিকভাবে নারী কর্মরত ২০ থেকে ২৫ শতাংশ। কিন্তু সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে এই অংশগ্রহণের হার ৪ থেকে ৫ শতাংশের বেশি হবে না। ২০২০ সালে আমাদের মধ্য থেকে একসঙ্গে চারজন নির্বাহী পরিচালক হতে পেরেছিলাম। এমন ঘটনা বাংলাদেশ ব্যাংকের ইতিহাসে আর নেই। আগামী কয়েক বছরেও এটা আর হবে কি না, সে বিষয়ে আমি সন্দিহান। কারণ, আমাদের পরের ব্যাচগুলোয় নারীর অংশগ্রহণ খুবই সামান্য।

আমি যখন (১৯৮৯) বাংলাদেশ ব্যাংকে যোগ দিই, তখনকার পরিবেশ আমাদের অনুকূলে ছিল না। আমাদের পরিবেশ তৈরি করে নিতে হয়েছে। কিন্তু যত ওপরের দিকে উঠেছি, কর্মপরিবেশে নানা ধরনের প্রতিবন্ধকতা ও নারী-পুরুষের বৈষম্য ধীরে ধীরে টের পেয়েছি। এতটুকু পর্যন্ত আসতে আমাকে অনেক সাহসী হতে হয়েছে, ঝুঁকি নিতে হয়েছে।

শ্রীলঙ্কা, ভারতসহ অনেক দেশেই কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনেক উচ্চ ও গুরুত্বপূর্ণ পদে নারীরা নিয়োগ পাচ্ছেন। কিন্তু বাংলাদেশে এসব পদে কেন নারীদের দেখা যায় না? যোগ্যতার অভাবে, নাকি আসতে পারেন না। সেটা খতিয়ে দেখা যেতে পারে। আমরা যে চারজন নারী বাংলাদেশ ব্যাংকে নির্বাহী পরিচালক হয়েছিলাম, আমরা আরও বেশি অবদান রাখতে পারতাম। কিন্তু আমাদের যোগ্যতা অনুযায়ী অবদান রাখতে পারিনি।

রাষ্ট্রায়ত্ত বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোয় অনেক নারী কর্মরত। কিন্তু সেখানে কোনো নারীকে ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) বা প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) পদে নিয়োগ দিয়েছে, আপনি মনে করতে পারবেন? আমি মনে করতে পারি না। প্রবাসীকল্যাণ ব্যাংকে শুধু একজন নারীকে দেখেছিলাম। সেটি তা-ও বিশেষায়িত ব্যাংক।

প্রশ্ন :

রাষ্ট্রায়ত্ত ও বাণিজ্যিক ব্যাংকে মেয়েরা যাঁরা আছেন, তাঁরা কেমন করছেন?

রাষ্ট্রায়ত্ত বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোয় অনেক নারী কর্মরত। কিন্তু সেখানে কোনো নারীকে ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) বা প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) পদে নিয়োগ দিয়েছে, আপনি মনে করতে পারবেন? আমি মনে করতে পারি না। প্রবাসীকল্যাণ ব্যাংকে শুধু একজন নারীকে দেখেছিলাম। সেটি তা-ও বিশেষায়িত ব্যাংক। অনেক নারী ব্যাংকারকে বলতে শুনেছি, আমরা আরও ওপরে যেতে পারতাম। কিন্তু পারিনি। যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও অনেকে এমডি হতে পারেননি। অথচ কম যোগ্য পুরুষ এমডি হয়ে গেছেন।

ব্যক্তিখাতে বাণিজ্যিক ব্যাংকে নারীদের চ্যালেঞ্জ অনেক বেশি। পরিশ্রম, ঝুঁকি, লক্ষ্যমাত্রা—সবকিছুই বেশি। কাজের পরিবেশটাও সেভাবে নারীবান্ধব নয়। সব মিলিয়ে ব্যাংক খাত পুরুষনিয়ন্ত্রিত জায়গা। মালিকানার দিক থেকে, কর্মসংস্থানের দিক থেকে কিংবা যাঁরা আর্থিক খাত থেকে সেবা নিচ্ছেন, সব অর্থেই ব্যাংক খাত পুরুষনিয়ন্ত্রিত জায়গা।

প্রশ্ন :

ব্যাংকে নারীরা সংখ্যার দিকে যথেষ্ট আসছে? আপনার মূল্যায়ন কী?

না। সংখ্যার দিক থেকে যথেষ্ট আসছে না। পুরো ব্যাংক খাতে একই চিত্র। আপনি বাণিজ্যিক ব্যাংকে ফ্রন্ট ডেস্ক, রিসেপশন, ক্যাশিয়ার পদে অনেক নারীকে দেখতে পাবেন। কিন্তু সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে নারীদের সংখ্যা খুবই কম। যদিও নিচের দিকে আছে। সিদ্ধান্ত গ্রহণের বিষয়ে নারীদের এখনো অনেক দূর যেতে হবে।

প্রশ্ন :

ব্যাংকে নারীদের পিছিয়ে থাকার কারণ ও সমস্যাগুলো কী?

আমি প্রথমেই বলব পুরো ব্যাংক খাত পুরুষনিয়ন্ত্রিত। দ্বিতীয়ত, সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি। তা ছাড়া ব্যাংকিং সেবা নেওয়ার ক্ষেত্রে নারীদের অংশগ্রহণও সামান্য। সেবা নেন পুরুষেরা। নারীদের জন্য ব্যাংকের পরিবেশটা এখন পর্যন্ত সেভাবে স্বস্তিদায়ক নয়, যে পরিবেশটা বাংলাদেশ ব্যাংকে আমার জন্য তুলনামূলক স্বস্তিদায়ক ছিল। নারীরা নিজ পরিবার থেকেও অনেক সময় সহযোগিতা পান না। তাঁদের মধ্যে ভীতি কাজ করে। নারীরা পূর্ণ স্বস্তি নিয়ে ব্যাংকে কাজ করার পরিবেশটা বাংলাদেশে এখনো তৈরি হয়নি। যেটা অনেক দেশে হয়েছে।

আমাদের যৌথ পরিবার ভেঙে যাচ্ছে। বাচ্চাকে আগে যেমন বাসাবাড়িতে নিরাপদে গৃহকর্মীর কাছে রেখে অফিসে যেতাম, সেটিও ভেঙে পড়েছে। গৃহকর্মীর প্রতি সন্দেহ তৈরি হয়েছে। আগের মতো বিশ্বস্ত গৃহকর্মী পাওয়াও যাচ্ছে না। রাষ্ট্র ও পরিবারের সহায়তা না পেলে মেয়েদের বেশি দূর যাওয়া কঠিন ব্যাপার। যে যায়, সে তার নিজের জীবন দিয়ে যায়। রাষ্ট্রের কাছ থেকে যত সাহায্য আসবে, যত দৃষ্টিভঙ্গি বদলাবে, তত নারীদের মধ্যে সচেতনতা আসবে। মেয়েরা আরও সাহসী হবে। পেছনের বাংলাদেশের দিকে তাকালে দেখি, বাংলাদেশ অনেক এগিয়েছে। কিন্তু আমরা আরও অনেক দূরে যেতে পারতাম।

প্রশ্ন :

ব্যাংকে নারীর অংশগ্রহণ কীভাবে বাড়ানো যেতে পারে। কোন কোন জায়গায় নজর দেওয়া জরুরি?

সাম্প্রতিক কালে ডে-কেয়ার নিয়ে সরকার একটা নীতিমালা করেছে। এটা খুবই ভালো উদ্যোগ। এতে সমস্যার অনেকটা সমাধান হবে। দেশে ই-কমার্সের বিকাশ ঘটছে। বাড়িতে রান্না না হলেও বাইরে থেকে খাবার আনার সুযোগ তৈরি হয়েছে। বাস, মেট্রোরেলসহ ভালো পরিবহন নারীদের এগিয়ে যাওয়া আরও সহজ হবে। তবে সবকিছুর আগে নারীদের সাহসী হতে হবে। কারণ, রাস্তা কেউ ছেড়ে দেয় না। আমার ৩২ বছরের কর্মজীবনে কেউ রাস্তা ছেড়ে দেয়নি। আমাকে ভয় পেলে চলবে না। রক্ষণশীল হলে চলবে না। সবকিছু রাষ্ট্র করে দেবে, আমি বসে থাকব—এমনটা ভেবে বসে থাকা উচিত নয়। আমারও দায়িত্ব আছে।

প্রশ্ন :

নতুন যাঁরা ব্যাংকে আসছেন, তাঁদের জন্য আপনার পরামর্শ কী?

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিবেশ এখন পর্যন্ত তুলনামূলক নারীবান্ধব। নতুনদের বলব, বাংলাদেশ ব্যাংকে যোগ দেন। দেশের উন্নয়নে বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখুন। আর বাণিজ্যিক ব্যাংকে আগ্রহীদের বলব, ঝুঁকি আগেও ছিল, এখনো আছে। ভবিষ্যতেও থাকবে। তারপরও বলব, পিছিয়ে থাকবেন না। কষ্ট করে হলেও ব্যাংকে আসতে হবে। ঝুঁকি নিতে হবে। দায়িত্ব নিতে হবে। কারণ, পরবর্তী প্রজন্মের জন্য রাস্তাটা তৈরি করে দেওয়ার দায়িত্বটা আমাদের।