করোনায় আমানতে টান

  • ব্যাংক খাতে আমানত বেড়েছে। তবে সেই ছাপ পড়েনি ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক খাতে। করোনার মধ্যে আর্থিক খাতের আমানত কমে গেছে।

  • জানা গেছে, এপ্রিল-জুন সময়ে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর আমানত কমেছে ৩৮০ কোটি টাকা।

  • এপ্রিল-জুন সময়ে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ঋণ কমেছে ৬২ কোটি টাকা। আমানত ও ঋণের হিসাবের সঙ্গে সুদ যুক্ত হয়ে হিসাব করা হয়।

করোনায় কমে গেছে অনেকের আয়। ফলে সঞ্চয়ও কমে যাওয়ার কথা। তবে সংকটে সঞ্চয় বাড়ে—এই প্রচলিত রীতি মেনে বাংলাদেশের ব্যাংক খাতেও আমানত বেড়েছে। যদিও সেই রীতির ব্যতিক্রম দেখা গেছে ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠান খাতে। গত জুন শেষে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে আমানত কমে গেছে। আর নতুন ঋণ না দেওয়ায় আদায় হওয়া ঋণের স্থিতিও কমে গেছে। ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর জুনভিত্তিক তথ্য পর্যালোচনায় এমন চিত্র পাওয়া গেছে।

খাতসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, দেশের কয়েকটি আর্থিক প্রতিষ্ঠানে বড় ধরনের অনিয়ম হয়েছে। এ কারণে কিছু আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে গ্রাহকেরা টাকা তুলে নিয়েছেন। আবার একইভাবে ব্যাংক ও অন্য প্রতিষ্ঠানগুলো যে আমানত রেখেছিল, সেগুলোরও মেয়াদ নবায়ন করেনি।

জানা গেছে, এপ্রিল-জুন সময়ে ব্যাংকগুলোতে আমানতের পরিমাণ বেড়েছে ৫৩ হাজার ৬৭০ কোটি টাকা। অন্যদিকে একই সময়ে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর আমানত কমেছে ৩৮০ কোটি টাকা। একই সময়ে ব্যাংকগুলোর ঋণ বেড়েছে ২৭ হাজার ৫৭৯ কোটি টাকা। তবে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ঋণ কমেছে ৬২ কোটি টাকা। আমানত ও ঋণের হিসাবের সঙ্গে সুদ যুক্ত হয়ে হিসাব করা হয়।

খাতসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, দেশের কয়েকটি আর্থিক প্রতিষ্ঠানে বড় ধরনের অনিয়ম হয়েছে। এ কারণে কিছু আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে গ্রাহকেরা টাকা তুলে নিয়েছেন। আবার একইভাবে ব্যাংক ও অন্য প্রতিষ্ঠানগুলো যে আমানত রেখেছিল, সেগুলোরও মেয়াদ নবায়ন করেনি। ফলে আর্থিক প্রতিষ্ঠানে আমানত কমেছে। খাত হিসেবে আমানত কমলেও সব আর্থিক প্রতিষ্ঠানের পরিস্থিতি এক নয়। করোনার মধ্যেও ভালো আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে আমানত বেড়েছে।

আর্থিক প্রতিষ্ঠানের প্রধান নির্বাহীদের সংগঠন বাংলাদেশ লিজিং অ্যান্ড ফিন্যান্স কোম্পানিজ অ্যাসোসিয়েশনের (বিএলএফসিএ) চেয়ারম্যান ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান আইপিডিসি ফাইন্যান্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মমিনুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে অনেক ব্যাংক টাকা তুলে নিয়েছে। এই কারণে আমানত কমে গেছে। এ ছাড়া কয়েকটি প্রতিষ্ঠান খারাপ হয়ে যাওয়ার প্রভাব তো আছেই। তবে সব প্রতিষ্ঠানের পরিস্থিতি এক নয়। ভালো আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর আমানত ও ঋণ বাড়ছে।

জানা গেছে, গত ডিসেম্বর শেষে দেশের সব আর্থিক প্রতিষ্ঠান মিলিয়ে মোট আমানতের পরিমাণ ছিল ৪৩ হাজার ১২১ কোটি টাকা। গত মার্চে তা বেড়ে হয় ৪৩ হাজার ৬৪৪ কোটি টাকা। তবে জুন শেষে আমানত কমে হয়েছে ৪৩ হাজার ২৬৪ কোটি টাকা। গত এপ্রিল-জুন সময়ে আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে সবচেয়ে বেশি টাকা তুলে নেয় সাধারণ আমানতকারী ও বেসরকারি বিভিন্ন ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান। এতে উল্লিখিত তিন মাসে ৩৭৯ কোটি টাকা আমানত কমে যায়।

একইভাবে এপ্রিল-জুন সময়ে আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ঋণও কমে। এই সময়ে বেসরকারি খাতের ঋণ কমলেও সরকারি খাতে ঋণ বাড়িয়েছে। সরকারি খাতে ঋণ ১২ হাজার ৩৪৮ কোটি থেকে বেড়ে হয় ১২ হাজার ৭৬১ কোটি টাকা। তবে বেসরকারি খাতে ঋণ ৫৭ হাজার ২২৪ কোটি থেকে কমে হয় ৫৬ হাজার ৭৫০ কোটি টাকা। অর্থাৎ সরকারি খাতে ঋণ ৪১৩ কোটি টাকা বাড়লেও বেসরকারি খাতে কমেছে ৪৭৪ কোটি টাকা। বর্তমানে দেশে ৩৬টি আর্থিক প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এর মধ্যে মানের দিক থেকে ভালো প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ১০টির কম।

ঠিক কী কারণে আমানত কমে গেছে, তা বলা সম্ভব নয়। তবে পিপলস লিজিংসহ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের কারণে আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ভাবমূর্তি–সংকট তৈরি হয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র সিরাজুল ইসলাম

জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র সিরাজুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘ঠিক কী কারণে আমানত কমে গেছে, তা বলা সম্ভব নয়। তবে পিপলস লিজিংসহ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের কারণে আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ভাবমূর্তি–সংকট তৈরি হয়েছে। তবে গ্রাহকের আস্থা ধরে রাখতে কাজ করছে বাংলাদেশ ব্যাংক।’

২০১৪ সালের জাতীয় নির্বাচনের আগে-পরে মিলিয়ে ইন্টারন্যাশনাল লিজিং, পিপলস লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস, এফএএস ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট ও বাংলাদেশ ইন্ডাস্ট্রিয়াল ফাইন্যান্স কোম্পানির (বিআইএফসি) শেয়ার নামে-বেনামে কিনে প্রতিষ্ঠানগুলো দখলে নেন প্রশান্ত কুমার (পিকে) হালদার।

২০১৪ সালের জাতীয় নির্বাচনের আগে-পরে মিলিয়ে ইন্টারন্যাশনাল লিজিং, পিপলস লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস, এফএএস ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট ও বাংলাদেশ ইন্ডাস্ট্রিয়াল ফাইন্যান্স কোম্পানির (বিআইএফসি) শেয়ার নামে-বেনামে কিনে প্রতিষ্ঠানগুলো দখলে নেন প্রশান্ত কুমার (পিকে) হালদার। এ চার প্রতিষ্ঠানের একটি এখন বিলুপ্তির পথে, বাকি তিনটিও গ্রাহকদের টাকা ফেরত দিতে পারছে না।
এদিকে, দেশের সব ব্যাংকে গত মার্চ শেষে আমানত ছিল ১২ লাখ ১০ হাজার ৪৯৭ কোটি টাকা। জুনে তা বেড়ে হয়েছে ১২ লাখ ৬৪ হাজার ১৬৭ কোটি টাকা। একইভাবে ঋণও ১০ লাখ ২১ হাজার ১০৯ কোটি টাকা থেকে বেড়ে হয়েছে ১০ লাখ ৪৮ হাজার ৬৮৮ কোটি টাকা।

আরও পড়ুন

ব্যাংকগুলোতে গত এপ্রিল থেকে ঋণের সুদ ৯ শতাংশ করা হয়েছে। এর ফলে ব্যাংকগুলোর আমানতের সুদ তলানিতে নেমে এসেছে। তাতে চাপে পড়েছে আমানতকারীরা। তবে সঞ্চয় ও বিনিয়োগের জন্য ব্যাংকের বাইরে ভালো কোনো মাধ্যম না থাকায় সাধারণ মানুষ ঘুরেফিরে ব্যাংকেই টাকা জমা রাখছেন। এ কারণে ব্যাংক খাতে আমানত বেড়েই চলেছে।

তবে অনিয়ম-দুর্নীতি ও গ্রাহকদের টাকা ফেরত দিতে না পারায় ভাবমূর্তি-সংকটে পড়েছে বেশির ভাগ আর্থিক প্রতিষ্ঠান। এর প্রভাব পড়েছে পুরো আর্থিক প্রতিষ্ঠান খাতে। পিপলস লিজিং অবসায়নের উদ্যোগ নেওয়ার পর আবার সেই সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসার পরিকল্পনা করছে সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংক।