কর্মীর বদলে যন্ত্রে ঝুঁকছে ব্যাংক

যন্ত্রই এখন টাকা গুনে জমা নিচ্ছে এবং দিচ্ছেও। এতে জাল টাকাও ধরা পড়ছে। সাম্প্রতিককালে এমন যন্ত্র স্থাপন বেড়ে দ্বিগুণ হয়েছে।

করোনাভাইরাসের কারণে ব্যাংকের গ্রাহকেরা এখন বেশ সতর্ক। তাঁদের অনেকেই আজকাল ব্যাংকে লাইনে দাঁড়িয়ে টাকা জমা দিতে বা ওঠাতে চাইছেন না। এ কারণে ব্যাংকগুলো যন্ত্রনির্ভর সেবায় বিনিয়োগ বাড়াচ্ছে। টাকা জমার জন্য এটিএম তো আগে থেকেই রয়েছে। এখন তাৎক্ষণিকভাবে গ্রাহকদের টাকা জমা নেওয়া ও উত্তোলন-সুবিধা দেওয়ার যন্ত্র ক্যাশ রি-সাইকেলার মেশিন (সিআরএম) স্থাপন করে চলেছে। সম্প্রতি এই যন্ত্র স্থাপন বেড়ে প্রায় দ্বিগুণ হয়ে গেছে। এই যন্ত্রে লেনদেনের পরিমাণও চার গুণের বেশি বেড়েছে।

ব্যাংকগুলোর সিআরএম স্থাপন বৃদ্ধি পাওয়ার ফলে গ্রাহকদের ব্যাংকে টাকা জমা করতে এখন আর ব্যাংকিং সময়ের জন্য অপেক্ষা করতে হচ্ছে না। কি রাত কি দিন, যেকোনো সময়ই টাকা লেনদেন করা যাচ্ছে।

দেশের আটটি ব্যাংক ইতিমধ্যে ক্যাশ রি-সাইকেলার মেশিন বা সিআরএম চালু করেছে। সিআরএম ১০, ২০, ৫০, ১০০, ৫০০ ও ১০০০ টাকার নোট গুনে নিচ্ছে এবং দিচ্ছেও। টাকা আসল না জাল, তা-ও ধরা পড়ছে সিআরএমে। জমার স্লিপে থাকছে টাকার নম্বরসহ কী পরিমাণ জমা হলো, তার হিসাব। যন্ত্রটি প্রতি সেকেন্ডে ৮-১০টি নোট গুনতে সক্ষম। জানা গেছে, বর্তমানে একটি সিআরএমের দাম ১৪-১৫ লাখ টাকা। আর একটি এটিএমের দাম ৪-৫ লাখ টাকা।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হিসাবে দেখা গেছে, গত বছরের সেপ্টেম্বরে দেশে ব্যাংকগুলোর মোট সিআরএম ছিল ২২৯টি। এ বছরের সেপ্টেম্বরে যা বেড়ে হয়েছে ৪৪৪টি। আর অক্টোবরে সিআরএম বেড়ে হয়েছে ৫৪৫টি। এক মাসেই শতাধিক যন্ত্র স্থাপন করেছে ব্যাংকগুলো। গত জুলাই, আগস্ট ও সেপ্টেম্বরেই সবচেয়ে বেশি সিআরএম চালু হয়েছে। গত বছরের সেপ্টেম্বরে যেখানে সিআরএমের মাধ্যমে জমা হয়েছিল ১৭০ কোটি টাকা, সেখানে এবার একই মাসে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৭০০ কোটি টাকা। অক্টোবরে লেনদেন বেড়ে হয়েছে ৮৮৫ কোটি টাকা।

‘যেসব শাখায় বেশি ভিড় হচ্ছে, আমরা সেখানেই সিআরএম বসিয়ে দিচ্ছি। একটি যন্ত্র দুজন ক্যাশ কর্মকর্তার কাজ করে। কোনো ঝুঁকি নেই। এ কারণে এই যন্ত্রে বিনিয়োগ বাড়াচ্ছি।
কামাল হোসেন, সাউথইস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক

এই যন্ত্র স্থাপনে শীর্ষ ব্যাংকগুলোর একটি বেসরকারি খাতের সাউথইস্ট ব্যাংক। ব্যাংকটির বর্তমানে ৮০টি সিআরএম চালু রয়েছে। আগামী মাসে চালু হবে আরও ৩০টি যন্ত্র। ব্যাংকটি রাজধানীর পাশাপাশি বিভাগীয় ও জেলা শহরেও সিআরএম বসিয়েছে।

জানতে চাইলে সাউথইস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক কামাল হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘যেসব শাখায় বেশি ভিড় হচ্ছে, আমরা সেখানেই সিআরএম বসিয়ে দিচ্ছি। একটি যন্ত্র দুজন ক্যাশ কর্মকর্তার কাজ করে। কোনো ঝুঁকি নেই। এ কারণে এই যন্ত্রে বিনিয়োগ বাড়াচ্ছি। এটা অব্যাহত থাকবে। করোনাভাইরাসের কারণে এখন সবাই যন্ত্রনির্ভর সেবায় নজর বাড়াচ্ছে।’

দেশে ১৯৯২ সাল পর্যন্ত টাকা জমা ও উত্তোলনের জন্য ব্যাংকের শাখাই ছিল একমাত্র ভরসা। ওই বছরে তৎকালীন এএনজেড গ্রিন্ডলেজ (বর্তমানে স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড) ব্যাংক প্রথম অটোমেটেড টেলার মেশিন (এটিএম) বুথ স্থাপন করে। এ সময় তারা ডেবিট কার্ডের পাশাপাশি ক্রেডিট কার্ডও চালু করে। এরপর এক এক করে অন্য ব্যাংকগুলোও এ সেবায় আসে।

আগে গ্রাহকদের ব্যাংকে টাকা জমা দিতে দীর্ঘ সময় লাগত। ২০১০ সালের দিকে ব্যাংকগুলো ক্যাশ ডিপোজিট মেশিন (সিডিএম) অর্থাৎ টাকা জমা দেওয়ার মেশিন বসানো শুরু করে। তবে এ সেবায় গ্রাহকেরা যন্ত্রে টাকা জমা দিলেও হিসাবে তাৎক্ষণিকভাবেই জমা হয় না। ব্যাংক কর্মকর্তারা দিনে একবার জমা করা টাকা শাখায় নিয়ে জমা করেন। দুপুরের পর টাকা জমা হলেই তা পরের দিনের হিসাবে চলে যায়। গত সেপ্টেম্বরে চালু থাকা সিডিএম ছিল ১ হাজার ৪৯৯টি। এ সেবায় শীর্ষে রয়েছে ডাচ্-বাংলা ও ইসলামী ব্যাংক।

সিডিএমে তাৎক্ষণিকভাবে টাকা জমা না হওয়ায় গ্রাহকেরা অনেক সময় সমস্যায় পড়েন। তাই সমস্যার সমাধানে ২০১৭ সাল থেকে সিআরএম যন্ত্র স্থাপন শুরু হয়। শুরুর দিকে ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ও দি সিটি ব্যাংক এই যন্ত্র স্থাপন করে। ধীরে ধীরে এখন আটটি ব্যাংক সিআরএম যন্ত্র স্থাপন করেছে। অন্য ছয়টি ব্যাংক হলো সাউথইস্ট, এনসিসি, ইসলামী, ইস্টার্ণ, মিউচুয়াল ট্রাস্ট ও ন্যাশনাল। শিগগিরই আরও কয়েকটি ব্যাংক এই যন্ত্র স্থাপন শুরু করবে। প্রতিটি সিআরএম ব্যাংকের কোনো না কোনো শাখার সঙ্গে যুক্ত থাকে।

বাংলাদেশের দুটি প্রতিষ্ঠান এই যন্ত্র আমদানি করে ও কারিগরি সহায়তা দেয়। কোম্পানি দুটি হচ্ছে জারা জামান টেকনোলজি ও টেকনো মিডিয়া লিমিটেড।

জারা জামান টেকনোলজির অপারেশন অ্যান্ড বিজনেস ডেভেলপমেন্ট বিভাগের প্রধান এস এম গিয়াস উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, করোনায় অনেক ব্যাংক খরচ করতে আগ্রহী হয়নি। তবে সম্প্রতি বেশ ভালো অর্ডার এসেছে। সব মিলিয়ে এখন পর্যন্ত প্রায় ৫০০ সিআরএম সরবরাহ করা হয়েছে।

‘করোনার মধ্যে অনেক ব্যাংক এই যন্ত্র স্থাপনের জন্য অস্থির হয়ে গেছে। আমরা এই সময়ে প্রায় ৫০০ যন্ত্র স্থাপন করেছি। সব কটি এখনো চালু হয়নি। আরও ১ হাজার যন্ত্র সরবরাহের অর্ডার পেয়েছি।
যশোদা জীবন দেবনাথ, টেকনো মিডিয়ার ব্যবস্থাপনা পরিচালক

টেকনো মিডিয়ার ব্যবস্থাপনা পরিচালক যশোদা জীবন দেবনাথ প্রথম আলোকে বলেন, ‘করোনার মধ্যে অনেক ব্যাংক এই যন্ত্র স্থাপনের জন্য অস্থির হয়ে গেছে। আমরা এই সময়ে প্রায় ৫০০ যন্ত্র স্থাপন করেছি। সব কটি এখনো চালু হয়নি। আরও ১ হাজার যন্ত্র সরবরাহের অর্ডার পেয়েছি। টাকা গণনা ও জাল টাকা ধরার সুবিধা থাকায় ব্যাংকগুলো এই যন্ত্রে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করছে।’