কাগুজে হিসাবে খেলাপি কম

  • খেলাপি ঋণ সামান্য কমে এখন ৯৪ হাজার ৪৪০ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ৮.৮৮ শতাংশ।

  • পুরো ব্যাংক খাতে নিরাপত্তা সঞ্চিতি সংরক্ষণ বা প্রভিশনিংয়ে ঘাটতি আছে ২,৬৪৪ কোটি টাকা।

করোনার কারণে বিশ্বের বড় ব্যাংকগুলো বিপুল অঙ্কের ঋণ অনাদায়ি হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা করছে। তাই আর্থিক অবস্থা ঠিকঠাক রাখতে এসব ব্যাংক আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি হারে নিরাপত্তা সঞ্চিতি সংরক্ষণ (প্রভিশনিং) করছে। কেউ এখন মুনাফার দিকে তাকাচ্ছে না। অনেক ক্ষেত্রে পরিচালকেরাও মুনাফার ভাগ নিচ্ছেন না। আবার শীর্ষ নির্বাহীদের সুযোগ-সুবিধা কমে যাওয়ার ঘটনাও দেখা গেছে।

তবে এমন সময়ে উল্টো চিত্র দেখা যাচ্ছে বাংলাদেশে। করোনার মধ্যেও ব্যাংক খাতের মুনাফায় বড় ধরনের উল্লম্ফন চলছে। অথচ এই সময়েই কিনা ব্যাংক খাতে ঋণ আদায় আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে কম। কারণ, এখন ঋণ শোধ না করলেও কেউ খেলাপি হচ্ছে না। এতে বাড়তি নিরাপত্তা সঞ্চিতি (প্রভিশনিং) রাখারও প্রয়োজন পড়ছে না। ফলে কাগুজে মুনাফা নিয়ে স্বস্তিতে রয়েছে কিছু ব্যাংক।

বিদ্যমান খেলাপি ঋণের বিপরীতে ব্যাংকগুলোর ৬৩ হাজার ৬৪৪ কোটি টাকা নিরাপত্তা সঞ্চিতি সংরক্ষণ করার কথা। তবে কয়েকটি ব্যাংকের কারণে পুরো ব্যাংক খাতে নিরাপত্তা সঞ্চিতি সংরক্ষণ বা প্রভিশনিংয়ে ঘাটতি হয়েছে ২ হাজার ৬৪৪ কোটি টাকা।

ঋণ শোধ না করলেও কেউ খেলাপি হচ্ছে না। বাড়তি নিরাপত্তা সঞ্চিতি রাখারও প্রয়োজন পড়ছে না। ফলে কাগুজে মুনাফায় স্বস্তি কিছু ব্যাংকের।

ব্যাংকের প্রধান নির্বাহীদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স, বাংলাদেশের (এবিবি) সাবেক চেয়ারম্যান আনিস এ খান মনে করেন, এ মুহূর্তে কোনো ঋণ খেলাপি হচ্ছে না। তাই খেলাপি ঋণ নিয়ে আলোচনা অর্থহীন। এ সময়ে শুধু শেয়ারবাজারের বিনিয়োগকারীদের জন্য কিছু লভ্যাংশ রেখে পুরো মুনাফা দিয়ে নিরাপত্তা সঞ্চিতি সংরক্ষণ (প্রভিশনিং) করা উচিত, যাতে ভবিষ্যতে সংকটেও ব্যাংকগুলো ঠিক থাকে।

এদিকে চলতি বছরের তৃতীয় প্রান্তিকে কিছু ব্যাংকের খেলাপি ঋণ বেড়েছে। খেলাপি ঋণ বৃদ্ধিতে শীর্ষ ১০ ব্যাংক হলো সোনালী, ফার্স্ট সিকিউরিটি, আল-আরাফাহ্, অগ্রণী, সাউথ বাংলা অ্যাগ্রিকালচার অ্যান্ড কমার্স, এবি, ওয়ান, সোশ্যাল ইসলামী, এইচএসবিসি ও মেঘনা ব্যাংক।

ব্যাংক কর্মকর্তারা অবশ্য বলছেন, নতুন করে খেলাপি ঋণ বাড়েনি। বেড়েছে সুদ। এ ছাড়া কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশে কিছু ঋণ খেলাপি দেখাতে হয়েছে।

করোনার কারণে অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে এমন বিবেচনায় গ্রাহকদের বিভিন্ন ছাড় দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এর মধ্যে অন্যতম হলো চলতি বছরের পুরো সময়ে গ্রাহক কিস্তি না দিলেও খেলাপি হবেন না। এর ফলে চলতি ২০২০ সালের তৃতীয় প্রান্তিক জুলাই-সেপ্টেম্বরে সার্বিকভাবে খেলাপি ঋণ কমেছে ১ হাজার ৬৭৭ কোটি টাকা। গত সেপ্টেম্বর শেষে খেলাপি ঋণ কমে হয়েছে ৯৪ হাজার ৪৪০ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ৮ দশমিক ৮৮ শতাংশ।

গত জুন শেষে ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ৯৬ হাজার ১১৭ কোটি টাকা, যা ওই সময় পর্যন্ত বিতরণ করা মোট ১০ লাখ ৪৯ হাজার ৭২৪ কোটি টাকা ঋণের ৯ দশমিক ১৬ শতাংশ। ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বর শেষে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ১ লাখ ১৬ হাজার ২৮৮ কোটি টাকা, যা ওই সময় পর্যন্ত বিতরণ করা ঋণের ১১ দশমিক ৯৯ শতাংশ।

এ সময় যেসব ঋণ আদায় করা যাচ্ছে না, তার জন্য বিশেষ ব্যবস্থা করতে হবে। এ জন্য কিস্তি শেষে কম সুদে নতুন করে ঋণ সৃষ্টি করা যেতে পারে। অথবা কিস্তির মেয়াদ বাড়ানো যেতে পারে। এতে ব্যবসায়ীদের ওপর চাপ কম পড়বে, ঋণও আদায় হবে।
আরফান আলী, এমডি, ব্যাংক এশিয়া।

গত সেপ্টেম্বর শেষে রাষ্ট্রমালিকানাধীন বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণ কিছুটা কমে ৪২ হাজার ৮৩৫ কোটি টাকা হয়েছে, যা মোট ঋণের ২২ দশমিক ৪৬ শতাংশ। আগের প্রান্তিক শেষে এসব ব্যাংকের খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ৪২ হাজার ৯৪০ কোটি টাকা। রাষ্ট্রমালিকানাধীন বিশেষায়িত দুই ব্যাংকের খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৪ হাজার ৫২০ কোটি টাকা। অন্যদিকে বেসরকারি খাতের ব্যাংকগুলোতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ আগের প্রান্তিকের ৪৬ হাজার ৫৯২ কোটি টাকা থেকে কমে জুলাই–সেপ্টেম্বরে ৪৫ হাজার ৩৭ কোটি টাকায় নেমেছে। বিদেশি ব্যাংকগুলোয় খেলাপি ঋণ ১৫ কোটি টাকা কমে ২ হাজার ৪৯ কোটি টাকা হয়েছে।

ব্যাংক কর্মকর্তারা বলেন, করোনাভাইরাসের কারণে যে প্যাকেজ নেওয়া হয়েছে, তা থেকে প্রায় ৮০ হাজার কোটি টাকা বিতরণ করা হয়েছে। তবে এসব ঋণ পেয়েছে বড় গ্রাহকেরা। যারা ঋণ পুনঃ তফসিল, পুনর্গঠন–সুবিধা নিয়েছিল, তারাও এ সুযোগ পেয়েছে। যদি কেন্দ্রীয় ব্যাংক খেলাপি না করার নির্দেশনা তুলে দেয়, তাহলে সামনের বছরের শুরুতে প্রকৃত চিত্র বেরিয়ে আসতে শুরু করবে।

জানতে চাইলে ব্যাংক এশিয়ার ব্যবস্থাপনা পরিচালক আরফান আলী প্রথম আলোকে বলেন, এই সময়ে যেসব ঋণ আদায় করা যাচ্ছে না, তার জন্য বিশেষ ব্যবস্থা করতে হবে। এ জন্য কিস্তি শেষে কম সুদে নতুন করে ঋণ সৃষ্টি করা যেতে পারে। অথবা কিস্তির মেয়াদ বাড়ানো যেতে পারে। এতে ব্যবসায়ীদের ওপর চাপ কম পড়বে, ঋণও আদায় হবে।