কার্ডে ঝুঁকছেন গ্রাহকেরা

আগে প্রতি মাসে ১৪–১৫ হাজার কোটি টাকা লেনদেন হতো। জুলাইয়ে তা ১৯ হাজার ৬২৫ কোটি টাকায় উঠেছে।

করোনাভাইরাসের কারণে ব্যাংকের লেনদেনে যে স্থবিরতা এসেছিল, তা মোটামুটি স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরেছে। তবে গ্রাহকেরা এখন শাখার পরিবর্তে অটোমেটেড টেলার মেশিন (এটিএম) ও পয়েন্ট অব সেলসে (পিওএস) গিয়েই টাকা উত্তোলন ও লেনদেন করতে বেশি আগ্রহী। এর বড় কারণ হলো শাখার চেয়ে এটিএম ও পিওএসে সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে চলা বেশি সহজ।

জানা গেছে, আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে গত জুলাইয়ে ডেবিট ও ক্রেডিট—উভয় ধরনের কার্ডেই সর্বোচ্চ লেনদেন হয়েছে। অবশ্য কার্ডের মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রার লেনদেন এখনো সর্বনিম্ন অবস্থানে। কারণ, দেশ থেকে মানুষের বিদেশে যাওয়া এবং বিদেশিদের এ দেশে আসা—দুটিই রয়েছে। পাশাপাশি বেশির ভাগ দেশে বিমান যোগাযোগ ও আন্তর্জাতিক কুরিয়ার সেবা বন্ধ থাকায় অনলাইন কেনাকাটা হচ্ছে না। এতে ব্যাংকগুলোর আয়ে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে, বিশেষ করে যাঁরা কার্ড সেবা বেশি দেয়, তাদের ওপর। কেননা কার্ডভিত্তিক বৈদেশিক লেনদেন থেকেই তারা সবচেয়ে বেশি আয় করে থাকে।

করোনার কারণে ব্যাংকগুলো এটিএম, পিওএস ও ক্যাশ ডিপোজিট মেশিন (সিডিএম) স্থাপন প্রায় বন্ধ করে দিয়েছিল। জুলাইয়ে এসে ব্যাংকগুলো আবার সেবা চ্যানেল বাড়াতে শুরু করেছে।

দেশে কার্ড সেবায় শীর্ষে রয়েছে বেসরকারি খাতের দি সিটি ব্যাংক। ব্যাংকটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাসরুর আরেফিন প্রথম আলোকে বলেন, আগের চেয়ে কার্ডের ব্যবহার বাড়ছে। কারণ করোনার ভয়ে এখনো অনেকে শাখায় গিয়ে সেবা নিতে চাইছেন না। ফলে বিকল্প সেবামাধ্যমের ব্যবহার বাড়ছে।

মাসরুর আরেফিন আরও বলেন, ‘বিদেশে যাওয়া বন্ধ, আবার বিদেশিরাও আসছেন না। ফলে আমাদের কার্ডে বিদেশি মুদ্রার লেনদেন ৫০ শতাংশের বেশি কমেছে। বিমান যোগাযোগ পুরোদমে চালু না হলে তা স্বাভাবিক হবে না।’

জানা গেছে, গত ফেব্রুয়ারিতে দেশে এটিএম বুথ ছিল ১১ হাজার ২টি, যা মার্চে বেড়ে হয় ১১ হাজার ৩৩টি। এপ্রিলে নতুন কোনো বুথ বসেনি, মে মাসে বুথ একটি বুথ কমে যায়। জুন মাসে এটিএম বুথ বেড়ে হয় ১১ হাজার ৪৭, আর জুলাইয়ে তা আরও বেড়ে দাঁড়ায় ১১ হাজার ১০৬টি।

আগের চেয়ে কার্ডের ব্যবহার বাড়ছে। কারণ, করোনার ভয়ে এখনো অনেকে শাখায় গিয়ে সেবা নিতে চাইছেন না। ফলে বিকল্প সেবামাধ্যমের ব্যবহার বাড়ছে।
মাসরুর আরেফিন, ব্যবস্থাপনা পরিচালক দি সিটি ব্যাংক

তবে ব্যাংকের পয়েন্ট অব সেলসে মিশ্র প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। গত ফেব্রুয়ারিতে পিওএস ছিল ৬৪ হাজার ৩৩৯, যা মার্চে বেড়ে হয় ৬৫ হাজার ১০৬টি। এরপরে পিওএসের সংখ্যা ক্রমান্বয়ে এপ্রিলে ৬৫ হাজার ৪৯৯, মে–তে ৬৫ হাজার ৬১৯, জুনে ৬৫ হাজার ৯৪৬টিতে ওঠে। তবে জুলাইয়ে আবার কমে ৬৫ হাজার ৬৮৩টিতে নেমে আসে।

ব্যাংকাররা বলছেন, অনেক প্রতিষ্ঠান স্থায়ীভাবে ব্যবসা বা শাখা বন্ধ করে ফেলছে। এ কারণে পিওএস কমেছে। আবার সিটি ব্যাংক পিওএসের পরিবর্তে কিউআর কোডের মাধ্যমে লেনদেন চালু করেছে। যার কারণে পিওএসের হিসাবে মিশ্র প্রবণতা দেখা যাচ্ছে।

এদিকে গত বছরের অক্টোবর থেকে এবারে জুন পর্যন্ত ব্যাংকগুলো নতুন করে তেমন ক্যাশ ডিপোজিট মেশিন (সিডিএম) স্থাপন করেনি। শুধু জুলাইয়ে নতুন ১৪টি সিডিএম বসেছে। এতে দেশে সিডিএমের সংখ্যা দাঁড়ায় ১ হাজার ৪২৩টি। শাখায় ভিড় এড়াতে অনেক ব্যাংক এখন সিডিএম স্থাপনে জোর দিচ্ছে।

ব্র্যাক ব্যাংকের এমডি সেলিম আর এফ হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, গ্রাহকেরা এখন অনলাইন সেবায় বেশি আগ্রহী হচ্ছেন। এ জন্য ব্যাংকগুলো এদিকে নজর দিচ্ছে।

* ব্যাংকের শাখার চেয়ে এটিএম বুথ ও পিওএসে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা সহজ। * বিমান চলাচল ও কুরিয়ার সেবা বন্ধ থাকায় কার্ডে বৈদেশিক মুদ্রার লেনদেন কমেছে।

গত মার্চ মাসে ব্যাংকগুলোর ডেবিট কার্ড ছিল ১ কোটি ৯৩ লাখ। এপ্রিল–মে মাসে তা ছিল ১ কোটি ৯৪ লাখের মধ্যে। জুনে কার্ড বেড়ে ১ কোটি ৯৭ লাখে এবং জুলাইয়ে ১ কোটি ৯৯ লাখে উন্নীত হয়।

ডেবিট কার্ডে আগে প্রতি মাসে ১৪ থেকে ১৫ হাজার কোটি টাকা লেনদেন হতো। তা করোনার কারণে এপ্রিলে কমে হয় ৮ হাজার ৩৩৫ কোটি টাকা। এরপরে মে মাসে প্রায় ১১ হাজার কোটি টাকা, জুনে ১২ হাজার কোটি টাকা এবং জুলাইয়ে ১৮ হাজার ১২৩ কোটি টাকা লেনদেন হয়।

ক্রেডিট কার্ড নতুন করে সেভাবে বাড়েনি। চলতি বছরের শুরুতে ক্রেডিট কার্ডে ১ হাজার ১০০ কোটি থেকে ১ হাজার ৩০০ কোটি টাকা লেনদেন হয়। এপ্রিলে তা কমে ৫২৩ কোটি টাকায় নেমে আসে। আর মে ৭১৩ কোটি টাকা, জুনে ৮৯৮ কোটি টাকা এবং জুলাইয়ে ১ হাজার ২৫২ কোটি টাকা লেনদেন হয়। একইভাবে প্রিপেইড কার্ডেও গত জুলাইয়ে লেনদেন যেকোনো সময়ের চেয়ে বেড়েছে।

সব মিলিয়ে গত জুলাইয়ে কার্ডের মাধ্যমে লেনদেন হয় মোট ১৯ হাজার ৬২৫ কোটি টাকা, যা এপ্রিলে ছিল ৮ হাজার ৯৪৭ কোটি টাকা। আগে প্রতি মাসে ১৪ থেকে ১৫ হাজার কোটি টাকা লেনদেন হতো।

কার্ডের মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রার লেনদেন অস্বাভাবিকভাবে কমে গেছে। প্রতি মাসে বৈদেশিক মুদ্রায় প্রায় ২০০ কোটি টাকা লেনদেন হতো। এপ্রিলে তা কমে হয় ৪০ কোটি টাকা। জুলাইয়ে অবশ্য বেড়ে ৬৬ কোটি টাকায় ওঠে। খুব দ্রুতই বৈদেশিক মুদ্রায় লেনদেন আগের ধারায় ফিরবে বলে মনে করেন না ব্যাংকাররা।

ব্যাংকাররা জানান, আগে অনেক গ্রাহক কার্ড নিতে চাইতেন না। এখন তাঁরা কার্ড নিতে চান। ফলে কার্ডের ব্যবহার বেড়েছে।

গত বৃহস্পতিবার রাতে ঢাকার কাফরুলে যমুনা ব্যাংকের বুথে টাকা তুলতে আসা শফিকুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘রাতে সড়কে লোকজন কম, বুথও ফাঁকা থাকে। এ জন্য টাকা তুলতে হলে রাতেই বের হই।’ করোনার কারণে ব্যাংক শাখায় যাননি বলে জানান তিনি।