গ্রুপ খেলাপি, তাই অন্যের নামে ঋণ

খেলাপি গ্রাহকের জামানতের বিপরীতে ঋণ দিয়েছে রূপালী ব্যাংক। গ্লোবাল ট্রেডিং হাউসের ঋণকে রতনপুর গ্রুপের হিসাবে বিবেচনায় নেওয়ার নির্দেশ।

রূপালী ব্যাংক

২০১৮ সালের ১৯ আগস্ট ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ১৩ নম্বর ওয়ার্ড থেকে ব্যবসা পরিচালনার লাইসেন্স নেয় গ্লোবাল ট্রেডিং হাউস নামের একটি কোম্পানি। পরের বছরের ৫ নভেম্বর রূপালী ব্যাংকের স্থানীয় শাখায় ১০০ কোটি টাকা ঋণ চেয়ে আবেদন করে প্রতিষ্ঠানটি। আবেদনে জানানো হয়, গ্লোবাল ট্রেডিং হাউস স্ক্র্যাপ আমদানি ও সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান। ব্যবসা সম্প্রসারণ ও চলতি মূলধনের জন্য ঋণ প্রয়োজন। ২০২০ সালের জানুয়ারিতে ৩৫ কোটি টাকা ঋণ অনুমোদন করা হয়। এক সপ্তাহের মধ্যে পুরো টাকা তুলে নেয় প্রতিষ্ঠানটি।

জানা গেছে, কাগজে-কলমে গ্লোবাল ট্রেডিং হাউসের মালিক আহসানুল মাহমুদ হলেও এই ঋণের জামানত হিসেবে যে জমি দেখানো হয়েছে, সেটি রতনপুর গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মাকসুদুর রহমানের। এই ঋণের জন্য তিনি ব্যক্তিগত গ্যারান্টি প্রদানের পাশাপাশি চট্টগ্রাম জেলার মিরসরাই উপজেলার ৬৫৬ শতাংশ জমি জামানত হিসেবে দেন। আবার আহসানুল মাহমুদ রতনপুর ফার্মস নামের একটি প্রতিষ্ঠানের পক্ষে সাউথ এশিয়া ইনস্যুরেন্সের পরিচালক। আবার এ বিমা কোম্পানিতে রতনপুর গ্রুপেরও অংশীদারত্ব রয়েছে।

এ অবস্থায় প্রশ্ন দেখা দিয়েছে, এ ঋণের আসল সুবিধাভোগী কি তবে রতনপুর গ্রুপ? তাই বাংলাদেশ ব্যাংক নির্দেশ দিয়েছে, গ্লোবাল ট্রেডিংয়ের ঋণ রতনপুর গ্রুপের ঋণ হিসেবে বিবেচনা করার। বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, যখন এই ঋণ অনুমোদন হয়, তখন রতনপুর গ্রুপ ঋণখেলাপি প্রতিষ্ঠান ছিল। তাই গ্রুপটি নতুন কোম্পানি গঠন করে ঋণ তুলে নিয়েছে বলে মনে করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

যোগাযোগ করা হলে রতনপুর গ্রুপের এমডি মাকসুদুর রহমান গত মঙ্গলবার রাতে প্রথম আলোকে বলেন, ‘আহসানুল মাহমুদ আমার পরিচিত ব্যবসায়ী। তবে এই ঋণের সুবিধাভোগী আমি না। পরিচিত হওয়ায় তাঁর ঋণের জন্য জামানত দিয়েছিলাম। তাঁদের সহায়তা করতে চেয়েছিলাম।’

‘আহসানুল মাহমুদ আমার পরিচিত ব্যবসায়ী। তবে এই ঋণের সুবিধাভোগী আমি না। পরিচিত হওয়ায় তাঁর ঋণের জন্য জামানত দিয়েছিলাম। তাঁদের সহায়তা করতে চেয়েছিলাম।
মাকসুদুর রহমান, রতনপুর গ্রুপের এমডি

রূপালী ব্যাংকের নথিপত্র অনুযায়ী, গ্লোবাল ট্রেডিং হাউসের স্বত্বাধিকারী আহসানুল মাহমুদ সাউথইস্ট মেটাল রিসাইক্লিং, আটলান্টিক রিসাইক্লিং, পাওয়ারকর স্টিল, চিটাগাং ইন্ডাস্ট্রিজ, আলফা ট্রেডিং হাউস প্রভৃতি প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক। এসব প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম সম্পর্কে খাতসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা তেমন কিছুই জানেন না।

গ্লোবাল ট্রেডিংয়ের ঋণ আবেদনের পর রূপালী ব্যাংকের স্থানীয় শাখা একটি পরিদর্শন প্রতিবেদন পর্ষদের কাছে জমা দেয়। ব্যাংকটির মহাব্যবস্থাপক খান ইকবাল হোসেন, উপমহাব্যবস্থাপক আমিনুল ইসলামের নেতৃত্বে গঠিত কমিটি তাদের প্রতিবেদনে বলেছে, ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা বিবেচনায় জামানতের মূল্যমান অনেক এবং ভবিষ্যতে তা আরও বাড়বে। এই কমিটি জামানতের মূল্য ৫৪ কোটি টাকা হতে পারে বলে জানায়। তবে তাৎক্ষণিক মূল্য ৪০ কোটি টাকা হতে পারে। সে অনুযায়ী গ্লোবাল ট্রেডিংয়ের নামে ৩৫ কোটি টাকার ঋণ অনুমোদন করে রূপালী ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ। যদিও ব্যাংকটির ঋণ নীতিমালা অনুযায়ী, জামানতের সর্বোচ্চ ৫০ শতাংশ ঋণ দেওয়ার সুযোগ রয়েছে। এর মানে, পরিচালনা পর্ষদ নীতিমালা লঙ্ঘন করেছে।

যখন এই ঋণ অনুমোদন হয়, ওই সময়ে সোনালী ও জনতা ব্যাংকে রতনপুর গ্রুপের ৪ প্রতিষ্ঠানের নেওয়া ঋণের পরিমাণ ছিল ১ হাজার ৫৮৫ কোটি টাকা। এর মধ্যে ১ হাজার ৫০৮ কোটি টাকাই খেলাপি ছিল। অর্থাৎ খেলাপি গ্রাহকের জামানতের বিপরীতে ঋণ অনুমোদন করে রূপালী ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ।

নিজে খেলাপি গ্রাহক হয়ে কীভাবে আরেকজনের ঋণে জামানত দিলেন, তা জানতে চাইলে মাকসুদুর রহমান বলেন, ‘আমার যে ঋণ রয়েছে, তা নিয়মিত করার প্রক্রিয়া চলছে। আর দু-তিনটি ব্যাংকে ঋণ নিয়মিত হলেই আমি খেলাপিমুক্ত হয়ে যাব। চলতি মাসেই সব ঋণ ঠিক হয়ে যাবে।’

কেন্দ্রীয় ব্যাংক সম্প্রতি রূপালী ব্যাংককে চিঠি দিয়ে জানায়, গ্লোবাল ট্রেডিং হাউস ও রতনপুর গ্রুপের একটির আর্থিক সচ্ছলতা-অসচ্ছলতা অপরটিকে প্রভাবিত করবে। ফলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নীতিমালা অনুযায়ী, ঋণটি রতনপুর গ্রুপের এবং এটাকে গ্রুপের ঋণ হিসেবে বিবেচনা করতে হবে। এর পরিপ্রেক্ষিতে ঋণ তথ্য ব্যুরোতে (সিআইবি) এই ঋণকে রতনপুর গ্রুপের ঋণ হিসেবে বিবেচনা করার নির্দেশ দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক।

ঋণটির বিষয়ে জানতে রূপালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ওবায়েদ উল্লাহ আল মাসুদের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়। তাঁর দপ্তর থেকে জানানো হয় তিনি অসুস্থ। পরে তাঁর মুঠোফোনে চেষ্টা করে সেটিও বন্ধ পাওয়া যায়।

২০১৫ সালে যে ১০ খেলাপি শিল্প গ্রুপের ১৫ হাজার কোটি টাকার ঋণ পুনর্গঠন করা হয়েছিল, তার মধ্যে রতনপুর গ্রুপ অন্যতম। গ্রুপের এমডি মাকসুদুর রহমান ছিলেন সাউথ বাংলা অ্যাগ্রিকালচার অ্যান্ড কমার্স (এসবিএসি) ব্যাংকের পরিচালক। তবে ঋণখেলাপি ও বেনামে শেয়ার ধারণের কারণে পরিচালক পদে তাঁর নাম অনুমোদন আটকে দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

‘প্রমাণ পাওয়ায় প্রতিষ্ঠানটির ঋণ রতনপুর গ্রুপের ঋণভুক্ত করতে বলা হয়েছে। পাশাপাশি আরও কিছু নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।’
সিরাজুল ইসলাম, বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র

এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংকের উদ্যোক্তা পরিচালক আমির হোসেনের হাতে যে শেয়ার রয়েছে, সে শেয়ারের মূলধন জোগান দেন মাকসুদুর রহমান। আমির হোসেন দেশে না থাকায় তাঁর পক্ষে ব্যাংকটির বিকল্প পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন মাকসুদুর রহমানের ছেলে মিজানুর রহমান। আবার আমির হোসেন তাঁর হাতে থাকা শেয়ারের বিপরীতে যে লভ্যাংশ পেয়েছেন, তা জমা হয়েছে এম রহমান স্টিল মিলের হিসাবে, যা মাকসুদুর রহমানের মালিকানাধীন রতনপুর গ্রুপের প্রতিষ্ঠান।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র সিরাজুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘প্রমাণ পাওয়ায় প্রতিষ্ঠানটির ঋণ রতনপুর গ্রুপের ঋণভুক্ত করতে বলা হয়েছে। পাশাপাশি আরও কিছু নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।’