দুর্বল ব্যাংকের অবসায়ন হবে

ব্যাংক কোম্পানি আইন আবার সংশোধন করা হচ্ছে। এবারে ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার নতুন ধারা যুক্ত হচ্ছে সংশোধনীতে। আবার কোনো ব্যাংক দুর্বল হয়ে পড়লে বা নিয়মকানুন মেনে চলতে না পারলে সেটির জন্য অবসায়নের পথও তৈরি করা হচ্ছে। এ জন্য আইনে নতুন ধারা যুক্ত করা হবে।

গত ৩০ বছরে ব্যাংক কোম্পানি আইন, ১৯৯১ এ যাবৎ কাটাছেঁড়া হয়েছে সাতবার। এর মধ্যে এক পরিবার থেকে চারজন এবং টানা নয় বছর ব্যাংকের পরিচালক থাকার সুযোগ দিয়ে করা হয়েছিল সর্বশেষ সংশোধনী। এবার হচ্ছে ব্যাংক কোম্পানি (সংশোধন) আইন, ২০২১।

জানতে চাইলে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব মো. আসাদুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘আর্থিক খাত সংস্কার নিয়ে যে কথা বলা হচ্ছে, সেটি মাথায় নিয়েই আইন করা হচ্ছে। আধুনিক বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে গেলে এ ছাড়া বিকল্প নেই।’

ব্যবস্থাপনার দুর্বলতা রোধে নতুন ধারা যুক্ত হচ্ছে ব্যাংক কোম্পানি আইনে। খসড়ায় বলা হয়েছে, যদি কোনো দুর্বল ব্যাংক মনে করে যে তার বিদ্যমান আর্থিক অবস্থা, অর্থাৎ তারল্য, সম্পদের গুণগত মান ও মূলধন পরিস্থিতি খারাপ হয়ে গেছে, বা সুশাসন বজায় রেখে পরিচালনা করা সম্ভব হচ্ছে না, কিংবা ব্যাংকটি আরও সংকটাপন্ন পরিস্থিতির দিকে যাচ্ছে, তাহলে ব্যাংক কর্তৃপক্ষ তা বাংলাদেশ ব্যাংককে জানাবে। তখন বাংলাদেশ ব্যাংক দুই বছর সময় দিয়ে পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে কি না দেখবে। সেই সঙ্গে ব্যাংকটিকে একটি পুনরুদ্ধার পরিকল্পনাও তৈরি করে দেওয়া হবে। চূড়ান্তভাবে ব্যর্থ হলে অবসায়নই হবে দুর্বল ব্যাংকটির অনিবার্য পরিণতি।

ব্যাংক কোম্পানি আইনের খসড়ায় ‘ইচ্ছাকৃত খেলাপি ঋণগ্রহীতা’র সংজ্ঞা দেওয়া হয়েছে। বলা হয়েছে, যিনি নিজের বা স্বার্থসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের অনুকূলে নামে-বেনামে বা অস্তিত্ববিহীন প্রতিষ্ঠানের নামে ঋণ নিয়ে সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও তা পরিশোধ করবেন না, তাঁকেই বলা হবে ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি।

খসড়ায় আরও বলা হয়েছে, ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিদের ব্যাপারে প্রতিটি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে দুটি করে কমিটি থাকবে। একটি কমিটি তাঁদের চিহ্নিত করবে, আরেকটি কমিটি তা চূড়ান্ত করবে। পরে প্রতিটি ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিদের তালিকা পাঠাবে বাংলাদেশ ব্যাংকে। তালিকা চূড়ান্ত হওয়ার পর সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি ৩০ দিনের মধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংকে আপিল করতে পারবেন। তবে এ ব্যাপারে বাংলাদেশ ব্যাংকের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত বলে গণ্য হবে।

নতুন আইন পাস হলে সরকারের বিভিন্ন সংস্থার কাছে ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিদের তালিকা পাঠাবে বাংলাদেশ ব্যাংক। এ ছাড়া কেন্দ্রীয় ব্যাংক ঋণখেলাপিদের বিদেশ ভ্রমণ, গাড়ি-বাড়ি নিবন্ধন ও ট্রেড লাইসেন্স এবং যৌথ মূলধন কোম্পানি ও ফার্মসমূহের নিবন্ধকের কার্যালয়ে (আরজেএসসি) নিবন্ধনে নিষেধাজ্ঞা আরোপের চিঠিও পাঠানো হবে।

খসড়া অনুযায়ী ইচ্ছাকৃত খেলাপিরা রাষ্ট্রীয়ভাবে কোনো সম্মাননা পাওয়ার বা রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণের যোগ্য বলে বিবেচিত হবেন না। তাঁরা কোনো পেশাজীবী, ব্যবসায়িক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক বা রাজনৈতিক সংগঠনের কোনো পদে থাকতে পারবেন না।

ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি হিসেবে তালিকাভুক্ত ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান ওই তালিকা থেকে অব্যাহতি পাওয়ার পাঁচ বছর পার না হওয়া পর্যন্ত কোনো ব্যাংক কোম্পানি বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানের পরিচালক হতে পারবেন না। কোনো ব্যাংকের কোনো পরিচালক ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি হিসেবে চিহ্নিত হলে বাংলাদেশ ব্যাংক তাঁর পরিচালক পদ শূন্য করতে পারবে।

আইন সংশোধনের বিষয়ে প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে অগ্রণী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শামস-উল-ইসলাম বলেন, ‘অবসায়নের নতুন ধারা যোগ করার প্রস্তাবটির সঙ্গে আমি একমত। তবে ঋণখেলাপি মানে ঋণখেলাপি, তা ইচ্ছাকৃত হোক আর অনিচ্ছাকৃতই হোক। ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিদের চিহ্নিত করা কঠিন হবে। তাই এ বিষয়ে আইন করার আগেই ভাবা দরকার।’

সরকার দুই বছর আগে থেকে ব্যাংক কোম্পানি আইন সংশোধনসহ ব্যাংক ও আর্থিক খাত–সম্পর্কিত ১৫টি আইন নিয়ে কাজ করছে। কাজ হচ্ছে অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের নেতৃত্বে, কিন্তু কাজ যেন শেষ হচ্ছে না।

ব্যাংক কোম্পানি, অর্থঋণ আদালত, দেউলিয়া, আমানত সুরক্ষা, জাল নোট প্রতিরোধ, মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ ইত্যাদি বিষয় আইনগুলোর সঙ্গে যুক্ত। এর মধ্যে বিদ্যমান কিছু আইন সংশোধন করা হচ্ছে, আর কিছু আইন করা হচ্ছে একেবারেই নতুন করে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত ডিসেম্বর পর্যন্ত খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৮৮ হাজার ৭৩৪ কোটি টাকা। কয়েকজন ব্যাংকার অবশ্য জানান, করোনার কারণে বিশেষ সুবিধা ও ছাড় দেওয়ার কারণে খেলাপি ঋণের পরিমাণ কম দেখাচ্ছে।

দেশে এখন পর্যন্ত ইচ্ছাকৃত খেলাপি ঋণের পরিমাণ নিয়ে যেমন কোনো গবেষণা হয়নি, তেমনি কোনো ব্যাংক অবসায়নের ঘটনাও ঘটেনি।