দেশের ৩৪টি বাজেটের সমান

ইন্টারন্যাশনাল কনসোর্টিয়াম অব ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিস্টস (আইসিআইজে) গতকাল ৯০টি দেশের সন্দেহজনক আর্থিক লেনদেনের তথ্য নিয়ে ‘ফিনসেন ফাইলস’ নামে বিপুল পরিমাণ গোপন নথি তাদের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করেছে। এসব লেনদেনের সঙ্গে জড়িত হিসেবে বিশ্বের খ্যাতনামা ব্যাংকেরও নাম উঠে এসেছে।
  • ‘ফিনসেন ফাইলস’ নামে গোপন নথি ফাঁস করেছে বিশ্বব্যাপী অনুসন্ধানী সাংবাদিকদের জোট আইসিআইজে।

  • এতে দুই ট্রিলিয়ন (এক ট্রিলিয়নে এক লাখ কোটি) ডলারের বেশি সন্দেহজনক আর্থিক লেনদেনের তথ্য উঠে এসেছে।

  • লেনদেনগুলো ঘটে ১৯৯৯ থেকে ২০১৭ সালের মধ্যে।

  • যে পরিমাণ অর্থের সন্দেহজনক লেনদেনের তথ্য উঠে এসেছে, তা দিয়ে বাংলাদেশের পাঁচ লাখ কোটি টাকার ৩৪টি বাজেট করা যাবে।

পানামা পেপারস ও প্যারাডাইস পেপারসের ধারাবাহিকতায় ‘ফিনসেন ফাইলস’ নামে নতুন করে আর্থিক লেনদেনের গোপন নথি প্রকাশ করেছে সাংবাদিকদের বৈশ্বিক জোট ইন্টারন্যাশনাল কনসোর্টিয়াম অব ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিস্টস (আইসিআইজে)। আইসিআইজে গতকাল সোমবার তাদের ওয়েবসাইটে বিশ্বের ৯০টি দেশের এই নথি প্রকাশ করে। এতে দুই ট্রিলিয়ন (এক ট্রিলিয়নে এক লাখ কোটি) ডলারের বেশি সন্দেহজনক আর্থিক লেনদেনের তথ্য উঠে এসেছে। আর লেনদেনগুলো ঘটে ১৯৯৯ থেকে ২০১৭ সালের মধ্যে।

আইসিআইজের নথিতে যে পরিমাণ অর্থের সন্দেহজনক লেনদেনের তথ্য উঠে এসেছে, তা দিয়ে বাংলাদেশের পাঁচ লাখ কোটি টাকার ৩৪টি বাজেট করা যাবে। প্রতি ডলারের বিনিময়মূল্য ৮৫ টাকা ধরে এ হিসাব করা হয়েছে।

যুক্তরাষ্ট্রের ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে দেশটির আর্থিক দপ্তর অর্থাৎ ডিপার্টমেন্ট অব ট্রেজারির ফিন্যান্সিয়াল ক্রাইম এনফোর্সমেন্ট নেটওয়ার্কের (ফিনসেন) কাছে বাধ্যতামূলকভাবে লেনদেনের তথ্য জানাতে হয়। ফিনসেনের সেসব তথ্য থেকেই সন্দেহজনক লেনদেনের পুরো নথি প্রথমে ফাঁস করে যুক্তরাষ্ট্রের বাজফিড নিউজ। বাজফিড পরে তা দিয়েছে আইসিআইজের কাছে। আইসিআইজের ৪০০ জনের দল এ নিয়ে ১৬ মাস ধরে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অনুসন্ধান চালায়। যেহেতু ফিনসেনের তথ্য ফাঁস হয়েছে, আইসিআইজে তাই এর নামও দিয়েছে ‘ফিনসেন ফাইলস’।

২ হাজার ৫০০ পৃষ্ঠার ফিনসেন ফাইলে অনুল্লেখ আকারে হলেও বাংলাদেশের নাম আছে। যার মধ্যে রয়েছে ২০১৪ থেকে ২০১৬ সালে বাংলাদেশের ৮ লাখ ৩২ হাজার ৯৩৭ ডলারের মোট ৮টি সন্দেহজনক ব্যাংক লেনদেনের তথ্য।
আইসিআইজে বলেছে, বিশ্বজুড়েই বর্তমানে সন্দেহজনক লেনদেনের বন্যা বইছে। দুই ট্রিলিয়ন ডলার তার একটি ফোঁটা মাত্র। কারণ, ২০১১ থেকে ২০১৭ সালের মধ্যে ফিনসেনে যত প্রতিবেদন এসেছে, সে তুলনায় তা খুবই সামান্য।

ফাঁস হওয়া নথিতে শীর্ষ ১০ সন্দেহজনক লেনদেন হয়েছে ডয়চে ব্যাংক, বিনিয়োগ ব্যাংক জেপি মরগান চেস, স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড, ব্যাংক অব নিউইয়র্ক মেলন, বার্কলেস, সোসিয়েট জেনারেল, এইচএসবিসি, স্টেট স্ট্রিট করপোরেশন, কমার্সব্যাংক এজি এবং চীনা ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশনে। তবে ফিনসেনে সবচেয়ে বেশি অর্থাৎ ৯৮২টি প্রতিবেদন এসেছে ডয়েচে ব্যাংকের বিষয়ে। এ ছাড়া ব্যাংক অব নিউইয়র্ক মেলন নিয়ে ৩২৫ এবং স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ২৩২, জেপি মরগান ১০৭, বার্কলেস ১০৪ এবং এইচএসবিসি নিয়ে ৭৩টি প্রতিবেদন পায় ফিনসেন।

আইসিআইজে গতকাল আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ করলেও এসব সন্দেহজনক লেনদেন বিভিন্ন দেশের পত্র-পত্রিকায় আগে থেকেই প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়ে আসছিল। জানা গেছে, গত বৃহস্পতি ও শুক্রবার জার্মানির ডয়চে ব্যাংকের সদর দপ্তরে ১৭০ জন পুলিশ, কর কর্মকর্তা ও আইনজীবী সন্দেহজনক লেনদেনের বিষয়ে তল্লাশি চালিয়েছেন।

আরও পড়ুন
২০১৩ সালে কর ফাঁকি দিয়ে অবৈধ অর্থ পাচারের দায়ে এইচএসবিসিকে ১৯০ কোটি ডলার জরিমানা করে যুক্তরাষ্ট্র। এর পরপরই পঞ্জি স্কিমের ঘটনা ঘটে। এই স্কিমে দ্বিগুণ লাভের ঘোষণা দিয়ে একজন একটি বিনিয়োগ হিসাব চালু করে। এই হিসাব থেকে অর্থ কোনো ব্যবসায় বিনিয়োগ করা হয় না। বরং অন্যদের বিনিয়োগের অর্থ দিয়ে আগের বিনিয়োগকারীদের দ্বিগুণ ফেরত দেওয়া হয়।

জালিয়াতির বিষয় জানার পরও কয়েক কোটি ডলার স্থানান্তর করার অনুমতি দেয় এইচএসবিসি ব্যাংক। ব্যাংকটি তাদের মার্কিন ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে ৮ কোটি ডলার হংকংয়ের এইচএসবিসি ব্যাংকের একটি হিসাবে স্থানান্তর করে।

২০১৩ সালে কর ফাঁকি দিয়ে অবৈধ অর্থ পাচারের দায়ে এইচএসবিসিকে ১৯০ কোটি ডলার জরিমানা করে যুক্তরাষ্ট্র। এর পরপরই পঞ্জি স্কিমের ঘটনা ঘটে। এই স্কিমে দ্বিগুণ লাভের ঘোষণা দিয়ে একজন একটি বিনিয়োগ হিসাব চালু করে। এই হিসাব থেকে অর্থ কোনো ব্যবসায় বিনিয়োগ করা হয় না। বরং অন্যদের বিনিয়োগের অর্থ দিয়ে আগের বিনিয়োগকারীদের দ্বিগুণ ফেরত দেওয়া হয়। একসময় নতুন বিনিয়োগকারী আসে না, ফলে ভেঙে পড়ে পঞ্জি স্কিম। ধোঁকা খাওয়া ব্যক্তিদের আইনজীবীরা বলছেন, ব্যাংকের উচিত ছিল সঙ্গে সঙ্গেই প্রতারকদের হিসাবগুলো বন্ধ করে দেওয়া। অথচ ব্যাংকটি তা করেনি।

মালিকানা জানা না থাকা সত্ত্বেও জেপি মরগান একটি কোম্পানিকে ১০০ ডলারের বেশি অর্থ তাদের লন্ডন শাখার মাধ্যমে স্থানান্তরের অনুমতি দিয়েছে। পরে ব্যাংকটি জানতে পারে কোম্পানির মালিক খুব সম্ভবত মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা এফবিআইএর মোস্ট ওয়ান্টেডের শীর্ষ দশের তালিকায় থাকা একজন।

মার্কিন রাষ্ট্রপতি ডোনাল্ড ট্রাম্পের সাবেক প্রচার ব্যবস্থাপক পল ম্যানাফোর্টের জন্য জেপি মরগান ৫ কোটি ডলারের বেশি অর্থ লেনদেন করেছে।

নথিতে বলা হয়, রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের ঘনিষ্ঠ সহযোগী তাঁর বিরুদ্ধে পশ্চিমা দেশের র্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা এড়াতে লন্ডনের বার্কলেস ব্যাংককে ব্যবহার করছেন। এর মধ্যে কিছু অর্থ শিল্পকর্ম কিনতে ব্যবহার করা হয়েছে।

ফিনসেনের গোয়েন্দা বিভাগ যুক্তরাজ্যকে সাইপ্রাসের মতোই ঝুঁকিপূর্ণ বিচারব্যবস্থার অধিকারী বলে আখ্যায়িত করেছে। কারণ সন্দেহজনক কার্যকলাপের প্রতিবেদনে (এসএআরএস) যুক্তরাজ্যের নিবন্ধিত কোম্পানির সংখ্যা খুব বেশি।

আরও পড়ুন