নতুন নিয়মে চাপে পড়বে দেশের ব্যাংক খাত

একদিকে আমানত কমে যাওয়া, অন্যদিকে ছোট ঋণ ও ক্রেডিট কার্ড ব্যবসা মন্থর হয়ে পড়ার আশঙ্কায় রয়েছেন ব্যাংকাররা।

নতুন বাজেটে শর্তারোপ

  • পাঁচ লাখ টাকার বেশি ঋণ নিতে রিটার্ন জমা দিতে হবে।

  • ক্রেডিট কার্ড নিতেও আয়কর রিটার্ন জমা দেওয়া বাধ্যতামূলক।

  • প্রাতিষ্ঠানিক আমানতে উৎসে কর ১০% থেকে বেড়ে ২০%।

  • ৫ কোটি টাকার আমানতে আবগারি শুল্ক ৪০ হাজার থেকে বেড়ে হয়েছে ৫০ হাজার টাকা।

আপনি ১৫-২০ হাজার টাকা বেতনে চাকরি করেন। হঠাৎ প্রয়োজনে ব্যাংক থেকে ঋণ নিতে চাইছেন। কিন্তু ঋণের পরিমাণ পাঁচ লাখ টাকার বেশি হলেই এখন আপনাকে আয়কর রিটার্ন দাখিল করতে হবে। না হলে ব্যাংক ঋণ দেবে না। কারণ, রিটার্ন ছাড়া ঋণ দিলে সংশ্লিষ্ট ব্যাংককে ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত জরিমানা করতে পারবে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)।

অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল আগামী ২০২২-২৩ অর্থবছরের জাতীয় বাজেটে এমন প্রস্তাবই রেখেছেন। এতে ব্যাংকগুলো ছোট ঋণের ব্যবসা কমার আশঙ্কায় ভুগছে।

একইভাবে ক্রেডিট কার্ড পেতে আগ্রহী গ্রাহকদের জন্যও আয়কর রিটার্ন জমা দেওয়া বাধ্যতামূলক করার প্রস্তাব রয়েছে বাজেটে। ব্যাংকগুলো ২০ হাজার টাকা আয় করেন, এমন ব্যক্তির নামেও ক্রেডিট কার্ড ইস্যু করে। ফলে দেশে ক্রেডিট কার্ড গ্রাহকের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৯ লাখে, যার বড় অংশই মধ্যবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্ত।

দেশে নগদ টাকার লেনদেন কমাতে হলে ক্রেডিট কার্ডের ব্যবহার বাড়াতে হবে। আর ছোট ঋণ মেটায় তাৎক্ষণিক চাহিদা। রিটার্ন দিতে হলে এসব সেবায় প্রবৃদ্ধি স্বাভাবিকভাবেই কমে যাবে। ব্যাংকের পাশাপাশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে সাধারণ জনগণও। উৎসে কর ও আবগারি শুল্ক বাড়ালে আমানতও কমতে পারে।
সৈয়দ মাহবুবুর রহমান, মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি)

ব্যাংকাররা বলেন, বাজেটে ব্যাংক খাত থেকে বিভিন্ন উপায়ে কর আহরণের লক্ষ্য বাড়ানো হয়েছে। এর ফলে ব্যাংকের আমানতেও বড় ধাক্কা লাগতে পারে। ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের ছোট ঋণ ও কম আয়ের গ্রাহকদের ক্রেডিট কার্ড পাওয়া কঠিন হয়ে যাবে। এতে ব্যাংকের ব্যবসা কমবে। দেশের অর্থনীতিতেও নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। তাঁরা বলছেন, প্রস্তাবিত বাজেটে ব্যাংক খাত সংস্কারের কোনো উদ্যোগ নেই। চলমান আইনি সংস্কারের কথাই তুলে ধরা হয়েছে।

ব্র্যাক ব্যাংকের রিটেইল ব্যাংকিং বিভাগের প্রধান মাহীয়ুল ইসলাম বলেন, অর্থনীতি চাঙা রাখতে ছোট অঙ্কের ঋণ ও ক্রেডিট কার্ডে প্রবৃদ্ধি জরুরি। যাঁরা ১৫-২০ হাজার টাকা আয় করেন, তাঁরা ছোট ঋণ ও কার্ড নিতে পারেন। এসব সেবা নিতে তাঁরা কর শনাক্তকরণ নম্বর (টিআইএন) নেন, তবে রিটার্ন দেন না। এখন রিটার্ন জমা বাধ্যতামূলক করা হলে এসব সেবায় প্রবৃদ্ধি বাধাগ্রস্ত হবে।

এদিকে প্রস্তাবিত বাজেটে ব্যাংকগুলোয় প্রাতিষ্ঠানিক যে আমানত আছে, তার সুদের ওপর উৎসে কর ১০ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ২০ শতাংশ করার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া ব্যাংক হিসাবে ৫ কোটি টাকার বেশি স্থিতির ওপর আবগারি শুল্ক ৪০ হাজার টাকা থেকে বাড়িয়ে ৫০ হাজার টাকা করার প্রস্তাব রেখেছেন অর্থমন্ত্রী।

মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) সৈয়দ মাহবুবুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, দেশে নগদ টাকার লেনদেন কমাতে হলে ক্রেডিট কার্ডের ব্যবহার বাড়াতে হবে। আর ছোট ঋণ মেটায় তাৎক্ষণিক চাহিদা। রিটার্ন দিতে হলে এসব সেবায় প্রবৃদ্ধি স্বাভাবিকভাবেই কমে যাবে। ব্যাংকের পাশাপাশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে সাধারণ জনগণও। উৎসে কর ও আবগারি শুল্ক বাড়ালে আমানতও কমতে পারে। এতে ব্যাংকের বাইরে চলে যেতে পারে আমানত।

কয়েকটি ব্যাংকের ট্রেজারি বিভাগের কর্মরত ব্যক্তিরা জানান, ব্যাংকে যে আমানত আছে, তার ২৫-৩০ শতাংশ প্রাতিষ্ঠানিক। আর পাঁচ কোটি টাকার বেশি আমানতের বেশির ভাগ সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের। এসব আমানত দীর্ঘমেয়াদি ও বেশি সুদের। সহসাই উত্তোলন করা হয় না। এই আমানতের বিপরীতে দীর্ঘমেয়াদি ঋণ ও বন্ডে বিনিয়োগ করে ব্যাংকগুলো। এখন এসব আমানত কমে গেলে ব্যাংক খাতের স্বাস্থ্য আরও দুর্বল হয়ে পড়বে। এমনিতে সুদের হার বাড়তে থাকায় আয় কমে যাচ্ছে। সুদহারের সীমা তুলে নেওয়ার সময় হয়েছে।

এ নিয়ে জানতে চাইলে ব্যাংক এশিয়ার এমডি আরফান আলী বলেন, বাজেটে ব্যাংক খাতের প্রতিষ্ঠানগুলোর আমানতের সুদের ওপর উৎসে কর বাড়ানো হলে আমানত কিছুটা কমতে পারে। ব্যাংকগুলোয় যে করপোরেট আমানত রয়েছে, তাতে ধাক্কা লাগতে পরে। তবে ধনীদের ওপর সরকারের শুল্ক বাড়ানোটা ভালো উদ্যোগ। আর বিভিন্ন সেবায় রিটার্ন জমা দেওয়ার যে শর্ত দেওয়া হয়েছে, সেটাও ভালো দিক।