নেপালি ধনকুবেরের স্ত্রী কিনছেন বাংলাদেশি প্রতিষ্ঠানের শেয়ার

—১৯৯৪ সালে প্রতিষ্ঠা হয় নেপাল বাংলাদেশ ব্যাংক।

—এখন আইএফআইসি ব্যাংকের হাতে ব্যাংকটির ৪০.৯১% শেয়ার রয়েছে।

—৪৪০ কোটি টাকায় আইএফআইসি ব্যাংকের হাতে থাকা শেয়ার কিনছে নেপালের ধনকুবের বিনোদ চৌধুরীর স্ত্রী সারিকা চৌধুরী।

নেপাল-বাংলাদেশ ব্যাংক (এনবিবি)
ছবি: সংগৃহিত

নেপালে প্রতিষ্ঠিত নেপাল-বাংলাদেশ ব্যাংকের (এনবিবি) মালিকানা ছেড়ে দিচ্ছে বাংলাদেশের আইএফআইসি ব্যাংক। আইএফআইসির হাতে থাকা ব্যাংকটির ৪১ শতাংশ শেয়ার কিনে নিচ্ছেন নেপালের একমাত্র ধনকুবের বিনোদ চৌধুরীর স্ত্রী সারিকা চৌধুরী। ৬১৮ কোটি নেপালি রুপিতে তিনি এ শেয়ার কিনছেন। বাংলাদেশি টাকায় যার পরিমাণ প্রায় ৪৪০ কোটি টাকা। ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে (ডিএসই) তালিকাভুক্ত আইএফআইসি ব্যাংক গতকাল বিনিয়োগকারীদের এ তথ্য জানিয়েছে।

বিনোদ চৌধুরীর পরিবার আগে থেকেই নেপালের নাবিল ব্যাংকের মালিকানার সঙ্গে যুক্ত। এখন নেপাল-বাংলাদেশ ব্যাংকের মালিকানায় যুক্ত হচ্ছে তাঁর পরিবার। আর নাবিল ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত হতে ইতিমধ্যে চুক্তি করেছে নেপাল-বাংলাদেশ ব্যাংক। ফলে আইএফআইসি ব্যাংকের হাতে থাকা শেয়ার ছেড়ে দেওয়ার পর ব্যাংকটি থেকে বাংলাদেশের নাম বাদ যাবে। নেপাল–বাংলাদেশ ব্যাংকের নাম বদলে নাবিল ব্যাংক হয়ে যাবে।

শেয়ার বিক্রি করে দেওয়ার পেছনে নির্দিষ্ট কোনো কারণ নেই। সামনে অন্য দেশের ব্যাংকে বিনিয়োগের পরিকল্পনা আছে আমাদের। এ জন্যই পরিচালনা পর্ষদ ব্যাংকটির মালিকানা ছেড়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ভালো মুনাফাতেই ব্যাংকটির শেয়ার বিক্রি করা হচ্ছে।
শাহ আলম সারওয়ার, আইএফআইসি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও নেপাল-বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিচালক

নেপাল-বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিষ্ঠার শুরু থেকেই এটির মালিকানায় যুক্ত বাংলাদেশের আইএফআইসি ব্যাংক। কয়েক দফায় বাংলাদেশ থেকে বিনিয়োগ নিয়েছে ব্যাংকটি, সেই বিনিয়োগের বিপরীতে বছর বছর মুনাফাও পেয়েছে।

এখন এসে ঠিক কী কারণে ব্যাংকটির মালিকানা ছেড়ে দিচ্ছে আইএফআইসি, এ নিয়ে রয়েছে নানা জল্পনাকল্পনা। এ বিষয়ে জানতে চাইলে আইএফআইসি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও নেপাল-বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিচালক শাহ আলম সারওয়ার প্রথম আলোকে বলেন, ‘শেয়ার বিক্রি করে দেওয়ার পেছনে নির্দিষ্ট কোনো কারণ নেই। সামনে অন্য দেশের ব্যাংকে বিনিয়োগের পরিকল্পনা আছে আমাদের। এ জন্যই পরিচালনা পর্ষদ ব্যাংকটির মালিকানা ছেড়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ভালো মুনাফাতেই ব্যাংকটির শেয়ার বিক্রি করা হচ্ছে।’

আইএফআইসি ব্যাংকের একটি সূত্র জানায়, নেপালের ব্যাংকটির শেয়ার ছাড়ার পর শ্রীলঙ্কা ও উজবেকিস্তানের দুটি ব্যাংকের শেয়ার কেনার পরিকল্পনা রয়েছে আইএফআইসির। এ জন্য প্রক্রিয়াও শুরু হয়েছে।

অবশ্য নেপাল-বাংলাদেশ ব্যাংকের পাশাপাশি পাকিস্তানের এমসিবি ব্যাংক, ওমানের ওমান এক্সচেঞ্জ এলএলসিতেও মালিকানা রয়েছে আইএফআইসি ব্যাংকের। আইএফআইসি ব্যাংক বেসরকারি খাতের ব্যাংক হলেও এটির ৩২ দশমিক ৭৫ শতাংশ শেয়ারের মালিকানা রয়েছে সরকারের হাতে। ব্যাংকটির চেয়ারম্যান প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগবিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান।

নেপালের ধনকুবের বিনোদ চৌধুরী ও তাঁর স্ত্রী সারিকা চৌধুরী
ছবি: সংগৃহিত

নেপাল-বাংলাদেশ ব্যাংক ও আইএফআইসি ব্যাংকের বিভিন্ন প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, যৌথ মালিকানাধীন কোম্পানি হিসেবে ১৯৯৪ সালের ৬ জুন নেপাল–বাংলাদেশ ব্যাংকের কার্যক্রম শুরু হয়। প্রতিষ্ঠার শুরুতে ব্যাংকটির ১২ লাখ শেয়ারের মধ্যে আইএফআইসির হাতে ছিল ৬ লাখ। এ জন্য ১৯৯৪ সালে ৬ কোটি নেপালি রুপি এবং ১৯৯৮ সালে ১০ লাখ ৯৫ হাজার ৩৩ মার্কিন ডলার বিনিয়োগ করে। ওই বিনিয়োগের পর ব্যাংকটি একটি আর্থিক প্রতিষ্ঠানকে কিনে নেয়। পরে কিছু আর্থিক অনিয়মের ঘটনাও ঘটে ব্যাংকটিতে। এতে ব্যাংকটির আর্থিক অবস্থার অবনতি ঘটে। যার প্রভাব পড়ে আইএফআইসি ব্যাংকের বিনিয়োগেও।

এ অবস্থায় ২০১৩ ও ২০১৪ সালে ব্যাংকটিতে নতুন করে আরও প্রায় ৯৯ লাখ ডলার বিনিয়োগ করে আইএফআইসি ব্যাংক। তাতে নেপাল–বাংলাদেশ ব্যাংকে আইএফআইসির শেয়ারের পরিমাণ বেড়ে দাঁড়ায় ৪০ দশমিক ৯১ শতাংশে।

জানা গেছে, আইএফআইসি ব্যাংক সব মিলিয়ে নেপাল-বাংলাদেশ ব্যাংকে ২ কোটি ৯১ লাখ ৫৬ হাজার ৪৩১ ডলার বিনিয়োগ করেছে। ডলারের বর্তমান বিনিময় মূল্যে স্থানীয় মুদ্রায় যার পরিমাণ ২৫১ কোটি টাকা। তবে আইএফআইসি ব্যাংক শেয়ার বিক্রি করে এখন পাচ্ছে ৪৪০ কোটি টাকা। এর বাইরে শুরু থেকে এখন পর্যন্ত লভ্যাংশ ও সেবা মাশুল বাবদ ব্যাংকটি থেকে ৮৬ কোটি টাকা পেয়েছে আইএফআইসি।

নেপালের শেয়ারবাজারে গতকাল সোমবার নেপাল–বাংলাদেশ ব্যাংকের শেয়ারের দাম ছিল ৪০০ রুপি। গত ডিসেম্বরের মাঝামাঝিতে এ দাম ছিল ৩১৫ রুপি। মূলত একীভূত হওয়ার খবরে ওই দেশের শেয়ারবাজারে ব্যাংকটির শেয়ারের দাম বেড়েছে। অবশ্য এর আগে ২০১৬ সালের ব্যাংকটির শেয়ারের দাম উঠেছিল ৮০০ রুপিতে।

জানতে চাইলে পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর প্রথম আলোকে বলেন, ‘দেশের বাইরে আমাদের ব্যাংকগুলোর তেমন কোনো উপস্থিতি নেই। আমাদের ব্যাংকগুলো ছোট ও দুর্বল, এ জন্য অন্য দেশে যেতেও পারছে না। নেপালে একটু উপস্থিতি ছিল, এটাও শেষ হয়ে এল। এটা দুর্ভাগ্যজনক। এসব বিনিয়োগ কৌশলগত। নিশ্চয়ই মুনাফা হয়েছে, এ জন্য সরে আসছে আইএফআইসি। তবে সরকারি মালিকানায় থাকা ব্যাংকটি এ সিদ্ধান্ত আরও একটু ভেবেচিন্তে নিতে পারত।’

ফোর্বস ম্যাগাজিন নেপালের প্রথম শতকোটিপতি ধনকুবের (বিলিয়নিয়ার) হিসেবে বিনোদ চৌধুরীকে তালিকাভুক্ত করে ২০১৩ সালে। ওই বছরে ১ হাজার ৪২৬ জন কোটিপতির তালিকায় তাঁর অবস্থান ছিল ১ হাজার ৩৪২। তাঁর প্রতিষ্ঠানের নাম চৌধুরী গ্রুপ। তবে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে প্রতিষ্ঠানটি সিজি গ্লোবাল নামে ব্যবসা করে। বিনোদ চৌধুরীর ৮০টির বেশি শিল্প ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে। তাঁর সবচেয়ে বড় ব্যবসা সিঙ্গাপুরে। এ ছাড়া এ অঞ্চলের দেশগুলোর মধ্যে ভারত, শ্রীলঙ্কা ও থাইল্যান্ডে আছে হোটেল ও ভোগ্যপণ্যের ব্যবসা।

বিনোদ চৌধুরীর নেপালের বিলিয়নিয়ার হলেও তাঁর আদি বাড়ি ভারতের রাজস্থানে। তাঁর পিতামহ ঊনবিংশ শতকে নেপালে যায় এবং একটি বস্ত্রের দোকান খোলেন। সেখান থেকে রাজপরিবার ও সম্ভ্রান্তরা বস্ত্র কিনতেন। এরপর তাঁর বাবা নেপালের প্রথম ডিপার্টমেন্ট স্টোর খোলেন। মাত্র ১৮ বছর বয়সে বিনোদ ব্যবসায় যোগ দেন। তখন তিনি ভারতে হিসাববিদ্যায় অধ্যয়ন করছিলেন। বাবা অসুস্থ হওয়ায় পড়ালেখা অসম্পূর্ণ রেখেই নেপাল ফিরে যান। সেই থেকে শুরু। দীর্ঘ প্রায় ৫০ বছরের ব্যবসায়ী জীবনে তাঁর ব্যবসা ছড়িয়ে পড়েছে খাদ্য, আবাসন, সিমেন্ট, হোটেল, ব্যাংক, বিদ্যুৎ ও ইলেকট্রনিকসহ নানা খাতে।

নেপালের এই ব্যবসায়ীর সঙ্গে বাংলাদেশিদেরও রয়েছে সখ্য। ২০১৩ সালে তিনি একবার ঢাকায় এসেছিলেন। সে সময় প্রথম আলোকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘কোটিপতি হিসেবে স্বীকৃতিতে জৌলুশ ও মর্যাদা যেমন আছে, তেমনি আছে দায়দায়িত্ব।’ ফোর্বস–এর শীর্ষ ধনীর তালিকায় নাম আসা প্রসঙ্গে তিনি ওই সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘নেপাল বা বাংলাদেশে আমার চেয়েও ধনী ব্যক্তি আছেন। কিন্তু ব্যবসা পরিচালনার পাশাপাশি ব্যবসায় সুশাসনের বিষয়টি গুরুত্বসহকারে বিবেচনা করায় আমি এই স্বীকৃতি পেয়েছি।’ এদিকে দেশের শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত আইএফআইসি ব্যাংক গতকাল জানিয়েছে, ৬১৪ কোটি ৭০ লাখ নেপালি রুপিতে তারা নেপাল-বাংলাদেশ ব্যাংকের সব শেয়ার বিক্রি করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করেছে। গতকাল সোমবার দেশের প্রধান শেয়ারবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) ওয়েবসাইটে শেয়ার বিক্রিসংক্রান্ত সিদ্ধান্তের কথা জানানো হয়েছে। এর আগে গত জানুয়ারি মাসের শুরুতে আইএফআইসি ব্যাংক জানিয়েছিল, এনবিবির সব শেয়ার বিক্রি করে দেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু করেছে তারা। এ জন্য সম্ভাব্য ক্রেতাদের সঙ্গে দরদাম নিয়ে আলাপ-আলোচনা চলছে। শেয়ার বিক্রির প্রক্রিয়া শুরুর ঘোষণার প্রায় দেড় মাসের মাথায় বিক্রির চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়েছে।

এ খবরে গতকাল সোমবার ডিএসইতে আইএফআইসি ব্যাংক লেনদেনের শীর্ষ দশে উঠে এসেছে। এদিন ব্যাংকটির ২৯ কোটি টাকার শেয়ারের হাতবদল হয়। দিন শেষে প্রতিটি শেয়ারের দাম বেড়েছে পৌনে ২ শতাংশ বা ৩০ পয়সা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৭ টাকা ৭০ পয়সায়। যদিও লেনদেনের একপর্যায়ে শেয়ারের দাম আগের দিনের চেয়ে ৯০ পয়সা বেড়ে গিয়েছিল। তবে শেষ পর্যন্ত বাড়তি এ দাম ধরে রাখতে পারেনি। কারণ, এদিন সূচক কমেছে বাজারে।