ফারইস্ট ফাইন্যান্সের পর্ষদ পুনর্গঠন

  • প্রশান্ত কুমার হালদারের তিন আর্থিক প্রতিষ্ঠানেই প্রায় ৫০ কোটি টাকা ঋণ দেয় ফারইস্ট ফাইন্যান্স।

  • এর মধ্যে পিপলস লিজিংয়ে ৩৮ কোটি ও বাকি টাকা এফএএস ফাইন্যান্স ও বাংলাদেশ ইন্ডাস্ট্রিয়াল ফাইন্যান্স কোম্পানিতে।

পরিচালকদের অনিয়ম ও দুর্নীতির কারণে গ্রাহকদের টাকা ফেরত দিতে পারছে না আর্থিক প্রতিষ্ঠান ফারইস্ট ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেড। একই কারণে ২০১৭ সাল থেকে শেয়ারবাজারের বিনিয়োগকারীদেরও কোনো লভ্যাংশ দিতে পারছে না। প্রতিষ্ঠানটির অনিয়মের সঙ্গে জড়িত সাবেক ও বর্তমান কর্মকর্তারাও। এর পরিপ্রেক্ষিতে প্রতিষ্ঠানটির পরিচালনা পর্ষদ পুনর্গঠন করেছে পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)। গতকাল বুধবার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) মাধ্যমে এই তথ্য প্রকাশ করা হয়।

বিএসইসি প্রতিষ্ঠানটিতে নতুন করে ছয়জন স্বতন্ত্র পরিচালক নিয়োগ দিয়েছে। পাশাপাশি ফারইস্টের আর্থিক হিসাবসহ অন্যান্য বিষয় যাচাইয়ের জন্য বিশেষ নিরীক্ষারও সিদ্ধান্ত নিয়েছে কমিশন। গত ২৯ মার্চ এ বিষয়ে বিএসইসি কোম্পানিকে চিঠি দিয়েছে, যা বাংলাদেশ ব্যাংকেও পাঠানো হয়েছে।

নিয়োগ পাওয়া স্বতন্ত্র পরিচালকেরা হলেন সরকারের সাবেক সচিব ও সোনালী ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান মো. আশরাফুল মকবুল, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকের সাবেক অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক এহসানুল আজিজ, সাংবাদিক শেখ নাজমুল হক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক সজীব হোসাইন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ম্যানেজমেন্ট কনসালট্যান্সির পরিচালক মোশাররফ হোসাইন ও সিনিয়র কনসালট্যান্ট এ কে এম শহিদুজ্জামান। তাঁদের মধ্যে মো. আশরাফুল মকবুল হবেন নতুন চেয়ারম্যান।

প্রতিষ্ঠানটি একদিকে গ্রাহকের টাকা ফেরত দিতে পারছে না, অন্যদিকে ২০১৭ সাল থেকে বিনিয়োগকারীদেরও লভ্যাংশ দিচ্ছে না

নতুন স্বতন্ত্র পরিচালকদের সঙ্গে পর্ষদে থাকবেন তিনজন শেয়ারধারী পরিচালক। তাঁরা হলেন বর্তমান চেয়ারম্যান সামসুল ইসলাম ভরসা, খাদিজা ওয়াহিদা জাহান ও রিমসা বিডির মনোনীত পরিচালক আসাদুজ্জামান। রিমসা বিডি হলো ফারইস্ট ইসলামী লাইফ ইনস্যুরেন্সের চেয়ারম্যান নজরুল ইসলামের প্রতিষ্ঠান। এই তিনজন বর্তমানে পরিচালক পদে আছেন। কমিশনের অনুমোদন ছাড়া প্রতিষ্ঠানটি সম্পদ বিক্রি, বন্ধকি, হস্তান্তর বা নিষ্পত্তি করতে পারবে না বলে জানিয়েছে বিএসইসি।

ফারইস্ট ফাইন্যান্স ২০১৮ সালের ১৯ এপ্রিল শেয়ারবাজারে ‘জেড’ শ্রেণিভুক্ত হয়। কোম্পানিটি দুই বছর ১১ মাস ধরে লেনদেন করে আসছে। কিন্তু পরিচালনা পর্ষদ এই দুরবস্থা কাটিয়ে তুলতে কোনো উদ্যোগ নেয়নি। পর্ষদ পুনর্গঠন নিয়ে ফারইস্ট ফাইন্যান্সে পাঠানো চিঠিতে বিএসইসি উল্লেখ করেছে, ২০১৯ সাল পর্যন্ত কোম্পানিটির সমন্বিত লোকসান হয়েছে ১৫২ কোটি ২২ লাখ টাকা। এর মধ্যে কেবল ২০১৯ সালেই লোকসান হয়েছে ৭১ কোটি ৮০ লাখ টাকা।

নতুন চেয়ারম্যান আশরাফুল মকবুল গতকাল রাতে প্রথম আলোকে বলেন, ‘চিঠি পেয়েছি। এখনো জানি না প্রতিষ্ঠানটির কী অবস্থা। বিএসইসির সঙ্গে আলোচনা করে দায়িত্ব নেব।’

ফারইস্ট ফাইন্যান্সের তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণে দেখা যায়, আলোচিত প্রশান্ত কুমার হালদারের তিন আর্থিক প্রতিষ্ঠানেই প্রায় ৫০ কোটি টাকা ঋণ দেয় ফারইস্ট ফাইন্যান্স। এর মধ্যে পিপলস লিজিংয়ে ৩৮ কোটি ও বাকি টাকা এফএএস ফাইন্যান্স ও বাংলাদেশ ইন্ডাস্ট্রিয়াল ফাইন্যান্স কোম্পানিতে (বিআইএফসি)। এ ঋণ দেওয়া হয় ফারইস্ট ফাইন্যান্সের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক শান্তনু সাহার সময়ে। তিনি দীর্ঘদিন প্রতিষ্ঠানটির এমডি পদে থেকে গত আগস্টে অবসরে গেছেন। এ বিষয়ে শান্তনু সাহার সঙ্গে মুঠোফোনে যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হলে তাঁর ফোন বন্ধ পাওয়া যায়।

ফারইস্টের সবচেয়ে বড় ঋণখেলাপি ব্রোকারেজ হাউস ফারইস্ট স্টক অ্যান্ড বন্ডস লিমিটেড। বর্তমানে এ প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান এম এ খালেক, যিনি একসময় ফারইস্ট ফাইন্যান্সেরও চেয়ারম্যান ছিলেন। ব্রোকারেজ হাউসটির কাছে আটকে আছে প্রায় ৩০০ কোটি টাকা। এরপর ওয়েস্টার্ন মেরিনে ১৭ কোটি, সানম্যান গ্রুপে ১৫ কোটি, প্রাইম ফাইন্যান্স গ্রুপে ১৪ ও ইমাম গ্রুপে ১৩ কোটি টাকা।

ফারইস্টের ঋণের পরিমাণ ৯৩৪ কোটি টাকা। এর মধ্যে প্রায় ৫০০ কোটি টাকাই খেলাপি। প্রতিষ্ঠানটির কাছে বিভিন্ন গ্রাহক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের জমা রয়েছে ৭৯০ কোটি টাকা। প্রতিষ্ঠানটিতে টাকা রেখে আটকে গেছে অগ্রণী, ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন অব বাংলাদেশ, মিডল্যান্ড ব্যাংক, মিউচুয়াল ট্রাস্টসহ আরও অনেক প্রতিষ্ঠান। ফলে ফারইস্ট ফাইন্যান্স এখন খেলাপি হয়ে গেছে। ফারইস্ট ফাইন্যান্স চলছিল মূলত চেয়ারম্যান সামসুল ইসলাম ভরসার একক নিয়ন্ত্রণে। আগে চেয়ারম্যান ছিলেন এম এ খালেক। তাঁদের সময়েই বড় ধরনের অনিয়ম সংঘটিত হয়।