ফেরত আসছে ঋণের অর্থ, চেক নগদায়নে বিপত্তি

খেলাপি গ্রাহকেরা ঋণের ৪০ কোটি টাকার চেক জমা দিয়েছেন। কিন্তু গ্রাহকদের ব্যাংক হিসাব বন্ধ থাকায় চেক নগদায়ন করতে পারছে না।

আলোচিত প্রশান্ত কুমার (পি কে) হালদারের কারণে সমস্যায় পড়া আর্থিক প্রতিষ্ঠান ইন্টারন্যাশনাল লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেসের কয়েকজন খেলাপি গ্রাহক ঋণের টাকা ফেরত দেওয়ার আগ্রহ দেখিয়েছেন। তারই অংশ হিসেবে এসব খেলাপি গ্রাহক প্রায় ৪০ কোটি টাকার চেক জমা দিয়েছেন। তবে এসব গ্রাহকের ব্যাংক হিসাব বন্ধ থাকায় ইন্টারন্যাশনাল লিজিং চেক নগদায়ন করতে পারছে না।

এদিকে প্রতিষ্ঠানটির ভারপ্রাপ্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) সৈয়দ আবেদ হাসানসহ শীর্ষ পর্যায়ের একাধিক কর্মকর্তা দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) হাতে আটক হওয়ার পর প্রতিষ্ঠানটি নেতৃত্বশূন্য হয়ে পড়ে। ফলে গ্রাহকদের সঙ্গে যোগাযোগও করতে পারছে না।

প্রতিষ্ঠানটিতে আদালতের পক্ষ থেকে নিযুক্ত চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম খান প্রথম আলোকে বলেন, ‘কিছু গ্রাহক ঋণের টাকা ফেরত দেওয়ার জন্য চেক জমা দিয়েছেন। কিন্তু বেশির ভাগ গ্রাহকের হিসাব দুদকের আদেশে বন্ধ রয়েছে। এ কারণে চেকগুলো নগদায়ন করা যাচ্ছে না। তাই আমরা বিষয়টি দুদককে অবহিত করেছি।’ নজরুল ইসলাম খান আরও বলেন, ‘আমরা নতুন এমডি, ডিএমডি নিয়োগ দেওয়ার জন্য কয়েকজনকে প্রাথমিকভাবে ঠিক করেছি। দ্রুতই এসব নিয়োগ সম্পন্ন হবে।’

জানা গেছে, ইন্টারন্যাশনাল লিজিংয়ের বড় খেলাপি অনেক গ্রাহকের সঙ্গে প্রতিষ্ঠানটি যোগাযোগ করেছে। আবার অনেককে খুঁজেও পাচ্ছে না। যাদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পেরেছে, তাদের মধ্যে অনেকে টাকা ফেরত দিতে কিছু টাকার চেক জমা দিয়েছে। যাদের চেক নগদায়ন হচ্ছে, বাংলাদেশ ব্যাংক তাদের ঋণ বিশেষ বিবেচনায় পুনঃ তফসিল করছে।

কিছু গ্রাহক ঋণের টাকা ফেরত দেওয়ার জন্য চেক দিয়েছেন। কিন্তু বেশির ভাগ গ্রাহকের হিসাব দুদকের আদেশে বন্ধ রয়েছে। এ কারণে চেকগুলো নগদায়ন করা যাচ্ছে না।
নজরুল ইসলাম খান, চেয়ারম্যান, ইন্টারন্যাশনাল লিজিং
আরও পড়ুন

গ্রাহকদের মধ্যে যারা ঋণের টাকা ফেরত দিচ্ছে, তাদের মধ্যে লিপরো ইন্টারন্যাশনাল ১২৫ কোটি টাকার ঋণের বিপরীতে ৮ কোটি টাকার চেক জমা দিয়েছে। এমটিবি মেরিন তাদের ৯৪ কোটি টাকার ঋণের বিপরীতে ৩ কোটি ২০ লাখ টাকার চেক জমা দিয়েছে। আর্থস্কোপ ৮৮ কোটি টাকার ঋণের বিপরীতে ২ কোটি ৮১ লাখ টাকার চেক দিয়েছে। পিঅ্যান্ডএল ইন্টারন্যাশনাল ৭৪ কোটি টাকার ঋণের বিপরীতে ২ কোটি ৩৬ লাখ টাকা, ড্রাই নুন অ্যাপারেলস ৯৪ কোটি টাকার ঋণের বিপরীতে ৯০ লাখ টাকা, এমএসটি ফার্মা অ্যান্ড হেলথ কেয়ার ৬৯ কোটি টাকার ঋণের বিপরীতে ৩ কোটি ৫৮ লাখ টাকা, জিঅ্যান্ডজি এন্টারপ্রাইজ ৫৪ কোটি ৮৪ লাখ টাকার ঋণের বিপরীতে ৫০ লাখ টাকা, আনন কেমিক্যাল ৫১ কোটি টাকার ঋণের বিপরীতে দেড় কোটি টাকার চেক জমা দিয়েছে। এ ছাড়া চেক জমা দিয়েছে ক্রসরোডস করপোরেশন, বর্ণ, রেপটাইল ফার্ম, আরবি এন্টারপ্রাইজ, সন্দীপ করপোরেশন, সিমটেক্স টেক্সটাইল ও সুখাদা প্রপার্টিজ। এসব প্রতিষ্ঠানের অনেকগুলোর সঙ্গে পি কে হালদার সরাসরি জড়িত ছিলেন।

পি কে হালদার রিলায়েন্স ফাইন্যান্স ও এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংকের এমডি থাকাকালে নামে–বেনামে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান খুলে ইন্টারন্যাশনাল লিজিংসহ চারটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান দখল করে প্রায় সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নেন। এসব টাকা এখন আর আদায় হচ্ছে না। এ জন্য ইন্টারন্যাশনাল লিজিং ও বাংলাদেশ ইন্ডাস্ট্রিয়াল ফাইন্যান্স কোম্পানিতে চেয়ারম্যান নিয়োগ দিয়েছেন আদালত।

শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত ইন্টারন্যাশনাল লিজিংয়ের ২০১৯ সাল শেষে আমানত ছিল ২ হাজার ৭৫১ কোটি টাকা। আর ওই সময় ঋণের পরিমাণ ছিল ৩ হাজার ৭৮৭ কোটি টাকা। ওই বছর প্রতিষ্ঠানটি ২ হাজার ৮০২ কোটি টাকা লোকসান দেয়। এর আগে ২০১৮ সালে সর্বশেষ ১১ কোটি টাকা মুনাফা করেছিল ইন্টারন্যাশনাল লিজিং।

বর্তমানে দেশে ৩৬টি আর্থিক প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এর মধ্যে মানের দিক থেকে ভালো প্রতিষ্ঠান ১০টির কম। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তদারকি দুর্বলতার কারণেই মূলত বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে উদ্যোক্তারাও নামে-বেনামে টাকা বের করে নেন। আর বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শনে যাতে বিষয়গুলো ধরা না হয়, সে জন্য শীর্ষ কর্মকর্তাদের নিয়মিত ঘুষ দেওয়ারও অভিযোগ এখন তদন্তাধীন।