বাংলাদেশ ব্যাংক খেলাপি ঋণ নিয়ন্ত্রণে অকার্যকর

ব্যাংক শাখার পরিমাণ যত বাড়ছে, বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শনের সংখ্যা তত কমে আসছে। আবার পরিদর্শনে যে অনিয়ম ধরা পড়ছে, তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে ডেপুটি গভর্নরের অনুমোদন লাগছে। এতে কার্যক্রম গতি হারিয়েছে। আবার ডেপুটি গভর্নর নিয়োগ হচ্ছে শিল্পগোষ্ঠীর পছন্দে। আমানতকারীদের স্বার্থ দেখার দায়িত্ব ছিল বাংলাদেশ ব্যাংকের। সেই প্রতিষ্ঠানটি খেলাপি ঋণ নিয়ন্ত্রণে অকার্যকর প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। ব্যাংকমালিক ও ঋণখেলাপিদের সহায়ক শক্তির ভূমিকায় দেখা যাচ্ছে সরকারকে। সব মিলিয়ে ব্যাংক খাতের সার্বিক উন্নয়নে এখন প্রয়োজন একটি স্বাধীন ব্যাংক কমিশন গঠন।

বাংলাদেশের ব্যাংক খাতের এমন অনেক ঘটনাকে এভাবেই তুলে ধরেছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)। টিআইবি পরিচালিত ‘ব্যাংকিং খাত তদারকি ও খেলাপি ঋণ নিয়ন্ত্রণ: বাংলাদেশ ব্যাংকের সুশাসনের সমস্যা ও উত্তরণের উপায়’ শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদনে এসব প্রকাশ করা হয়। অনলাইনে আয়োজিত এ অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান এবং উপদেষ্টা অধ্যাপক সুমাইয়া খায়ের।

‘আইন অনুযায়ী বাংলাদেশ ব্যাংকের যে ক্ষমতা রয়েছে, দেশের অর্থনীতির উন্নয়নে সেই ভূমিকা রাখার চেষ্টা করছে।’
সিরাজুল ইসলাম, বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র

গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, একটি ব্যবসায়ী গ্রুপ ১৪টি প্রতিষ্ঠানের নামে একটি ব্যাংকের ২৮ শতাংশ শেয়ার ক্রয় করে। ওই গ্রুপটি আবার ৭টি প্রতিষ্ঠানের নামে অন্য একটি ব্যাংকের ১৪ শতাংশ শেয়ার ক্রয় করে। এর মধ্যে একটি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনায় রদবদলকাজে অনুমোদন দিতে বাংলাদেশ ব্যাংক কর্মকর্তাদের গভীর রাত পর্যন্ত অফিসে অবস্থান করতে হয়। সেই ব্যবসায়ীর হাতে এখন ৯টি বেসরকারি ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণ। অথচ একক বা যৌথ নামে ১০ শতাংশের বেশি শেয়ার ক্রয় না করার বিধান রয়েছে।

আবার একটি বেসরকারি ব্যাংকের চেয়ারম্যান বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নামে প্রায় ৮ হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়েছেন, এর মধ্যে ৫ হাজার কোটি টাকা খেলাপি, যা একাধিকবার পুনর্গঠিত হয়েছে এবং পরে আবার খেলাপি হয়। এরপরও ওই চেয়ারম্যান কখনো খেলাপি হিসেবে চিহ্নিত হন না। ব্যবসায়িক ও রাজনৈতিক মহলের কারণে কেন্দ্রীয় ব্যাংক কোনো ব্যবস্থাও নিতে পারছে না। মাত্র এক ঘণ্টার মধ্যে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর নিয়োগ হচ্ছে। ডেপুটি গভর্নর নিয়োগ হচ্ছে শিল্পগোষ্ঠীর পছন্দে। ফলে ওই শিল্প গ্রুপের স্বার্থসংশ্লিষ্ট অনিয়মের বিরুদ্ধে দৃঢ় অবস্থান গ্রহণ তাদের পক্ষে সম্ভব হয় না।

এ নিয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র সিরাজুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘আইন অনুযায়ী বাংলাদেশ ব্যাংকের যে ক্ষমতা রয়েছে, দেশের অর্থনীতির উন্নয়নে সেই ভূমিকা রাখার চেষ্টা করছে।’

অনুষ্ঠানে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ব্যাংকগুলো যে জনগণের আমানতে পরিচালিত হয়, এই বাস্তবতা দিনে দিনে ম্লান হয়ে যাচ্ছে। জনগণের আমানত কিছু মানুষের ব্যক্তিগত সম্পদে পরিণত হচ্ছে ও খেয়ালখুশিমতো ব্যবহারের প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। অথচ বাংলাদেশ ব্যাংকের দায়িত্ব জনগণের আমানতের সুরক্ষা দেওয়া। তিনি আরও বলেন, তথাকথিত ব্যাংকমালিক, বাংলাদেশ ব্যাংক ও সরকার—এই তিন পক্ষই জনগণের আমানতের কথা ভুলে গিয়ে লুটপাটকারী ও ঋণখেলাপিদের সুযোগ করে দিচ্ছে। সরকার অনেক সময় ঋণখেলাপি, অর্থ আত্মসাৎকারী ও জালিয়াতদের সহায়ক শক্তির ভূমিকা পালন করছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের আইন ও নীতিমালা এমনিতেই দুর্বল। সরকার আরও দুর্বল করে দিচ্ছে।

টিআইবির নির্বাহী পরিচালক আরও বলেন, ব্যাংক খাত তদারকি ব্যর্থ হলে কোনো উন্নতি হবে না। তদারকির দায়িত্বে থাকা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কিছু বিভাগ নামমাত্র আছে, আসলে কোনো কার্যক্রম নেই। তদারকি কার্যক্রমে ঋণখেলাপি ও রাজনৈতিক মহলের প্রভাব প্রাতিষ্ঠানিক রূপ নিয়েছে। ফলে দেশের ব্যাংক খাত নাজুক অবস্থায়। এখনই জোরালো পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন। কারণ, ব্যাংকের জনগণের আমানতে পরিচালিত হয়।

টিআইবির পক্ষে প্রতিবেদন উপস্থাপন করেন গবেষণা ও পলিসি বিভাগের পরিচালক মোহাম্মদ রফিকুল হাসান। প্রতিবেদনে বলা হয়, ব্যাংক পরিচালকের দৃশ্যমান ঋণের বাইরে বেনামেও প্রচুর ঋণ গ্রহণের অভিযোগ রয়েছে। এসব ঋণের বিপুল পরিমাণ অংশ পরে খেলাপি হয়ে যায় এবং প্রভাবের মাধ্যমে এই খেলাপি ঋণে বারবার সুদ মওকুফ, পুনঃ তফসিল, পুনর্গঠন ও অবলোপন ইত্যাদি বাড়তি সুবিধা নেওয়া হয়ে থাকে। বিপুল পরিমাণের খেলাপি ঋণ নিয়ন্ত্রণ, ব্যাংকিং খাতের স্থিতিশীলতা রক্ষা এবং আমানতকারীদের স্বার্থ সংরক্ষণে বাংলাদেশ ব্যাংকের তদারকি কার্যক্রমের ক্ষেত্রে প্রধানত দুই ধরনের সুশাসনের চ্যালেঞ্জ রয়েছে। একটি হলো বাহ্যিক প্রভাব—যার মধ্যে রয়েছে আইনি সীমাবদ্ধতা, রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ ও ব্যবসায়িক প্রভাব এবং অপরটি হচ্ছে অভ্যন্তরীণ চ্যালেঞ্জ—যার মধ্যে রয়েছে তদারকি সক্ষমতায় ঘাটতি, নেতৃত্বের সক্ষমতায় ঘাটতি, বাংলাদেশ ব্যাংকের কার্যক্রমে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির ঘাটতি এবং তদারককাজে সংঘটিত অনিয়ম–দুর্নীতি। আগে পরিদর্শন দল প্রাপ্ত তথ্যাদির ভিত্তিতে তাৎক্ষণিকভাবে ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দিতে পারলেও বর্তমানে ডেপুটি গভর্নরের অনুমোদন সাপেক্ষে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হয়। এসব কারণে পরিদর্শন কার্যক্রম মন্থর হয়েছে এবং ব্যাংকিং খাতের অনেক অনিয়ম-দুর্নীতি ও জালিয়াতির ঘটনা উদ্‌ঘাটনে বিলম্ব হচ্ছে।

সিদ্ধান্ত গ্রহণে দীর্ঘসূত্রতার কথা উল্লেখ করে টিআইবি বলছে, একটি রাষ্ট্রমালিকানাধীন ব্যাংকে একক ঋণের বৃহত্তম ঋণসীমা লঙ্ঘনের ঘটনা ২০০৭ থেকে ২০১৪ সালের মধ্যে সংঘটিত হলেও ২০১৬-১৭ অর্থবছরে তা ধরা পড়ে। এ ঘটনায় ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট শাখার ব্যবস্থাপক প্রত্যক্ষভাবে সম্পৃক্ত থাকলেও পরে তিনি পদোন্নতি পেয়ে ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) হন। পরে ২০২০ সালে জালিয়াতির সঙ্গে সম্পৃক্ততা উদ্‌ঘাটিত হলে তাঁকে অপসারণের সুপারিশ করা হয়। আবার অনেক সময় ‘আর্থিক খাতের স্বার্থ বিপন্ন হতে পারে’ এই অজুহাতে অনিয়মের বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়া হয় না। অনেক ক্ষেত্রে নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের দু-একজন কর্মকর্তার সঙ্গে কয়েকটি শিল্পগোষ্ঠীর যোগসাজশের মাধ্যমে পরিদর্শন প্রতিবেদনে উল্লিখিত অনিয়ম চূড়ান্ত প্রতিবেদন থেকে বাদ দেওয়া হয় থাকে। বাংলাদেশ ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের অনেকে অবসরের পরপরই যে প্রতিষ্ঠানগুলোর তদারকি করতেন, সেখানে উচ্চপদে যোগদান করে থাকেন।

প্রতিবেদনে টিআইবির সুপারিশ হচ্ছে—ব্যাংক খাত সংস্কারের জন্য সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে একটি স্বাধীন ব্যাংকিং কমিশন গঠন; ব্যাংক কোম্পানি আইনের ৪৬ ও ৪৭ ধারা সংশোধন করে বাংলাদেশ ব্যাংককে রাষ্ট্রমালিকানাধীন ব্যাংক নিয়ন্ত্রণ ও তদারকির পূর্ণ ক্ষমতা দেওয়া; বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ সদস্য, গভর্নর ও ডেপুটি গভর্নর নিয়োগ ও অপসারণ বিষয়ে সুনির্দিষ্ট লিখিত নীতিমালা প্রণয়ন; নিয়োগের জন্য অনুসন্ধান কমিটির গঠন; দায়িত্ব-কর্তব্য এবং নিয়োগপ্রক্রিয়া সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা থাকা এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদে তিনজন সরকারি কর্মকর্তার স্থলে বেসরকারি প্রতিনিধির সংখ্যা বৃদ্ধি।

ব্যাংক পরিচালকদের নিয়ে টিআইবির সুপারিশ হলো—রাষ্ট্রমালিকানাধীন ব্যাংকসহ সব বাণিজ্যিক ব্যাংকের পরিচালক নিয়োগে অনুসন্ধান কমিটির মাধ্যমে একটি প্যানেল তৈরি এবং সেখান থেকে বিভিন্ন ব্যাংকের পরিচালক নিয়োগের বিধান করতে হবে। রাজনীতির সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত ব্যক্তিদের ব্যাংক পরিচালক হওয়া থেকে বিরত রাখার বিধান করতে হবে।

টিআইবি আরও বলছে, আদালত কর্তৃক স্থগিতাদেশপ্রাপ্ত খেলাপি ঋণের বিপরীতে নিরাপত্তা সঞ্চিতি রাখার বিধান প্রণয়ন করতে হবে। বারবার পুনঃ তফসিল করে বারবার খেলাপি হওয়া ব্যক্তিদের তালিকা প্রকাশ করতে হবে।