বাড়বাড়ন্ত কোটি টাকার হিসাব

ব্যাংকে কোটি টাকা রয়েছে, এমন হিসাবের সংখ্যা হুহু করে বাড়তে শুরু করেছে। বিশেষ করে করোনার এক বছরে (মার্চ ’২০- মার্চ ’২১) এমন হিসাবের সংখ্যা বেশি বেড়েছে। এই সময়ে কোটি টাকার হিসাবের সংখ্যা বেড়েছে ১১ হাজার ৬৪৭টি। তবে কোটি টাকার হিসাব মানেই কোটিপতি নাগরিকের হিসাব নয়। কেননা ব্যাংকে এক কোটি টাকার বেশি অর্থ রাখার তালিকায় ব্যক্তি ছাড়া অনেক প্রতিষ্ঠানও রয়েছে। আবার ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান কতটি ব্যাংক হিসাব খুলতে পারবে, তারও কোনো সীমা নির্দিষ্ট করা নেই। ফলে এক প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তির একাধিক হিসাবও রয়েছে। এর মধ্যে সরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও সংস্থার কোটি টাকার হিসাবও রয়েছে।

কোটি টাকা আছে এমন হিসাব
১৯৭৫ সালে মাত্র ৪৭টি।
২০১৫ সালে ৫৭ হাজার ৫১৬টি।
২০২০ সালের মার্চে ছিল ৮২ হাজার ৬২৫টি।
গত মার্চ শেষে ৯৪ হাজার ২৭২টি।

দেশে প্রকৃত কোটিপতির সঠিক হিসাব বাংলাদেশ ব্যাংক প্রকাশ করে না। ফলে কত মানুষের কোটি টাকা রয়েছে, তার সঠিক পরিসংখ্যান জানা যায় না। তবে ধারণা করা হচ্ছে, করোনার কারণে কিছু মানুষ যেমন গরিব হয়েছে, তেমনি ধনীরা আরও বেশি ধনী হয়েছেন। করোনার কারণে অনেক ধনী পরিবার তাদের উত্তরাধিকারদের মধ্যে সম্পত্তি ভাগ-বাঁটোয়ারা করে দিয়েছে। আবার কারও কারও মৃত্যুর কারণেও ধনী পরিবারের সম্পত্তি ভাগাভাগি হয়েছে। এসব কারণেও কোটি টাকা রয়েছে, এমন ব্যাংক হিসাবের সংখ্যা বাড়তে পারে বলে ধারণা করছেন ব্যাংকাররা।

জানতে চাইলে রূপালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ওবায়েদ উল্লাহ আল মাসুদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘চিকিৎসা ও তথ্যপ্রযুক্তি খাতে যাঁরা ব্যবসা করেন, তাঁরা করোনার মধ্যে খুব ভালো করেছেন। আবার করোনার কারণে অনেকে বিলাসী খরচ কমিয়ে ফেলেছেন। ভবিষ্যতের নিরাপত্তার কথা ভেবে টাকা জমাচ্ছেন। আর এ সময়ে প্রবাসীদের যাঁরা দেশে ফিরে এসেছেন, তাঁরা জমানো সব টাকা নিয়ে ফিরেছেন। আবার করোনার মধ্যে অনেকে ব্যবসা করে ভালো উপার্জনও করেছেন। মূলত এসব কারণে ব্যাংকে কোটি টাকা আছে, এমন হিসাব বেড়ে গেছে।’

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ১৯৭৫ সালে কোটি টাকার বেশি জমা ছিল, এমন হিসাবের সংখ্যা ছিল মাত্র ৪৭টি। ২০১৫ সালে সেই সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ৫৭ হাজার ৫১৬টিতে। গত বছরের মার্চে দেশে করোনার সংক্রমণ শুরুর আগে দেশের ব্যাংকগুলোতে এ ধরনের হিসাব ছিল ৮২ হাজার ৬২৫টি। আর গত বছরের মার্চ থেকে চলতি বছরের মার্চ শেষে কোটি টাকা জমা আছে, এমন ব্যাংক হিসাবের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৯৪ হাজার ২৭২টিতে। তাতে করোনা সংক্রমণের এক বছরে দেশে কোটি টাকার হিসাব বেড়েছে ১১ হাজার ৬৪৭টি। এর মধ্যে চলতি বছরের প্রথম তিন মাসে (জানুয়ারি-মার্চ) বেড়েছে ৩৮২টি।

বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাব অনুযায়ী, ২০২১ সালের মার্চ শেষে ব্যাংকগুলোতে ১ কোটি টাকা থেকে ৫ কোটি টাকা পর্যন্ত জমা থাকা হিসাব ছিল ৭৪ হাজার ২২৯টি। ৫ কোটি থেকে ১০ কোটি টাকা পর্যন্ত জমা থাকা ব্যাংক হিসাব আছে ১০ হাজার ৪৯৯টি। ১০ কোটি থেকে ১৫ কোটি টাকা জমা থাকা ব্যাংক হিসাব আছে ৩ হাজার ৪৪৬টি। ১৫ কোটি থেকে ২০ কোটি টাকা জমা থাকা ব্যাংক হিসাব ছিল ১ হাজার ৬৯৩টি। ২০ কোটি থেকে ২৫ কোটি টাকা পর্যন্ত আমানত জমা থাকা ব্যাংক হিসাব ছিল ১ হাজার ৮১টি। এ ছাড়া ৭৬৬টি ব্যাংক হিসাবে ২৫ কোটি থেকে ৩০ কোটি টাকা করে জমা ছিল। ৩০ থেকে ৩৫ কোটি টাকা পর্যন্ত জমা ছিল ৩৮৮টি ব্যাংক হিসাবে। ২৯৬টি ব্যাংক হিসাবে ৩৫ কোটি থেকে ৪০ কোটি টাকা করে জমা ছিল। ৪০ কোটি থেকে ৫০ কোটি টাকা পর্যন্ত জমা থাকা হিসাব ছিল ৫০৪টি। ৫০ কোটি টাকা ও এর বেশি টাকা জমা থাকা ব্যাংক হিসাব ছিল ১ হাজার ৩৭০টি।

এদিকে, ৫০ কোটি টাকা বা তার বেশি টাকা আছে, এমন ব্যাংক হিসাবের সংখ্যা গত বছরের ডিসেম্বরে ছিল ১ হাজার ৩৯০টি। তিন মাসের ব্যবধানে সেই সংখ্যা ২০টি কমেছে। ব্যাংকাররা ধারণা করছেন, ৫০ কোটি টাকার বেশি আছে, এ রকম ব্যাংক হিসাবের মধ্যে প্রতিষ্ঠানের হিসাবই বেশি। যার মধ্যে সরকারি প্রতিষ্ঠানের হিসাবও রয়েছে। গত এক বছরে সরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান তাদের উদ্বৃত্ত অর্থ সরকারি কোষাগারে জমা দিয়েছে। এ কারণে বেশি টাকা থাকা হিসাবের সংখ্যা কমে এসেছে।
জানা গেছে, ২০১৯ সালের মার্চ থেকে ২০২০ সালের মার্চ পর্যন্ত দেশে কোটি টাকার হিসাব বেড়েছিল ৬ হাজার ৩৪৯টি। আর ২০২০ সালের পুরো সময়ে বেড়েছিল ১ হাজার ৫১টি। কোটি টাকার হিসাব বাড়ার এটাই ছিল স্বাভাবিক ধারা। তবে করোনাকালেই কোটি টাকার হিসাবের সংখ্যা বেড়েছে সবচেয়ে বেশি।

জানতে চাইলে এনসিসি ও মেঘনা ব্যাংকের সাবেক এমডি মোহাম্মদ নুরুল আমিন প্রথম আলোকে বলেন, সুদের কারণেও অনেক সময় কোটি টাকা হিসাব বেড়ে যায়। পোশাক, মেডিসিন খাতের যাঁরা ব্যবসা করছেন, তাঁরা ধনী হচ্ছেন। আর বিদেশে টাকা পাচার বন্ধ হয়ে গেছে। তবে দেশে দুর্নীতি কিন্তু বন্ধ হয়নি। দুর্নীতির টাকার বড় অংশও কোনো না কোনোভাবে ব্যাংকে জমা হয়। এসব কারণে কোটি টাকার হিসাব বেড়ে গেছে।

গত মার্চ শেষে দেশের ব্যাংকগুলোতে যে টাকা জমা ছিল, তার ৪৩ শতাংশই ছিল কোটি টাকার হিসাবগুলোতে। বাকি ৫৭ শতাংশ টাকা ছিল এক টাকা থেকে ৯৯ লাখ ৯৯ হাজার ৯৯৯ টাকা থাকা ব্যাংক হিসাবে।