ব্যাংকের সুদে দিন আর চলে না

মানুষ বিশ্বাস করে ব্যাংকে টাকা রাখে, যাতে তা সুরক্ষিত থাকে। পাশাপাশি আমানতকারীদের একটি বড় অংশ সুদ পাওয়ার জন্য ব্যাংকে টাকা জমা রাখেন, যাতে সুদ আয় দিয়ে সংসারের দৈনন্দিন খরচ মেটানো যায়। কিন্তু ব্যাংকের সুদহার এখন কমে এমন একপর্যায়ে নেমে এসেছে যে সেটি দিয়ে দৈনন্দিন খরচ তো দূরের কথা, মূল্যস্ফীতিও সামাল দেওয়া যাচ্ছে না।

একদিকে সুদহার কমে গেছে, অন্যদিকে প্রাত্যহিক খরচ বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে ব্যাংকে আমানত রাখলে যে পরিমাণ সুদ আয় মেলে, তাতে সংসারের দৈনন্দিন খরচ মেটানো কঠিন হয়ে পড়েছে। অর্থাৎ সুদের টাকায় এখন আগের চেয়ে কম পণ্য ও সেবা কেনা যায় অথবা একই পরিমাণ পণ্য ও সেবার জন্য আগের চেয়ে বেশি টাকা খরচ করতে হচ্ছে। যাঁরা শুধু সুদ আয়ের ওপর নির্ভরশীল, তাঁরা সুদের হার কমে যাওয়া ও খরচ বেড়ে যাওয়ার কষ্ট সবচেয়ে ভালো টের পাচ্ছেন।

অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা আনিসুর রহমানের ঢাকার মিরপুরে একই ভবনে দুটি ফ্ল্যাট আছে। দুই মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন, তাঁদের আলাদা সংসার। বর্তমানে তিনি স্ত্রীকে নিয়ে একটি ফ্ল্যাটে থাকেন। অপরটির ভাড়ায় আর ব্যাংকে রাখা কিছু সঞ্চয়ী আমানতের বিপরীতে পাওয়া সুদ দিয়ে সংসার চালান। সুদহার কমে যাওয়া ও মূল্যস্ফীতির বিষয়টি ব্যাখ্যা করে তাঁর কাছেই জানতে চেয়েছিলাম, আপনার অবস্থা কী। আনিসুর রহমানের সরল জবাব, ‘আগে নাতি-নাতনিদের কাছে গেলে নিয়মিত চকলেট-আইসক্রিম নিতাম। এখন আর পারি না। বাজারে চাল, ডালসহ জিনিসপত্রের দাম যেভাবে বাড়ছে, তাতে ভাড়ার টাকায় ও ব্যাংকের সুদে সংসার চালানো কঠিন। আগে প্রতিবছর মেয়ে, জামাই ও নাতি–নাতনিদের কিছু উপহার বা নগদ টাকা দিতাম। এখন আর সম্ভব হচ্ছে না। তবে হাতে টাকা বাড়লে আবারও দেওয়ার ইচ্ছে আছে।’
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, দেশে গত জুন শেষে গড় মূল্যস্ফীতি ছিল ৫ দশমিক ৫৭ শতাংশ। একই সময়ে ব্যাংকে আমানতের গড় সুদহার ছিল ৪ দশমিক ১৩ শতাংশ। অবশ্য ব্যাংকভেদে এর চেয়ে কিঞ্চিৎ বেশি সুদ পাওয়া যায়।

আমানতকারীদের জন্য ব্যাংকগুলোর কয়েক ধরনের পণ্য রয়েছে। এর মধ্যে বেশি সুদ দেওয়া হয় স্থায়ী আমানতে। নির্দিষ্ট সময়ের আগে এই টাকা তোলা যায় না। ব্যাংকগুলো তিন মাসের কম স্থায়ী আমানত জমা নেয় না। গত মার্চ শেষে দেশের ব্যাংকগুলোতে যে পরিমাণ আমানত জমা ছিল, তার ৪৫ শতাংশই স্থায়ী আমানত। এর মধ্যে ১৫ শতাংশই এক–দুই বছর মেয়াদি। এসব আমানতে এখন কয়েকটি ব্যাংক ৬ শতাংশ বা আরও বেশি সুদ দিচ্ছে।

আর কারেন্ট ডিপোজিট বা চলতি আমানত হিসাব থেকে যখন–তখন টাকা তোলা চায়। এর সুদহার সবচেয়ে কম। মূলত ব্যবসায়ীরা এই হিসাবে টাকা জমা রাখেন। ব্যাংকগুলোতে থাকা মোট আমানতের ৮ দশমিক ৩৩ শতাংশ চলতি আমানত।

সেভিংস ডিপোজিট বা সঞ্চয়ী আমানত নামে আরেক পণ্য আছে, যা সবচেয়ে বেশি মানুষ ব্যবহার করে। সঞ্চয়ী আমানতে স্থায়ী আমানতের চেয়ে বেশ কম সুদ দেয় ব্যাংক। এই টাকা গ্রাহক চাইলে যেকোনো সময় তুলতে পারেন। সেভিংস ডিপোজিটের অধীনে স্পেশাল নোটিশ ডিপোজিট নামেও টাকা রাখা যায়। এটি মূলত বড় অঙ্কের টাকা রাখার আমানত পণ্য। তবে এই টাকা তুলতে নির্দিষ্ট সময় আগে ব্যাংককে জানাতে হয়। বাংলাদেশে কমপক্ষে সাত দিন আগে ব্যাংককে এই টাকা তোলার কথা জানাতে হয়। ব্যাংকভেদে এই সময় আরও বেশিও হয়ে থাকে। ব্যাংক আমানতে সবচেয়ে বেশি অর্থ আছে এই হিসাবে।

গত জুনে ইস্টার্ণ ব্যাংক লিমিটেড (ইবিএল) ও প্রাইম ব্যাংকের মতো ভালো ব্যাংকগুলোর সঞ্চয়ী হিসাবে সুদহার ছিল আড়াই শতাংশ। আর স্থায়ী আমানতে সুদহার ছিল ৩ দশমিক ২৫ শতাংশ পর্যন্ত। তবে সরকারি ও কিছু বেসরকারি দুর্বল ব্যাংকে এখনো ৬ শতাংশ ও তার কিছুটা বেশি সুদ পাওয়া যায়।

ব্যাংক এশিয়ার ব্যবস্থাপনা পরিচালক আরফান আলী প্রথম আলোকে বলেন, সুদ আয়ে জীবন যাপন করা আসলেই কঠিন হয়ে পড়েছে। ঋণের চাহিদা না থাকায় সুদহার এত কমেছে। পরিস্থিতি ভালো হলে সুদ বাড়বে, তখন আমানতকারীরাও ভালো সুদ পাবেন। এ জন্য তাঁদের আরও কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে।

ধরুন, আপনি ১০০ টাকা ব্যাংকে স্থায়ী আমানত হিসেবে রেখে বছর শেষে ১০৬ টাকা পেলেন। অন্যদিকে মূল্যস্ফীতিও যদি হয় ৬ শতাংশ, তাহলে হিসাবটি এ রকম হবে, গত বছর যেখানে খরচ হতো ১০০ টাকা, সেখানে এবারে তা বেড়ে হয়েছে ১০৬ টাকা। তাহলে আপনার টাকা বাড়ল কই? যদি আমানতের সুদ ১০ শতাংশ ও মূল্যস্ফীতি ৬ শতাংশ হতো, তাহলে আপনার জমা টাকার প্রকৃত পরিমাণ ৪ শতাংশ বাড়ত। প্রাপ্ত সুদের ওপর ১০ থেকে ১৫ শতাংশ উৎসে আয়কর না হয় হিসাবে না-ই ধরলাম। সেটা ধরলে আপনার টাকার প্রকৃত মূল্য আরও কমবে।