ভুল থেকেই নতুন কিছু

মানুষ তার চাহিদা পূরণে কত কিছু উদ্ভাবন করেছে। তেমনি এক উদ্ভাবন হলো ক্রেডিট কার্ড, যার ব্যবহার শুরু হয় ১০০ বছর আগে।

বর্তমানে দুনিয়াজুড়ে ব্যক্তিগত ও পারিবারিক জীবনের দৈনন্দিন কেনাকাটা ও লেনদেনে এক অপরিহার্য উপাদান হলো ক্রেডিট কার্ড। ওয়ালেটে বা পকেটে একটি ক্রেডিট কার্ড থাকলে শুধু দেশেই নয়, বিদেশেও হোটেলের রুম ও বিমান টিকিটের বুকিং, রেস্টুরেন্টে খাবার ও হাসপাতালের চিকিৎসা ও বিভিন্ন ধরনের কেনাকাটার বিল অনায়াসে পরিশোধ করা যায়। নগদ টাকা বহনের ঝুঁকি এড়াতেও ক্রেডিট কার্ড ব্যবহারের জুড়ি নেই। প্রয়োজনে নির্দিষ্ট পরিমাণ ঋণও নেওয়া যায়। এর ওপর খরচের টাকা সময়মতো পরিশোধ করলেই কোনো সুদ দিতে হয় না। সেই সঙ্গে ক্রেডিট কার্ড ব্যবহারের বিপরীতে রয়েছে নানা ধরনের ছাড় ও সুবিধা। ফলে মানুষ দিন দিন ক্রেডিট কার্ড ব্যবহারে ঝুঁকছে।

একটি প্লাস্টিক কার্ডের মাধ্যমে স্বাচ্ছন্দ্যময় কেনাকাটা ও লেনদেন করার সুযোগটি মানুষের সামনে হঠাৎ করে আসেনি। এর পেছনে রয়েছে নগদ লেনদেনের জুতসই বিকল্প খুঁজে পাওয়ার সুদীর্ঘ এক আকাঙ্ক্ষা। এখন থেকে ১৩৪ বছর আগে ১৮৮৭ সালে প্রখ্যাত ঔপন্যাসিক এডওয়ার্ড ব্যালামি তাঁর লুকিং ব্যাকওয়ার্ড নামের কল্পকাহিনিভিত্তিক উপন্যাসে প্রথমবারের মতো ক্রেডিট কার্ডের প্রসঙ্গ তোলেন, তা–ও ১১ বার। তবে প্রথম উদ্যোগটি দেখা যায় শতবর্ষ আগে ১৯২০ সালে, যা পরিপূর্ণভাবে আলোর মুখ দেখতে আরও কয়েক দশক লেগে যায়। আসুন, চমকপ্রদ সেই গল্প, সেই ইতিহাস শোনা যাক:

ফ্রাঙ্ক ম্যাকনামারা নামে যুক্তরাষ্ট্রের এক ব্যবসায়ী ১৯৪৯ সালে নিউইয়র্কের একটি রেস্তোরাঁয় ডিনার, অর্থাৎ নৈশভোজ করতে গিয়েছিলেন। কিন্তু খাবারদাবারের পর বিল পরিশোধের সময় ভদ্রলোক টের পান যে তিনি ভুল করে ওয়ালেট তথা মানি ব্যাগ আনেননি। তখন তিনি খাবারের বিল পরে পরিশোধ করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে রেস্তোরাঁটির সঙ্গে একটি চুক্তি সই করেন। তবে ঘটনাটি নিয়ে এমন কথাও প্রচলিত আছে, ম্যাকনামারা তাঁর স্ত্রীকে কিছু নগদ অর্থ নিয়ে রেস্তোরাঁয় আসতে বলেছিলেন।

বিব্রতকর ওই অভিজ্ঞতা থেকেই ম্যাকনামারার মাথায় নগদ অর্থ ছাড়া কীভাবে বিল পরিশোধ করা যায়, সে বিষয় ঘুরপাক খেতে থাকে। ব্যস, অচিরেই একটি আইডিয়া মানে ধারণা খেলে গেল তাঁর মাথায়। সেটি হলো কার্ডের মাধ্যমে তো কাজটি করা যেতে পারে। পরের বছর ১৯৫০ সালেই রালফ স্নেইডার নামে আরেক জনকে সঙ্গে নিয়ে ম্যাকনামারা যুক্তরাষ্ট্রের ভোক্তাদের জন্য চালু করেন প্রথম ক্রেডিট কার্ড ‘দ্য ডাইনারস’ ক্লাব। এ কোম্পানি খোলার প্রধান মূলমন্ত্র ছিল, ‘এখন চুক্তি সই, পরে বিল পরিশোধ’। সে আলোকে নিউইয়র্ক শহরের ২৭টি রেস্তোরাঁর সঙ্গে ম্যাকনামারা চুক্তি করলেন। বন্ধুবান্ধব ও পরিচিত মিলিয়ে ২০০ ব্যক্তি ডাইনারস ক্লাবের সদস্য হলেন। এর পরে সদস্যরা চুক্তিবদ্ধ রেস্তোরাঁগুলোতে আগে খেয়ে পরে বিল দিতেন।

ডাইনারস ক্লাব বার্ষিক তিন ডলার ফির বিনিময়ে সদস্যপদ দিত এবং রেস্তোরাঁর কাছ থেকে প্রতিটি বিলের বিপরীতে ৭ শতাংশ ফি নিত। এটি খুব দ্রুত জনপ্রিয়তা লাভ করে। প্রথম বছরেই এর সদস্যসংখ্যা ২০ হাজার ছাড়িয়ে যায়। ১৯৫৩ সালের দিকে এটি আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলেও বেশ পরিচিত হয়ে ওঠে। ফলে কানাডা, কিউবা ও ফ্রান্সে শাখা খোলা হয়।

নিউইয়র্ক টাইমস–এর এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, প্রায় একই সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের ব্লুমিংডেল ডিপার্টমেন্ট স্টোরের প্রতিষ্ঠাতার নাতি আলফ্রেড ব্লুমিংডেলও লস অ্যাঞ্জলেসে ‘সাইন অ্যান্ড ডাইন’ নামে ক্রেডিট কার্ডের ব্যবসা শুরু করেন।

এরই মধ্যে আলফ্রেড ব্লুমিংডেল তাঁর এক বন্ধুর মাধ্যমে নিউইয়র্কে দ্য ডাইনারস ক্লাব নামে একটি কোম্পানি চালু হওয়ার সংবাদও জানতে পারেন। এরপর তিনি ডাইনারস ক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা ফ্রাঙ্ক ম্যাকনামারা ও স্নেইডারের সঙ্গে দফায় দফায় বৈঠক করেন। এসব বৈঠকের ফলশ্রুতিতে ডাইনারস ক্লাব এবং সাইন অ্যান্ড ডাইন একীভূত হয়ে একটি নতুন কোম্পানি গঠিত হয়।

আলফ্রেড ব্লুমিংডেল তখন ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন, ‘একদিন ক্রেডিট কার্ড নগদ অর্থের লেনদেনের চেয়ে বেশি জনপ্রিয় হয়ে উঠবে। এমন এক দিন আসবে, যখন নগদ অর্থের লেনদেনকে অচল করে দেবে প্লাস্টিক কার্ড।’

অবশ্য দ্য ডাইনারস ক্লাব ও সাইন অ্যান্ড ডাইনের যাত্রা শুরু হওয়ার তিন দশক আগে ১৯২০ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ডিপার্টমেন্ট স্টোর ও তেল কোম্পানিগুলো গ্রাহকদের জন্য ‘কার্টিসি কার্ড’ নামে একধরনের ক্রেডিট কার্ড চালু করেছিল। তবে ১৯৫৮ সালে ক্রেডিট কার্ড চালু করে যুক্তরাষ্ট্রের ব্যাংক অব আমেরিকা। এরপর যুক্তরাষ্ট্র ছাড়িয়ে এক এক করে গোটা বিশ্বেই দেশে দেশে ছড়িয়ে পড়ে ক্রেডিট কার্ডের ব্যবসা ও ব্যবহার।

আলফ্রেড ব্লুমিংডেল, ফ্রাঙ্ক ম্যাকনামারা ও স্নেইডার যে চিন্তাভাবনায় নিজেদের সময়ের চেয়ে অনেক এগিয়ে ছিলেন, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। এখন তো সারা বিশ্বেই ক্রেডিট কার্ডের মাধ্যমে লেনদেন চলছে। কয়েক বছর আগে যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক অব বোস্টনের এক জরিপে বলা হয়েছিল, দেশটির শতকরা ৭২ ভাগ ভোক্তাই ক্রেডিট কার্ডের মাধ্যমে কেনাকাটা বা লেনদেন করে থাকেন। আর এবিসি নিউজের মতে, ৭৫ শতাংশ আমেরিকান অন্তত একটি ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার করেন। করোনাভাইরাস এসে তো ক্রেডিট কার্ড ব্যবহারের গতি কয়েক গুণ বাড়িয়ে দিয়েছে বলে মনে করা হয়।


সূত্র: বিজনেস ইনসাইডার, নার্ডওয়ালেট ও উইকিপিডিয়া।