ভোক্তাঋণে করোনার থাবা

সূত্র: বাংলাদেশ ব্যাংক

দেশে ঋণ বিতরণে ৯ শতাংশ সুদহার কার্যকর হতে না হতেই করোনাভাইরাসের সংক্রমণ শুরু হয়। যে কারণে ভোক্তা ও খুচরা ঋণের চাহিদা যেমন কমেছে, তেমনি ওই সুদহারে ঋণ দিতে ব্যাংকগুলোও অনাগ্রহ দেখিয়েছে। ফলে ভোক্তাঋণের প্রায় সব খাতেই আগের চেয়ে ঋণ বিতরণ কমে গেছে।

করোনাকালে জমি কেনার ঋণ বেড়েছে, ফ্ল্যাট কেনার ঋণ কমেছে। আবার একই সময়ে বেতনের বিপরীতে চাকরিজীবীদের ঋণ নেওয়ার পরিমাণও বৃদ্ধি পেয়েছে। ব্যাংকে জমা রাখা টাকার বিপরীতেও ঋণ বেড়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এপ্রিল-জুন প্রান্তিকের তথ্য বিশ্লেষণে এমন চিত্র পাওয়া গেছে।

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, সাধারণত সংকট এলে জমি কেনার প্রবণতা বৃদ্ধি পায়। এবারও তা–ই হয়েছে। আর করোনার পরিস্থিতিতে খরচ বেড়ে যাওয়ায় অনেকেই বেতনের বিপরীতে ঋণ নিয়েছেন। ফলে এ দুই খাতে ঋণ বিতরণ বেড়েছে।

জানতে চাইলে ব্যাংকের প্রধান নির্বাহীদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স, বাংলাদেশের (এবিবি) চেয়ারম্যান ও ইস্টার্ণ ব্যাংক লিমিটেডের (ইবিএল) ব্যবস্থাপনা পরিচালক আলী রেজা ইফতেখার প্রথম আলোকে বলেন, ‘করোনার কারণে মানুষের আয় কমে গেছে। এ জন্য টেলিভিশন, ফ্রিজ, মোটরসাইকেল কেনার জন্য কেউ ঋণ নিচ্ছেন না। আবার খুচরা ঋণ নিয়েছেন, এমন গ্রাহকদের ৮৫ শতাংশই নিয়মিত শোধ করছেন। ফলে ঋণ আগের চেয়ে কমে গেছে। খুচরা ও ভোক্তা খাতে সুদহার ৯ শতাংশ হলে ব্যাংকের খরচ ওঠে না। এ জন্য অনেক ব্যাংকই এসব ঋণ বিতরণে সতর্ক হয়ে গেছে। তাই এসএমই ও খুচরা ঋণে ৯ শতাংশ সুদ পর্যালোচনার জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংককে অনুরোধ জানানো হয়েছে।’

জানা গেছে, ব্যাংক খাতে বিতরণ করা ভোক্তাঋণের পরিমাণ গত মার্চে ছিল ৬৮ হাজার ২৫৪ কোটি টাকা। ওই সময় পর্যন্ত ২৫ লাখ ৯ হাজার ৮৯৪ জন গ্রাহক ভোক্তা ও খুচরা ঋণ নিয়েছিলেন। তবে গত জুনে এসে ঋণ ৬৬ হাজার ৪৯১ কোটি টাকায় ও ঋণগ্রহীতার সংখ্যা ২৪ লাখ ২০ হাজার ৮৭৯ জনে নেমে আসে। এপ্রিল-জুন তিন মাসে ঋণ ১ হাজার ৭৬৩ কোটি টাকা ও গ্রাহক ৮৯ হাজার ১৫ জন কমেছে।

বাংলাদেশে করোনাভাইরাস প্রথম ধরা পড়ে ৮ মার্চ। সরকারি ছুটি শুরু হয় ২৬ মার্চ থেকে। সাধারণ ছুটি চলে ৩০ মে পর্যন্ত। এই সময়ে ব্যাংকগুলো সীমিত আকারে কার্যক্রম চালু রাখে।

এদিকে বাংলাদেশ ব্যাংক এপ্রিল থেকে ক্রেডিট কার্ড ছাড়া সব ঋণে ৯ শতাংশ সুদহার কার্যকর করার নির্দেশ দেয়। ফলে ব্যাংকগুলো ভোক্তাঋণ বিতরণে আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। কারণ, আগে ভোক্তাঋণে সুদ ছিল ১৪ শতাংশ পর্যন্ত।

ব্যাংক কর্মকর্তারা অবশ্য বলছেন, ভোক্তাঋণের গ্রাহক ধরতে বাসায় ও অফিসে যেতে হয়। কিন্তু করোনার কারণে এপ্রিল ও মে মাসে কারও কাছে যাওয়া সম্ভব হয়নি। এ কারণে ঋণও বিতরণ হয়নি। যেসব খাতে ঋণ বেড়েছে, এসব গ্রাহক নিজেরাই ঝুঁকি নিয়ে ব্যাংকে এসেছেন।

বাংলাদেশ ব্যাংকের এক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, বেশির ভাগ খাতে ভোক্তাঋণ কমলেও বেতনের বিপরীতেও ঋণ বিতরণ বেড়েছে। ব্যাংকগুলো জমি কিনতে ঋণ দিতে পারে না, তবে ভূমি উন্নয়নে দিতে পারে। সংকট এলে জমি কেনা বেড়ে যায়, এবারও তা–ই হয়েছে।

জানতে চাইলে ব্যাংক এশিয়ার ব্যবস্থাপনা পরিচালক আরফান আলী প্রথম আলোকে বলেন, করোনার কারণে গ্রাহকদের চাহিদা ছিল না। এ কারণে নতুন ঋণ বিতরণ হয়নি। এখন গ্রাহকদের চাহিদা বাড়ছে, ঋণও বাড়বে। ভোক্তাঋণে সুদহার বড় বিষয় নয়। সামনের দিনে সুদহার আরও কমতে পারে।

করোনার কারণে গত ২৫ মার্চ থেকে ৩০ মে পর্যন্ত নিবন্ধন অধিদপ্তরের দালিলিক কার্যক্রম বন্ধ ছিল। নিবন্ধন অধিদপ্তরের হিসাবে, গত ৩১ মে থেকে ৩০ জুন পর্যন্ত সারা দেশে ২ লাখ ৪৭ হাজার ৭৮০টি দলিল হয়েছে। সাধারণ সময়েও প্রতি মাসে এর কাছাকাছি দলিল হয়। গত মার্চে জমি কেনায় ঋণ ছিল ৩ হাজার ৭১৭ কোটি টাকা, যা বেড়ে জুনে ৩ হাজার ৯৪০ কোটি টাকায় উন্নীত হয়। আর গ্রাহক ১৫ হাজার ১১৭ থেকে বেড়ে হয়েছে ১৭ হাজার ২১১ জন।

একইভাবে বেতনের বিপরীতে ঋণের পরিমাণও বেড়েছে। মার্চে বেতনের বিপরীতে ঋণের পরিমাণ ছিল ৪ হাজার ৭৫৬ কোটি টাকা, জুনে যা বেড়ে হয়েছে ৫ হাজার ১৯৬ কোটি টাকা।

ব্যাংক কর্মকর্তারা বলছেন, চাকরিজীবীরা অনেকে বাড়তি কাজের সঙ্গে যুক্ত। করোনার কারণে সেই আয় বন্ধ হয়ে গেছে। আবার অনেকের বেতন কমেছে বা বন্ধ হয়ে গেছে। এ জন্য চাকরিজীবীরা ঋণের দিকে ঝুঁকছেন। তবে ব্যাংকগুলো এখন সরকারি কর্মকর্তা বা স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠানের বাইরের চাকরিজীবীদের ঋণ দিচ্ছে না।

জানা গেছে, টেলিভিশন, ফ্রিজ, শীতাতপনিয়ন্ত্রণ যন্ত্র, কম্পিউটার বা ল্যাপটপ ও ফার্নিচার কেনার ক্ষেত্রে ব্যাংকগুলোর দেওয়া ঋণের পরিমাণ মার্চে ছিল ১৯ হাজার ১০৪ কোটি টাকা। তা গত জুনে কমে হয়েছে ১৭ হাজার ৯৫২ কোটি টাকা। এসব ঋণের গ্রাহক ৬ লাখ ৮৮ হাজার ৯২২ থেকে কমে হয়েছে ৬ লাখ ৬১ হাজার ৩৫ জন।

একই সময়ে মোটরসাইকেল ও গাড়িঋণ ৩ হাজার ১৬৮ কোটি টাকা থেকে কমে হয়েছে ৩ হাজার ৭৬ কোটি টাকা। তবে এই সময়ে গ্রাহক বেড়েছে।

জানতে চাইলে ব্র্যাকব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সেলিম আর এফ হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ৯ শতাংশ সুদে খুচরা ঋণ দেওয়া সম্ভব নয়। এই ঋণের খরচ অনেক বেশি, জামানতও থাকে না। ব্যাংকগুলো খুচরা ঋণ বন্ধ করে দিলে দেশের আবাসন, অটোমোবাইল, ইলেকট্রনিক সব খাতই ক্ষতিতে পড়বে। এতে ব্যাংকগুলোর চেয়ে দেশের ক্ষতি হবে বেশি। আবার সাধারণ মানুষ কেনাকাটা বন্ধ করে দিলে আরও অনেক খাত ঝুঁকিতে পড়ে যাবে।