সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ: কেউ পারবেন সর্বোচ্চ দেড় কোটি, কেউ এক কোটি

অবশেষে সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগের সর্বোচ্চ সীমা কাগজে-কলমে নির্ধারণ করেছে সরকার। অর্থ মন্ত্রণালয়ের অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগ (আইআরডি) গতকাল বৃহস্পতিবার এ ব্যাপারে প্রজ্ঞাপন জারি করেছে।

প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, সঞ্চয়পত্র বিধি, ১৯৭৭ এবং পরিবার সঞ্চয়পত্র নীতিমালা ২০০৯-এ বিনিয়োগের ঊর্ধ্বসীমা বিষয়ে যা-ই বলা থাকুক না কেন, এখন থেকে তা আর কার্যকর থাকবে না।    

পাঁচ বছর মেয়াদি বাংলাদেশ সঞ্চয়পত্র, তিন মাস অন্তর মুনাফাভিত্তিক সঞ্চয়পত্র এবং পরিবার সঞ্চয়পত্র—এ তিনটি মিলে সমন্বিত বিনিয়োগের ঊর্ধ্বসীমা হবে একক নামে ৫০ লাখ টাকা অথবা যৌথ নামে এক কোটি টাকা।

পাঁচ বছর মেয়াদি বাংলাদেশ সঞ্চয়পত্র, তিন মাস অন্তর মুনাফাভিত্তিক সঞ্চয়পত্র ও পরিবার সঞ্চয়পত্রের বিনিয়োগের ঊর্ধ্বসীমা বিদ্যমান নীতিমালায় যা-ই থাকুক না কেন, তিনটি স্কিম মিলে একক নামে ৫০ লাখ অথবা যৌথ নামে ১ কোটি টাকা বিনিয়োগ করার বিষয়ে নির্দেশনা জারি করতে হবে।

প্রজ্ঞাপন জারি করা হলেও বাস্তবে বিষয়টি নতুন কিছুই নয়। সর্বোচ্চ বিনিয়োগসীমার কথা এত দিন কাগজে-কলমে কোথাও বলা ছিল না। কিন্তু বাধা ছিল না বিনিয়োগে। একজন গ্রাহক একক নামে এখন ৫০ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র কিনতে পারেন। একক নামে কেউ কিনতে না চাইলে যৌথ নামে কিনতে পারেন এক কোটি টাকার সঞ্চয়পত্র। তবে পেনশনার সঞ্চয়পত্রের গ্রাহকের ক্ষেত্রে এই ঊর্ধ্বসীমা ১ কোটি ৫০ লাখ টাকা।
অর্থাৎ, একক নামে কেউ ৫০ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র কিনতে পারবেন। আর যৌথ নামে কিনতে পারবেন ১ কোটি টাকার। পেনশনার সঞ্চয়পত্র যেহেতু শুধু পেনশনধারীদের জন্য, তাই তাঁদের ক্ষেত্রে বাড়তি সুবিধাটা হচ্ছে এই যে ৫০ লাখের বাইরেও যৌথ নামে তারা আরও এক কোটি টাকার সঞ্চয়পত্র কিনতে পারবেন।  

অর্থ বিভাগের আওতায় চালু ‘জাতীয় সঞ্চয় স্কিম অনলাইন ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম' শীর্ষক সফটওয়্যারের সহায়তায় সঞ্চয়পত্র বিক্রি করা হচ্ছে ২০১৯ সালের ১ জুলাই থেকে। আইআরডি গতকাল যে প্রজ্ঞাপন জারি করেছে, বাস্তবে তা চালু আছেই।
তবে আইআরডি, অর্থ বিভাগ ও সঞ্চয় অধিদপ্তর—প্রজ্ঞাপনটি জারি করতে সময় নিয়েছে প্রায় দেড় বছর। একক ও যৌথ নামে কী পরিমাণ সঞ্চয়পত্র কেনা যাবে, এ নিয়ে একটি নির্দেশনা জারির চেষ্টা চলছে ২০১৯ সালের ১ আগস্ট থেকে। সর্বশেষ গত ২৩ সেপ্টেম্বর সচিবালয়ে অনুষ্ঠিত অর্থ বিভাগের নগদ ও ঋণ ব্যবস্থাপনা কমিটির (সিডিএমসি) বৈঠকে এ নিয়ে সঞ্চয় অধিদপ্তরকে তাগিদ দেওয়া হয়।

এখন নাবালকের নামে কোনো সঞ্চয়পত্র কেনা যায় না। সঞ্চয়পত্রের বিপরীতে এখন আর কোনো সনদও দেওয়া হয় না। ফলে হারিয়ে গেলে, পুড়ে গেলে বা নষ্ট হলে ডুপ্লিকেট সঞ্চয়পত্র ইস্যু করার প্রশ্ন অবান্তর।

বৈঠকের কার্যপত্রে বলা হয়, ‘পাঁচ বছর মেয়াদি বাংলাদেশ সঞ্চয়পত্র, তিন মাস অন্তর মুনাফাভিত্তিক সঞ্চয়পত্র ও পরিবার সঞ্চয়পত্রের বিনিয়োগের ঊর্ধ্বসীমা বিদ্যমান নীতিমালায় যা-ই থাকুক না কেন, তিনটি স্কিম মিলে একক নামে ৫০ লাখ অথবা যৌথ নামে ১ কোটি টাকা বিনিয়োগ করার বিষয়ে নির্দেশনা জারি করতে হবে।’

সিডিএমসির ওই বৈঠকের কার্যপত্রের সিদ্ধান্ত ও গতকালের আইডিআরের প্রজ্ঞাপনের ভাষা মিলিয়ে দেখা যায়, তা হুবহু এক রকম।

প্রথম আলোয় গত ২ অক্টোবর ‘সঞ্চয়পত্র কেনার ঊর্ধ্বসীমা: গোয়ালে আছে, কেতাবে নেই’ শীর্ষক প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। তার আগে গত ২৭ সেপ্টেম্বর সঞ্চয় অধিদপ্তরের মহাপরিচালক সামছুন্নাহার বেগম এ বিষয়ে প্রথম আলোকে বলেছিলেন, ‘নির্দেশনা জারির চেষ্টা চলছে। একটু সময় লাগেই।’

প্রজ্ঞাপনে নতুন কোনো বার্তা না থাকলেও বিভ্রান্তি দূর হবে বলে গ্রাহকেরা খুশি। তবে খুরশীদ আলম নামের একজন গ্রাহক বলেন, ‘তথ্যপ্রযুক্তির এই যুগে সঞ্চয় অধিদপ্তর একটি মান্ধাতার আমলের অফিস। এটি ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়া তো দূরের কথা, ডিজিটাল বাংলাদেশ হওয়ার পথে বরং অন্তরায়। নতুন কোনো সিদ্ধান্ত এলে অধিদপ্তর তার ওয়েবসাইটে তা আপলোড করতে ঢিলেমি করে।’

তা ছাড়া ‘সঞ্চয় আমানতসংশ্লিষ্ট তথ্য সংবলিত সহায়ক পুস্তিকা’ এবং ওয়েবসাইটে বিভ্রান্তিকর ও অসম্পূর্ণ তথ্য দিয়ে রেখেছে। যেমন ২০১৯ সালের ১ জুলাই থেকে নিয়মকানুন বদলে গেলেও অধিদপ্তরের ওয়েবসাইটে এখনো তথ্য দিয়ে রাখা আছে, ৫ বছর মেয়াদি বাংলাদেশ সঞ্চয়পত্র একক নামে ৩০ লাখ ও যুগ্ম নামে ৬০ লাখ টাকার কেনা যায়। এমনকি নাবালকের নামেও কেনা যায়।

আরও বলা আছে, ৩ মাস অন্তর মুনাফাভিত্তিক সঞ্চয়পত্রও কেনা যায় একক নামে সর্বোচ্চ ৩০ লাখ ও যুগ্ম নামে ৬০ লাখ টাকার। পেনশনার সঞ্চয়পত্র কেনা যায় শুধু একক নামে সর্বোচ্চ ৫০ লাখ টাকার এবং পরিবার সঞ্চয়পত্র কেনা যায় একক নামে সর্বোচ্চ ৪৫ লাখ টাকার।

অধিদপ্তর এখনো বলে বেড়াচ্ছে যে সঞ্চয়পত্র হারিয়ে গেলে, পুড়ে গেলে বা নষ্ট হলে ডুপ্লিকেট সঞ্চয়পত্র ইস্যু করা হয়। কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংক, সরকারি-বেসরকারি ব্যাংক, সঞ্চয় অধিদপ্তরের শাখা, ডাকঘর প্রভৃতি যেসব জায়গা থেকে সঞ্চয়পত্র বিক্রি করা হয়, সেসব জায়গায় খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এখন নাবালকের নামে কোনো সঞ্চয়পত্র কেনা যায় না। সঞ্চয়পত্রের বিপরীতে এখন আর কোনো সনদও দেওয়া হয় না। ফলে হারিয়ে গেলে, পুড়ে গেলে বা নষ্ট হলে ডুপ্লিকেট সঞ্চয়পত্র ইস্যু করার প্রশ্ন অবান্তর।

বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর প্রথম আলোকে কয়েক দিন আগে বলেছিলেন, ‘সঞ্চয় অধিদপ্তর খামখেয়ালি করে বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছে। ওয়েবসাইট থেকে সাধারণ তথ্যগুলো জানতে পারলে মানুষের উপকার হয়, কিন্তু এ ব্যাপারে তারা সেকেলে, স্মার্ট নয়।’