সাত বছরে এক কোটি গ্রাহক

বিংশ শতাব্দীর শেষ ভাগে বিশ্বের কয়েকটি দেশে এজেন্ট ব্যাংকিং সেবা চালু হয়। আর বাংলাদেশে সেবাটি আনুষ্ঠানিকভাবে চালু হয় ২০১৪ সালে। ওই বছরের ১৭ জানুয়ারি ব্যাংক এশিয়া প্রথম এজেন্ট ব্যাংকিং সেবা দেওয়া শুরু করে। এখন ২৪টি ব্যাংক এই সেবা দিচ্ছে। সারা দেশের প্রায় ১৫ হাজার আউটলেটে চলছে ব্যাংকিং সেবা। আমানত জমা হয়েছে ১৩ হাজার কোটি টাকার বেশি। করোনার মধ্যে বড় প্রবৃদ্ধি হয়েছে এই সেবার। এজেন্ট ব্যাংকিং নিয়ে বিশেষ আয়োজন।

শীতাতপনিয়ন্ত্রিত সুপরিসর ও ছিমছাম শাখা নয়, সাদামাটা ছোট ঘর। শাখার মতো প্রটোকল কিংবা স্যুট-টাই পরা পরিপাটি কর্মীরাও নেই। এরপরও মিলছে সব ধরনের ব্যাংকিং সেবা। সর্বস্তরের মানুষকে ব্যাংকিং সেবায় টানতে ২০১৪ সালের ১৭ জানুয়ারি দেশে চালু হয়েছিল নতুন ধাঁচের এই ব্যাংকিং সেবা, যার নাম এজেন্ট ব্যাংকিং। মাত্র সাত বছরে এই সেবার গ্রাহক বেড়ে এক কোটির কাছাকাছি পৌঁছেছে।

বর্তমানে দেশব্যাপী পাড়া-মহল্লা ও হাটবাজারে এ রকম ১০ হাজারের বেশি এজেন্ট রয়েছে। বিদায়ী ২০২০ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত নতুন এই ব্যাংকিং কার্যক্রমের মাধ্যমে ৮২ লাখ গ্রাহক হিসাব খুলেছেন। ডিসেম্বর শেষে এই সংখ্যা এক কোটির কাছাকাছি পৌঁছে গেছে বলে জানান ব্যাংক কর্মকর্তারা।

করোনাভাইরাসের প্রকোপের শুরুর দিকে মার্চ-এপ্রিলে ব্যাংকের শাখা বন্ধ থাকার সময় সব এজেন্ট খোলা ছিল। এতে এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের ওপর মানুষের আস্থা বেড়েছে। বদৌলতে করোনাকালে এজেন্ট ব্যাংকিং সেবায় ভালো প্রবৃদ্ধি হয়েছে।

জানতে চাইলে ব্যাংক এশিয়ার ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) আরফান আলী বলেন, করোনার শুরুতে অনেক শাখা বন্ধ ছিল। এজেন্টরা সেই সুযোগ কাজে লাগিয়েছেন। বাড়িতে গিয়ে গ্রাহকদের সেবা দিয়েছেন। এতে গ্রাহকদের আস্থা বেড়েছে। ফলে এই সেবায় বড় প্রবৃদ্ধি হয়েছে।

গত বছরের মার্চ-সেপ্টেম্বর সময়ে নতুন করে দুটি ব্যাংক এজেন্ট ব্যাংকিং সেবা শুরু করে। ফলে দেশে এজেন্ট ব্যাংকিং সেবা প্রদানকারী ব্যাংকের সংখ্যা দাঁড়াল ২৪।

বাংলাদেশ ব্যাংকের এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত বছরের সেপ্টেম্বরে দেশে এজেন্টের সংখ্যা বেড়ে হয় ১০ হাজার ১৬৩, যা মার্চে ছিল ৮ হাজার ২৬০। করোনার মধ্যে ৬ মাসে এজেন্ট বেড়েছে ১ হাজার ৯০৩। সেপ্টেম্বর শেষে আউটলেট বেড়ে হয়েছে ১৪ হাজার ১৬টি, মার্চে যা ছিল ১১ হাজার ৮৭৫টি। ৬ মাসে আউটলেট বেড়েছে ২ হাজার ১৪১টি। আর সেপ্টেম্বর শেষে গ্রাহক বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৮২ লাখ ২১ হাজার ৮৯৩ জনে, যা মার্চে ছিল ৬৪ লাখ ৯৭ হাজার ৪৫১ জন। করোনার ৬ মাসে গ্রাহক বেড়েছে ১৭ লাখ ২৪ হাজার ৪৪২।

জানতে চাইলে সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক লিমিটেডের (এসআইবিএল) এমডি কাজী ওসমান আলী বলেন, ‘এজেন্টরা খুব ভালো করছে। সেবা দ্রুতই সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ছে। এ জন্য চলতি বছরে আরও ১০০ এজেন্ট খোলার পরিকল্পনা করছি।’

জানা গেছে, মার্চ-সেপ্টেম্বর সময়ে নতুন যে হিসাব খোলা হয়েছে, তার মধ্যে নারীর হিসাবের সংখ্যা প্রায় আট লাখ। ফলে গত সেপ্টেম্বরে নারীদের হিসাবের সংখ্যা বেড়ে হয়েছে ৩৭ লাখ ৪৯ হাজার, মার্চে যা ছিল ২৯ লাখ ৫৬ হাজার। আবার মোট ৮২ লাখ হিসাবের মধ্যে গ্রামীণ হিসাবই ৭১ লাখ ১২ হাজার। মার্চে এই সংখ্যা ছিল ৫৫ লাখ ৮৩ হাজার। অর্থাৎ ৬ মাসে গ্রামের মানুষদের হিসাব বেড়েছে ১৫ লাখ ২৯ হাজার।

নতুন প্রজন্মের মধুমতি ব্যাংকের এমডি মো. সফিউল আজম প্রথম আলোকে বলেন, করোনার মধ্যে ভালো প্রবাসী আয় আসছে। প্রবাসী আয় গ্রহণ ও টাকা জমা রাখার জন্য এজেন্ট ব্যাংকিংয়ে অনেকে নতুন হিসাব খুলছেন। আবার করোনায় অনেকে নতুন করে সঞ্চয় শুরু করেছেন। এর ফলে এজেন্ট ব্যাংকিং সেবায় ভালো প্রবৃদ্ধি হচ্ছে। তিনি আরও বলেন, এজেন্টদের মাধ্যমে আরও অনেক সেবা দেওয়া সম্ভব। বিমাযুক্ত আমানত ব্যবস্থা চালু করা যেতে পারে। অনেক ব্যাংক নতুন নতুন সেবা আনার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে।

ব্যাংকাররা বলেন, কেউ বাসার পাশে সেবা পাওয়ায়, আবার কেউ সঞ্চয়ের জন্য এজেন্ট ব্যাংকিং হিসাব খুলেছেন। করোনাকালে এজেন্ট ব্যাংকিংয়ে গ্রাহক ও আমানতের পাশাপাশি ঋণ বিতরণ আর প্রবাসী আয় তথা রেমিট্যান্স আনার পরিমাণও বেড়েছে।

এজেন্ট ব্যাংকিংয়ে গত সেপ্টেম্বরে আমানত বেড়ে হয়েছে ১৩ হাজার ৪০ কোটি টাকা, মার্চে যা ছিল ৮ হাজার ৫৩৫ কোটি টাকা। এই সময়ে আমানত বেড়েছে ৪ হাজার ৫০৫ কোটি টাকা। সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ঋণ বিতরণ হয়েছে ১ হাজার ৮৬ কোটি টাকা, মার্চে যা ছিল ৬৭৩ কোটি টাকা। ঋণ বেড়েছে ৪১৩ কোটি টাকা।

জানুয়ারি-মার্চ প্রান্তিকে যেখানে এজেন্টদের মাধ্যমে প্রবাসী আয় এসেছিল ১৯ হাজার ৫৩৫ কোটি টাকা, সেখানে জুলাই-সেপ্টেম্বর প্রান্তিকে তা বেড়ে হয়েছে ৩৯ হাজার ৩৫৩ কোটি টাকা। আগের প্রান্তিকের চেয়ে পরের তিন মাসে প্রবাসী আয় বেড়ে দ্বিগুণ হয়েছে।

পদ্মা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এহসান খসরু প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাদের দুটো এজেন্ট প্রায় আট কোটি টাকা আমানত এনেছে। সারা দেশে এজেন্ট সেবা ছড়িয়ে দিতে চলতি বছরে ১০০ এজেন্ট চালুর পরিকল্পনা আছে।’

ব্যাংকগুলো এজেন্ট ব্যাংকিং সেবা ইউনিয়ন পর্যায়ে নিয়ে গেছে। আমানত রাখা, ঋণ বিতরণ ও প্রবাসী আয় আনার পাশাপাশি স্কুল ব্যাংকিং চালু করেছে এবং গ্রামগঞ্জে সরকারের সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির ভাতাও বিতরণ করছে এজেন্টরা। সব মিলিয়ে এজেন্ট ব্যাংকিং চালু হওয়ার ফলে ব্যবসা-বাণিজ্যসহ গ্রামীণ অর্থনীতি চাঙা হচ্ছে।

প্রিমিয়ার ব্যাংকের এমডি এম রিয়াজুল করিম প্রথম আলোকে বলেন, ‘এজেন্ট ব্যাংকিং সেবা দ্রুত ছড়িয়ে দিতে আমরা মোবাইল অপারেটর রবির সঙ্গে চুক্তি করেছি। বাংলাদেশ ব্যাংক থেকেও অনুমোদন পাওয়া গেছে। এর ফলে রবির কেন্দ্রগুলোতে প্রিমিয়ার ব্যাংকের এজেন্ট ব্যাংকিং সেবা পাওয়া যাবে।’