মূল্যস্ফীতির চাপে সাধারণ মানুষ, কমেছে ফ্রিজ, টেলিভিশন বিক্রি

দেশের চলমান অর্থনৈতিক সংকটের পরিস্থিতিতে ফ্রিজ–ফ্রিজার, টেলিভিশনসহ গৃহস্থালিতে ব্যবহার্য বিভিন্ন ইলেকট্রিক ও ইলেকট্রনিকস সামগ্রীর বিক্রি উল্লেখযোগ্য পরিমাণে কমেছে। বাজারে এসব পণ্যের বিক্রি কমার পাশাপাশি বিদেশের রপ্তানির ক্ষেত্রেও ভাটা পড়েছে।

তবে তীব্র দাবদাহের কারণে শীতাতপনিয়ন্ত্রণ যন্ত্র (এসি) বিক্রি অবশ্য বেড়েছে। ইলেকট্রনিকস পণ্যের দেশীয় জায়ান্ট ওয়ালটনের বার্ষিক বিক্রির হিসাব থেকে এ রকম তথ্যই পাওয়া গেছে। বিক্রি কমে যাওয়ার বড় প্রভাব পড়েছে কোম্পানিটির আয় ও মুনাফায়।

ওয়ালটন সম্প্রতি গত জুনে সমাপ্ত সর্বশেষ অর্থবছরের আর্থিক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। তাতে কোম্পানিটির পণ্য বিক্রির বিভিন্ন তথ্য তুলে ধরা হয়েছে। সেই সব তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, এক বছরের ব্যবধানে ওয়ালটনের ফ্রিজ, ফ্রিজার ও কম্প্রেসর বিক্রি কমেছে প্রায় ১ হাজার ৩০০ কোটি টাকা। টিভি বিক্রি কমেছে ২০৭ কোটি টাকা।

আর্থিক প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, ২০২১–২২ অর্থবছরে ওয়ালটন ফ্রিজ, ফ্রিজার ও কম্প্রেসর বিক্রি করেছিল ৫ হাজার ৬২৪ কোটি টাকার। আর সর্বশেষ ২০২২–২৩ অর্থবছরে কোম্পানিটি ফ্রিজ, ফ্রিজার ও কম্প্রেসর বিক্রি করেছে ৪ হাজার ৩৩২ কোটি টাকার। সেই হিসাবে এক বছরে এই কোম্পানির ফ্রিজ, ফ্রিজার ও কম্প্রেসর বিক্রি কমেছে ১ হাজার ২৯২ কোটি টাকা বা প্রায় ২৩ শতাংশ।

একইভাবে ২০২১–২২ অর্থবছরে ওয়ালটন টিভি বিক্রি করেছিল ৮৮৮ কোটি টাকার, যা ২০২২–২৩ অর্থবছরে কমে ৬০৭ কোটি টাকায় নেমে আসে। এক বছরে দেশের বাজারে কোম্পানিটির টেলিভিশন বিক্রি কমেছে ২৮১ কোটি টাকা বা প্রায় ৩২ শতাংশ। ২০২১–২২ অর্থবছরে এই প্রতিষ্ঠানের তৈরি গৃহস্থালিতে ব্যবহার্য ইলেকট্রনিকস পণ্য বিক্রি করেছিল ৪৮৫ কোটি টাকার, যা গত অর্থবছরে কমে হয় ৩৫০ কোটি টাকা। এক বছরে তাদের গৃহস্থালিতে ব্যবহার্য ইলেকট্রনিকস সামগ্রীর বিক্রি কমেছে ১৩৫ কোটি টাকা বা ২৮ শতাংশ।

দেশে ফ্রিজ–টিভি বিক্রি কমে যাওয়ার কারণ হিসেবে পণ্যমূল্য বৃদ্ধি ও মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমে যাওয়াকে প্রধান কারণ হিসেবে উল্লেখ করেছেন ওয়ালটনের কোম্পানি সচিব রফিকুল ইসলাম। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘ডলারের মূল্যবৃদ্ধির কারণে আমাদের কাঁচামাল আমদানির খরচ বেড়ে গেছে। তাই বাধ্য হয়ে আমাদের পণ্যের দাম সমন্বয় করতে হয়েছে। এ ছাড়া উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমে যাওয়ায় তাঁরা টিভি–ফ্রিজের মতো পণ্য কেনা কমিয়ে দিয়েছেন।’

শুধু ওয়ালটনেরই নয়, এ খাতের অন্য সব কোম্পানির পণ্যও বিক্রি কমেছে। এদিকে টিভি–ফ্রিজ ও গৃহস্থালিতে ব্যবহার্য ইলেকট্রনিকস পণ্য বিক্রি কমলেও এসি বিক্রি অবশ্য বেড়েছে ওয়ালটনের। কোম্পানিটি ২০২১–২২ অর্থবছরে ৪৪২ কোটি টাকার এসি বিক্রি করেছিল। সর্বশেষ ২০২২–২৩ অর্থবছরে এসি বিক্রি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৬১৮ কোটি টাকা। এক বছরে কোম্পানিটির এসি বিক্রি বেড়েছে ১৭৬ কোটি টাকা বা প্রায় ৪০ শতাংশ।

কোম্পানিগুলোর সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, এসি বিক্রি বেড়ে যাওয়ার অন্যতম কারণ তীব্র দাবদাহ। গত এপ্রিলে দেশজুড়ে তীব্র দাবদাহ চলে। আবহাওয়া অধিদপ্তরের কাছে থাকা বিগত ৬০ বছরের তাপমাত্রার পরিসংখ্যান অনুযায়ী, এপ্রিলে সারা দেশের সর্বোচ্চ গড় তাপমাত্রা ছিল ৩৩ দশমিক ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এপ্রিলের প্রথম ১৬ দিনে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে ১ থেকে ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেশি ছিল বলে আবহাওয়া অধিদপ্তরের আবহাওয়াবিদেরা জানিয়েছিলেন।

এ গরম থেকে বাঁচতে ওই সময় এসি কেনার ধুম পড়ে। এমনকি চাহিদা অনুযায়ী এসি সরবরাহ করতে হিমশিম খেতে হয় বিপণনকারী কোম্পানিগুলোকে। আবার এসি কেনার পরও তা লাগাতে অনেককে সপ্তাহের বেশি অপেক্ষা করতে হয়েছে ইলেকট্রিশিয়ান পেতে।

টিভি রপ্তানি কমেছে ৯১%

দেশের বাজারে ওয়ালটনের টেলিভিশন ও ফ্রিজ বিক্রি কমার পাশাপাশি বিদেশে এই দুটি পণ্যের রপ্তানিও কমেছে। ২০২১–২২ অর্থবছরে ওয়ালটন ১৯৫ কোটি টাকার ফ্রিজ, ফ্রিজার ও কম্প্রেসর রপ্তানি করেছিল। গত ২০২২–২৩ অর্থবছরে এ রপ্তানি কমে ১২২ কোটি টাকায় নেমে যায়। অর্থাৎ এক বছরে এসব পণ্যের রপ্তানি কমেছে ৭৩ কোটি টাকা বা প্রায় সাড়ে ৩৭ শতাংশ। সবচেয়ে বেশি রপ্তানি কমেছে টেলিভিশনের। এক বছরের ব্যবধানে ওয়ালটনের টেলিভিশন রপ্তানি কমেছে ৯১ শতাংশের বেশি।

২০২১–২২ অর্থবছরে কোম্পানিটি বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ৩৫ কোটি টাকার টেলিভিশন রপ্তানি করেছিল, যা গত অর্থবছরে কমে ৩ কোটি টাকায় নেমে এসেছে।

রপ্তানি কমে যাওয়ার কারণ হিসেবে রাশিয়া–ইউক্রেন যুদ্ধকে দায়ী করেন ওয়ালটনের কোম্পানি সচিব রফিকুল ইসলাম। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা যেসব বাজারে পণ্য রপ্তানি করি, সেগুলোতে রপ্তানি বিঘ্নিত হয় এই যুদ্ধের কারণে। রপ্তানি বাড়াতে আমাদের উদ্যোগগুলো যুদ্ধের কারণে বাধাগ্রস্ত হয়েছে। আশা করছি, যুদ্ধ পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে আমরা আবারও হারানো রপ্তানি বাজার ভালোভাবে ফিরে পাব।’