বাজারে অস্বস্তি আবার বাড়ছে

  • মূল্যস্ফীতি এখনো ৯ শতাংশের বেশি। 

  • অনুমোদিত সীমার বেশি ব্যবহারে গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধি উৎপাদন খরচ বাড়াবে। 

বোতলজাত সয়াবিন তেলের দাম এক লাফে লিটারে ১৪ টাকা বাড়ল। সয়াবিনের বিকল্প পাম তেলের দাম বেড়েছে লিটারে ১২ টাকা। সরকার করছাড় তুলে নেওয়ায় গতকাল মঙ্গলবার দাম বাড়ানোর এ সিদ্ধান্ত হয়। 

বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে গতকাল অনুষ্ঠিত বৈঠকে যেমন ভোজ্যতেলের দাম বাড়ানোর এ সিদ্ধান্ত হয়েছে, তেমনি কয়েক দিনে বাজারে বেড়েছে পেঁয়াজ, ডিম ও সবজির দাম। কিছুটা বেড়েছে আটার দাম। আগে থেকে বাড়তি থাকা চাল-ডালের দাম কমার লক্ষণ নেই। 

সরকার গত রোববার নতুন কারখানা ও অনুমোদিত সীমার (লোড) অতিরিক্ত ব্যবহারের ক্ষেত্রে গ্যাসের দামও ৩৩ শতাংশ বাড়িয়েছে, যার প্রভাবে পণ্যের উৎপাদন খরচ বাড়ার আশঙ্কা আছে। উল্লেখ্য, পেট্রোবাংলার হিসাবে, ২০২৩ সালের নভেম্বর থেকে ২০২৪ সালের অক্টোবর পর্যন্ত শিল্পে অনুমোদিত লোডের চেয়ে ১৪ কোটি ৭৮ লাখ ঘনমিটার গ্যাস বাড়তি ব্যবহার করা হয়েছে। আর ক্যাপটিভে (কারখানার নিজস্ব বিদ্যুৎকেন্দ্র) ৫ কোটি ৭৬ লাখ ঘনমিটার গ্যাস বাড়তি ব্যবহার করা হয়েছে। এই গ্যাসের দাম নতুন হারে দিতে হবে। 

করছাড় তুলে নেওয়া, গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধি ও বাজারে দাম বেড়ে যাওয়ার এসব ঘটনা এমন একটা সময়ে ঘটছে, যখন সরকার মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছে। কিন্তু মূল্যস্ফীতি উল্লেখযোগ্য হারে কমছে না। এখনো মূল্যস্ফীতি (মার্চ) ৯ শতাংশের বেশি। 

সয়াবিন তেলের দাম এক লাফে অনেকটা বাড়িয়ে দেওয়া নিয়ে সমালোচনা হচ্ছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। কেউ কেউ কর ছাড় দিয়ে পুরোনো দামে ফিরিয়ে নেওয়ার অনুরোধ জানাচ্ছেন। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ফেসবুক পেজে গতকাল এক পোস্টে বলা হয়েছে, সরকারকে এই সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা করতে হবে। দাম বাড়ানোর পেছনে যত অজুহাতই সরকার দিক না কেন, সেটা অগ্রহণযোগ্য।

ফেসবুক পোস্টটিতে ফায়েজ আহমেদ নামের এক ব্যক্তি লিখেছেন, দাম কমান। সাধারণ মানুষের কথা চিন্তা করেন। এমনিতেই সয়াবিন তেলের দাম মানুষের সাধ্যের বাইরে। 

আরও পড়ুন
করছাড় তুলে নেওয়ায় সয়াবিন তেলের দাম লিটারে ১৪ টাকা বাড়ল। বেড়েছে পেঁয়াজ, ডিম ও সবজির দরও। 

কত দাঁড়াল সয়াবিন তেলের দাম

লিটারে ১৪ টাকা বাড়িয়ে এক লিটারের এক বোতল সয়াবিন তেলের দাম নির্ধারণ করা হয়েছে ১৮৯ টাকা, যা এত দিন ছিল ১৭৫ টাকা। বোতলজাত পাঁচ লিটার সয়াবিন তেলের দাম নির্ধারণ করা হয়েছে ৯২২ টাকা; আগে যা ছিল ৮৫২ টাকা। 

অন্যদিকে প্রতি লিটার খোলা সয়াবিন তেলের দাম ১৫৭ থেকে বেড়ে হয়েছে ১৬৯ টাকা। খোলা পাম তেলও ১৫৭ থেকে বাড়িয়ে ১৬৯ টাকা লিটার করা হয়েছে। অর্থাৎ খোলা সয়াবিন ও পাম তেলের দাম বেড়েছে লিটারে ১২ টাকা। 

বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীনের সঙ্গে গতকাল ভোজ্যতেল ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বৈঠকের পর সয়াবিন তেল ও পাম তেলের নতুন দাম ঘোষণা করা হয়। সচিবালয়ে বৈঠকটি অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকের পর গতকালই এক বিজ্ঞপ্তিতে মিলমালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ ভেজিটেবল অয়েল রিফাইনার্স অ্যান্ড বনস্পতি ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশন জানায়, ১৩ এপ্রিল অর্থাৎ রোববার থেকেই নতুন দাম কার্যকর বলে গণ্য হবে। 

এর আগে গত ৯ ডিসেম্বর সর্বশেষ বোতলজাত সয়াবিন তেলের দাম বাড়ানো হয়েছিল। তখন বেড়েছিল লিটারে ৮ টাকা। এরপরও ব্যবসায়ীরা আন্তর্জাতিক বাজারে মূল্যবৃদ্ধির কথা জানিয়ে দাম বাড়ানোর চিঠি দিয়েছিলেন। তবে সরকার শুল্ক-করে ছাড় দিয়ে মূল্য বৃদ্ধি ঠেকিয়ে রাখে। গত ১৭ অক্টোবর ভোজ্যতেল আমদানি, উৎপাদন ও ব্যবসায়ী পর্যায়ে মূল্য সংযোজন করের হার (মূসক/ভ্যাট) ১৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১০ শতাংশ করে সরকার। নভেম্বরে আরও কমিয়ে ভ্যাট ৫ শতাংশ নির্ধারণ করা হয়। 

তেলকল মালিক সমিতি বলছে, ভ্যাট অব্যাহতির মেয়াদ গত ৩১ মার্চ শেষ হয়েছে। ফলে সয়াবিন তেলের এক লিটারের বোতলের দাম হওয়ার কথা ১৯৮ টাকা। তবে ভোক্তার স্বার্থ বিবেচনায় নির্ধারণ করা হয়েছে ১৮৯ টাকা।

বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে বৈঠকের পর সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন। করছাড় তুলে নেওয়ার কারণ তুলে ধরে তিনি বলেন, এত দিন সরকার প্রতি মাসে প্রায় ৫৫০ কোটি টাকা রাজস্ব ছাড় দিয়েছে। রমজান পর্যন্ত গত কয়েক মাসে প্রায় দুই হাজার কোটি টাকার রাজস্ব ছাড় দেওয়া হয়েছে। কিন্তু সরকার পরিচালনার ব্যয়ের কথা বিবেচনা করে এভাবে রাজস্ব ছাড় দেওয়ার ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধতা আছে। 

মূল্যবৃদ্ধির প্রসঙ্গে বাণিজ্য উপদেষ্টা বলেন, ‘ভোক্তাপর্যায়ে আজ যে মূল্য বৃদ্ধি করতে বাধ্য হলাম, আমি মনে করছি, এই বাধ্যবাধকতা সাময়িক। অদূর ভবিষ্যতে এই দাম কমানো সম্ভব হবে।’ তিনি বলেন, ভ্যাট অব্যাহতি আরেকটু দীর্ঘায়িত করা যেত কি না, সরকার সেই চেষ্টা করেছে। কিন্তু শেষমেশ দেখা গেল, এ মুহূর্তে ভ্যাট অব্যাহতি দেওয়া সরকারের জন্য খুবই সংবেদনশীল বিষয়। 

আরও পড়ুন

দাম বাড়ছে আরও পণ্যের

পবিত্র রমজান মাসে পেঁয়াজের দাম কম ছিল। ৩০ থেকে ৪০ টাকা কেজি পেঁয়াজ কেনা গেছে। তবে তিন দিন ধরে দাম বাড়ছে। গতকাল প্রতি কেজি দেশি পেঁয়াজ বিক্রি হয়েছে ৪৫-৫০ টাকায়। পাবনার পেঁয়াজের দাম আরও বেশি, কেজি ৫৫-৬০ টাকা। বিক্রেতারা জানান, তিন দিন আগে পেঁয়াজের দাম হঠাৎ বেড়ে যায়। 

সরকারি সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশও (টিসিবি) জানিয়েছে, পেঁয়াজের দর ৫ থেকে ১০ টাকা বেড়েছে। বিক্রি হচ্ছে ৪০ থেকে ৫৫ টাকায়। ব্যবসায়ীরা জানান, চলতি বছর পেঁয়াজের ফলন ভালো হয়েছে। এ কারণে মৌসুমের শুরু থেকেই দাম গত বছরের তুলনায় কম ছিল। তবে এখন দাম বেড়ে গেছে।

পবিত্র ঈদুল ফিতরের পর চাহিদা কমায় বাজারে ব্রয়লার ও সোনালি মুরগির দাম কমেছে। গতকাল প্রতি কেজি ব্রয়লার মুরগি বিক্রি হয়েছে ১৬০-১৭০ টাকা এবং সোনালি মুরগি বিক্রি হয়েছে ২২০-২৬০ টাকায়। তবে কিছুটা বেড়েছে ডিমের দাম। ফার্মের মুরগির বাদামি এক ডজন ডিম বড় বাজারে ১২০-১২৫ টাকা এবং মহল্লার মুদিদোকানে ১৩০ টাকায় পাওয়া যাচ্ছে। বিক্রেতাদের দাবি, এক সপ্তাহে ডজনে ১০ টাকার মতো বেড়েছে। 

চালের দাম অনেক দিন ধরেই চড়া। নতুন করে দাম বাড়েনি বলে জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা। তবে টিসিবি জানাচ্ছে, খোলা আটার সর্বনিম্ন দাম কেজিতে ২ টাকা বেড়েছে। ডালের দাম আগের মতোই বেশি। নতুন করে হেরফের হয়নি। চিনির দামও আগের মতো রয়েছে, কেজি ১২০ টাকার আশপাশে। 

বেড়েছে সবজির দাম। ব্যবসায়ীরা বলছেন, শীতের সবজির সরবরাহ শেষ। এখন গ্রীষ্মের সবজির চাহিদা বেশি। নতুন সবজি আসছে। দাম চড়া। কৃষি বিপণন অধিদপ্তর ১৪টি সবজির দামের হিসাব দেয়। গতকালের হিসাবে দেখা যায়, এক মাসে তিনটি সবজির দাম কমেছে—বেগুন, বরবটি ও করলা। তিনটি সবজির আগের দামের হিসাব তারা দেয়নি। একটির দর স্থিতিশীল। সাতটির দাম বেড়েছে—কাঁচা পেঁপে, মিষ্টিকুমড়া, চিচিঙ্গা, দেশি টমেটো, লাউ, চালকুমড়া ও দেশি গাজর। মূল্যবৃদ্ধির হার সর্বনিম্ন ১৪ থেকে সর্বোচ্চ ৫৬ শতাংশ। 

কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের হিসাবে, সবজি যৌক্তিক মূল্যের অনেক বেশি দরে বিক্রি হচ্ছে। যেমন ঢাকার খুচরা বাজারে কাঁচা পেঁপের যৌক্তিক দর হওয়া উচিত ২৩ টাকা কেজি। বিক্রি হচ্ছে ৪০ থেকে ৬০ টাকায়। বাজার ঘুরে দেখা গেছে, বেশির ভাগ সবজির কেজি ৫০ থেকে ৮০ টাকা। 

আরও পড়ুন

রাজস্ব আদায় ও ভর্তুকি কমাতেই ‘প্রাধান্য’ 

সরকার সব সময় আমদানিনির্ভর বিভিন্ন নিত্যপণ্যে শুল্কছাড় দেয়। এর মধ্যে রয়েছে গম, ডাল, পেঁয়াজ, রসুন ইত্যাদি। আবার কিছু পণ্য আমদানির প্রয়োজন হলে শুল্কছাড় দেওয়া হয়। যেমন চাল। তবে নিয়মিত আমদানি হওয়া ভোজ্যতেল, চিনি, গুঁড়া দুধ, গরম মসলা ও ফলে উচ্চ হারে শুল্ক-কর রয়েছে। উল্লেখ্য, এসবের মধ্যে ভোজ্যতেলে শুল্ক-কর অন্য পণ্যের চেয়ে কম। 

জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) হিসাবে, ২০২৪ সালে সয়াবিন ও পাম তেল থেকে আমদানি পর্যায়ে সরকার রাজস্ব পেয়েছে ২ হাজার ৯১২ কোটি টাকা। চিনি থেকে সরকার বছরে ৪ থেকে ৫ হাজার কোটি টাকা আয় করে। 

সরকারের রাজস্ব আয়ের মাধ্যম কি নিত্যপণ্য হওয়া উচিত, জানতে চাইলে ঢাকায় বিশ্বব্যাংকের কার্যালয়ের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার অনুমান, সরকারের কাছে এখন রাজস্ব আয় বাড়ানো ও ভর্তুকি কমানোর বিষয়টি প্রাধান্য পাচ্ছে। কারণ, আইএমএফের (আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল) ৪৭০ কোটি ডলার ঋণের পরবর্তী দুটি কিস্তি পেতে রাজস্ব আয় বাড়াতে হবে, ভর্তুকি কমাতে হবে।’ 

এদিকে রাতে এক বিবৃতিতে ভোজ্যতেলের দাম বাড়ানোর প্রতিবাদ জানিয়েছে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)। তারা বলেছে, ‘বর্তমান অর্থনৈতিক বাস্তবতায় দেশের বৃহৎ জনগোষ্ঠী নিম্ন ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির। এ কারণে হঠাৎ দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি তাদের দৈনন্দিন জীবনে চাপ সৃষ্টি করছে। আমরা মনে করি, শুধু ব্যবসায়ীদের দাবিতে নয়; বরং ভোক্তা সংগঠন ও শ্রমজীবী নাগরিকের মতামত ও অংশগ্রহণের ভিত্তিতে দাম নির্ধারণই হবে সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য ও ন্যায্য।’

আরও পড়ুন