কৃষিজাত পণ্য রপ্তানিতে সম্ভাবনা, আছে চ্যালেঞ্জও

ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) কিংবা যুক্তরাষ্ট্রের নামীদামি ব্র্যান্ডের বিক্রয়কেন্দ্রে ‘বাংলাদেশে তৈরি’ ট্যাগ লাগানো পোশাকের আধিক্য নতুন কিছু নয়। তবে মধ্যপ্রাচ্য, ইইউ, এমনকি আফ্রিকা অঞ্চলের বিভিন্ন দেশের সুপারশপে এখন ‘বাংলাদেশে তৈরি’ প্রক্রিয়াজাত খাদ্যপণ্যের দেখাও মেলে। এই প্রক্রিয়াজাত খাদ্যপণ্যই নতুন রপ্তানি খাত হিসেবে আশা দেখাচ্ছে।

কৃষি ও প্রক্রিয়াজাত খাদ্যপণ্য অথবা কৃষিজাত পণ্য দেশের শীর্ষ পাঁচ রপ্তানি খাতের একটি। করোনার পর ২০২০-২১ অর্থবছরে প্রথমবার এই খাতের রপ্তানি এক বিলিয়ন বা ১০০ কোটি ডলার ছাড়িয়ে যায়। পরের বছর সেটি বেড়ে ১১৬ কোটি ডলারে উন্নীত হয়। যদিও বিদায়ী অর্থবছরে রপ্তানি ২৭ শতাংশ কমে ৮৪ কোটি ডলারে নেমেছে।

এমন প্রেক্ষাপটে কৃষিজাত পণ্যের রপ্তানি বাড়াতে চায় সরকার। গত মাসে নতুন সরকারের প্রথম বৈঠকে রপ্তানি বহুমুখীকরণ এবং নতুন বাজার অনুসন্ধান করে সেখানে প্রবেশে কীভাবে সহায়তা করা যায়, সে বিষয়ে নির্দেশনা দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বিশেষ করে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য; পাট ও পাটজাত পণ্য এবং কৃষিজাত পণ্য—এই তিনটি খাতকে তৈরি পোশাকশিল্পের বিকাশে যেভাবে সহায়তা দেওয়া হয়েছিল, প্রয়োজনে সে রকম সহায়তা দিয়ে যেন বিশেষ উদ্যোগ নেওয়া হয়, সে বিষয়ে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়কে নির্দেশনা দেন প্রধানমন্ত্রী।

কয়েকজন উদ্যোক্তা জানান, কৃষি ও প্রক্রিয়াজাত খাদ্যপণ্য রপ্তানিতে বড় সম্ভাবনা রয়েছে। পাশাপাশি কিছু চ্যালেঞ্জও রয়েছে এ খাতে। তার মধ্যে অন্যতম প্রক্রিয়াজাত খাদ্য উৎপাদনের জন্য বিভিন্ন ধরনের উপকরণ উচ্চ শুল্ক দিয়ে আমদানি করতে হয়। এ ক্ষেত্রে রপ্তানিমুখী কারখানা বন্ডেডওয়্যার হাউস সুবিধায় এসব উপকরণ শুল্কমুক্ত সুবিধায় আমদানি করে। অন্য কারখানাগুলো এই সুবিধা না পেলেও নগদ সহায়তা পায়। যদিও উন্নয়নশীল দেশ হলে নগদ সহায়তা থাকবে না। ফলে ছোট-বড় সব রপ্তানিকারকের জন্য শুল্কমুক্ত সুবিধায় উপকরণ আমদানির সুযোগ সৃষ্টি করা প্রয়োজন।

বাংলাদেশ থেকে কুয়েত, কাতার, সৌদি আরব, জার্মানি, বেলজিয়াম, নেদারল্যান্ডস, যুক্তরাজ্যসহ ১৪৪টি দেশে কৃষিজাত পণ্য রপ্তানি হয়। কৃষিজাত পণ্যের মধ্যে রয়েছে প্রক্রিয়াজাত খাদ্যপণ্য, তাজা ও হিমায়িত সবজি, ফলমূল ইত্যাদি। আর প্রক্রিয়াজাত খাদ্যের মধ্যে মসলা, চানাচুর, ঝালমুড়ি, বিস্কুট, সস, জেলি, আলুপুরি, পাঁপড়, নুডলস, চকলেট, বিভিন্ন ধরনের আচার, জুস, ফ্রুট ড্রিংক, চিপসসহ বিভিন্ন পণ্য।

কৃষি ও প্রক্রিয়াজাত খাদ্যপণ্য খাতের সম্ভাবনা নিয়ে বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা) এবং ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২২ সালে কৃষি ও প্রক্রিয়াজাত খাদ্যপণ্যের বৈশ্বিক বাজারের আকার ছিল ১৩ দশমিক ৩ ট্রিলিয়ন বা ১৩ লাখ ৩০ হাজার মার্কিন ডলার। আর গত বছর বাংলাদেশের প্রক্রিয়াজাত খাদ্যপণ্যের বাজার (দেশীয় চাহিদা ও রপ্তানি) ছিল ৪৮০ কোটি ডলারের। আর কৃষিপণ্যের বাজার ছিল ৪ হাজার ৭৫৪ কোটি ডলারের।

দেশে প্রক্রিয়াজাত খাদ্যপণ্যের প্রায় এক হাজার কারখানা রয়েছে। তার মধ্যে ৯০ শতাংশই অতি ক্ষুদ্র ও ক্ষুদ্র। বাকি ১০ শতাংশ মাঝারি ও বড়। এর মধ্যে রপ্তানির সঙ্গে যুক্ত রয়েছে ২৫০ কারখানা। রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্যানুযায়ী, গত অর্থবছর মোট ৫ হাজার ৫৫৬ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানির মধ্যে কৃষিজাত খাদ্যপণ্যের হিস্যা ছিল দেড় শতাংশ। বাংলাদেশ এক বিলিয়ন ডলারের কৃষিজাত পণ্য রপ্তানি করলেও পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত এ ক্ষেত্রে বেশ এগিয়ে আছে।

ভারতের কৃষি ও প্রক্রিয়াজাত খাদ্যপণ্য রপ্তানি উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের তথ্যানুযায়ী, বিদায়ী ২০২২-২৩ অর্থবছর ভারত শুধু প্রক্রিয়াজাত খাদ্যপণ্য রপ্তানি করেছে ৭৪০ কোটি ডলারের। তার মধ্যে আমের পাল্প ১৫, প্রক্রিয়াজাত করা সবজি ৬২, প্রক্রিয়াজাত করা ফল ও জুস ৫৯, নারকেলের পণ্য রয়েছে ১৫ কোটি ডলারের।

বর্তমানে বিশ্বের ২০টি দেশে বিভিন্ন ধরনের প্রক্রিয়াজাত খাদ্য, পানীয় ও মসলা রপ্তানি করে চট্টগ্রামভিত্তিক কোম্পানি হিফস অ্যাগ্রো ফুড ইন্ডাস্ট্রিজ। গত বছর প্রতিষ্ঠানটির রপ্তানি ছিল ৩২ লাখ মার্কিন ডলার।

হিফস অ্যাগ্রোর প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ছৈয়দ মুহাম্মদ সোয়াইব হাছান প্রথম আলোকেবলেন, ‘আমরা প্রক্রিয়াজাত খাদ্য উৎপাদনে প্রতিনিয়ত শিখছি। সরকারের বিভিন্ন সংস্থার কর্মকর্তারা মাঝেমধ্যে কারখানা পরিদর্শনে এসে কোনো ত্রুটিবিচ্যুতি পেলে উদ্যোক্তাদের জরিমানা করেন। এ ক্ষেত্রে তাঁরা ত্রুটি চিহ্নিত করার পর তা সংশোধনের জন্য উদ্যোক্তাদের যদি সময় বেঁধে দেন এবং সেই সময় পর আবার পরিদর্শন করে যাচাই করেন, তাহলে আমরা এগিয়ে যাব। এ ছাড়া প্যাকেজিং বা মোড়ক পণ্য এবং বিভিন্ন ধরনের উপকরণ আমদানিতে শুল্কমুক্ত সুবিধা দেওয়া হয়, তাহলে কৃষি ও প্রক্রিয়াজাত পণ্যের রপ্তানি দ্বিগুণ করা সম্ভব।’

দেশের অন্যতম শীর্ষস্থানীয় প্রক্রিয়াজাত খাদ্যপণ্য রপ্তানিকারক প্রাণ গ্রুপ। তারা জুস অ্যান্ড ড্রিংকস, স্ন্যাক্স, বিস্কুট, কালিনারি, কনফেকশনারি, ফ্রোজেন ফুডসসহ বিভিন্ন পণ্য ভারত, সৌদি আরব, ওমান, সংযুক্ত আরব আমিরাত, মালয়েশিয়া, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, যুক্তরাষ্ট্র, ইতালি, ইউকে ও আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে রপ্তানি করে। প্রাণ গ্রুপের বার্ষিক পণ্য রপ্তানি ৩০ কোটি ডলারের।

প্রাণ গ্রুপের চেয়ারম্যান ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) আহসান খান চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, ‘কৃষি ও প্রক্রিয়াজাত খাদ্যপণ্যের রপ্তানিতে বাংলাদেশের সম্ভাবনা অসীম। তবে আমরা এখনো সম্ভাবনার ১ শতাংশও কাজে লাগাতে পারিনি। আমাদের কোম্পানির রপ্তানি ৩০ কোটি ডলার। তবে খুব সহজেই সেটিকে ৩০ বিলিয়নে নিয়ে যাওয়া সম্ভব। তবে সীমাবদ্ধতাও আছে।’

আহসান খান চৌধুরী আরও বলেন, প্রক্রিয়াজাত খাদ্যপণ্য উৎপাদনে বাংলাদেশে অনেক শিল্পকারখানা গড়ে উঠবে। তার জন্য কয়েকটি ফসলকে টার্গেট করে উৎপাদন বাড়াতে হবে। তা ছাড়া শুল্কমুক্ত সুবিধায় কাঁচামাল আনার জন্য ছোট, মাঝারি ও বড় কারখানাকে সুযোগ দিতে হবে। এটি করা গেলে উদ্যোক্তাদের নগদ সহায়তার কোনো প্রয়োজন হবে না।