শিল্প ও সেবা খাতে প্রবৃদ্ধি কম, ভালো করছে কৃষি খাত

মোট দেশজ উৎপাদন বা জিডিপিতে শিল্প ও সেবা খাতের প্রবৃদ্ধি গত অক্টোবর-ডিসেম্বর প্রান্তিকে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে কমে গেছে। তার বিপরীতে বেড়েছে কৃষি খাতের অবদান। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ প্রকাশিত প্রান্তিক জিডিপির পরিসংখ্যান থেকে এ তথ্য পাওয়া গেছে।

বিবিএস প্রান্তিক ভিত্তিতে জিডিপি প্রবৃদ্ধির যে হিসাব করে, তাতে উল্লেখিত তিনটি খাতকে বিবেচনায় নেওয়া হয়। এ তিন খাতের মধ্যে বড় দুই খাতের প্রবৃদ্ধি উল্লেখযোগ্য পরিমাণে কমে যাওয়ায় সার্বিক প্রবৃদ্ধিও কমে গেছে। চলতি অর্থবছরের দ্বিতীয় প্রান্তিকে সার্বিক জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার কমে দাঁড়িয়েছে ৩ দশমিক ৭৮ শতাংশে। তার আগের অর্থবছরের একই প্রান্তিকে প্রবৃদ্ধির এ হার ছিল ৭ শতাংশের ওপরে। আর ২০২১-২২ অর্থবছরের দ্বিতীয় প্রান্তিকে জিডিপি প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ৯ দশমিক ৩০ শতাংশ হারে।

শুধু গত দুই অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় নয়, চলতি অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকের তুলনায়ও দ্বিতীয় প্রান্তিকে এসে প্রবৃদ্ধিতে বড় ধাক্কা লেগেছে। চলতি অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ছিল ৬ শতাংশের ওপরে। দ্বিতীয় প্রান্তিকে তা কমে পৌনে ৪ শতাংশের কাছাকাছি নেমে গেছে।

বিবিএসের তথ্য অনুযায়ী, চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের দ্বিতীয় প্রান্তিক তথা অক্টোবর-ডিসেম্বর—এ তিন মাসে শিল্প খাতে জিডিপি প্রবৃদ্ধি ছিল ৩ দশমিক ২৪ শতাংশ। তার আগের অর্থাৎ ২০২২-২৩ অর্থবছরের একই প্রান্তিকে এ প্রবৃদ্ধি ছিল ১০ শতাংশ। আর ২০২১-২২ অর্থবছরের একই প্রান্তিকে শিল্প খাতে প্রবৃদ্ধি ছিল সাড়ে ১৪ শতাংশ। সেই হিসাবে গত তিন অর্থবছরের মধ্যে চলতি অর্থবছরের দ্বিতীয় প্রান্তিকে সবচেয়ে কম প্রবৃদ্ধি হয়েছে শিল্প খাতে।

বিবিএসের হিসাবে, চলতি অর্থবছরের দ্বিতীয় প্রান্তিকে কৃষি খাতে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৪ দশমিক ৬৫ শতাংশ হারে। আগের অর্থবছরের একই প্রান্তিকে কৃষি খাতের প্রবৃদ্ধি ছিল ৪ দশমিক ২২ শতাংশ। আর ২০২১-২২ অর্থবছরের অক্টোবর-ডিসেম্বর প্রান্তিকে কৃষি খাতের প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ২ দশমিক ২০ শতাংশ। সেই হিসাবে তিন অর্থবছরের মধ্যে চলতি অর্থবছরের দ্বিতীয় প্রান্তিকে কৃষি খাতে সর্বোচ্চ প্রবৃদ্ধি হয়েছে।

কৃষি খাতে ভালো প্রবৃদ্ধি হলেও শিল্পের মতো সেবা খাতের প্রবৃদ্ধিও উল্লেখযোগ্য পরিমাণ কমে গেছে চলতি অর্থবছরের অক্টোবর-ডিসেম্বর প্রান্তিকে। এ তিন মাসে সেবা খাতে প্রবৃদ্ধির হার ছিল ৩ দশমিক শূন্য ৬ শতাংশ, যা আগের অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় অর্ধেকেরও কম। ২০২২-২৩ অর্থবছরের দ্বিতীয় প্রান্তিকে সেবা খাতে প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ৬ দশমিক ৬২ শতাংশ হারে। তার আগের অর্থবছর, অর্থাৎ ২০২১-২২ অর্থবছরের অক্টোবর-ডিসেম্বর সময়ে সেবা খাতের প্রবৃদ্ধি ছিল ৭ দশমিক ২৫ শতাংশ।

শিল্প ও সেবায় প্রবৃদ্ধি কমার যত কারণ
শিল্প ও সেবা খাতে প্রবৃদ্ধি কমে যাওয়ার জন্য উচ্চ মূল্যস্ফীতিসহ অর্থনীতির চলমান বিভিন্ন সংকটকে দায়ী করছেন অর্থনীতিবিদেরা। তাঁরা বলছেন, উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে শিল্পের উৎপাদন ব্যাহত হওয়ার পাশাপাশি চাহিদাও কমেছে। একইভাবে সেবা খাতে উচ্চ মূল্যস্ফীতির জন্য ভোক্তা চাহিদা কমে গেছে। এ সময়ে ঋণের সুদ হার বেড়ে যাওয়ায় বিনিয়োগে স্থবিরতা নেমে এসেছে। শিল্প খাতের প্রবৃদ্ধির ক্ষেত্রে দেশীয় অভ্যন্তরীণ চাহিদার পাশাপাশি রপ্তানি বাণিজ্যেরও বড় ভূমিকা রয়েছে। গত বছরের অক্টোবর-ডিসেম্বর সময়ে রপ্তানির ক্ষেত্রেও প্রবৃদ্ধি কম ছিল, যার প্রভাব শিল্প খাতের সামগ্রিক প্রবৃদ্ধিতে পড়েছে।

এ বিষয়ে বেসরকারি গবেষণাপ্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম প্রথম আলোকে বলেন, কাঁচামালসংকট, ডলার–সংকট ও উচ্চমূল্য এবং চাহিদা কমে যাওয়ায় শিল্প উৎপাদন মারাত্মকভাবে ব্যাহত হয়েছে। এ কারণে শিল্পের প্রবৃদ্ধি উল্লেখযোগ্য পরিমাণে কমেছে। সেবা খাতের প্রবৃদ্ধি কমে যাওয়ার পেছনে বড় কারণ উচ্চ মূল্যস্ফীতি। এ সময়ে চিকিৎসা থেকে শুরু করে পরিবহন, আবাসন, বিনোদনসহ সেবা খাতের সব ধরনের খরচ বেড়ে গেছে। যার ফলে বিপুলসংখ্যক জনগোষ্ঠী এসব সেবা ক্রয় কমিয়ে দিয়েছে। যার প্রভাবে সেবা খাতের প্রবৃদ্ধি কমেছে।

কৃষি খাত ভালো করেছে
অর্থনীতিবিদেরা বলছেন, প্রায় দুই বছর ধরে অর্থনীতির বিভিন্ন খাত যে সংকট মোকাবিলা করছে, সে তুলনায় কৃষি খাতে সংকট কম ছিল। পেঁয়াজ থেকে শুরু করে কৃষিপণ্যের আমদানি কমে যাওয়ায় অভ্যন্তরীণ উৎপাদন বেড়েছে। একই সঙ্গে সবজি থেকে শুরু করে দেশে উৎপাদিত সব ধরনের কৃষিপণ্যের দামও লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়েছে। এতে কৃষকসহ কৃষি খাতের সঙ্গে জড়িত সব পক্ষই কমবেশি লাভবান হয়েছে। যার ফলে এ খাতের প্রবৃদ্ধি বেড়েছে। আবার কৃষি খাতের উৎপাদন যাতে ব্যাহত না হয়, সে জন্য সরকারের নেওয়া নানা পদক্ষেপও এ খাত–সংশ্লিষ্টদের উৎপাদন বৃদ্ধিতে সহায়তা করেছে।

এ বিষয়ে গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, অর্থনীতির সংকটের মধ্যেও কৃষি খাতে সার, বীজ, পানিসহ প্রয়োজনীয় উপকরণ সরবরাহ ঠিক রাখতে সক্ষম হয়েছে সরকার। শিল্প ও সেবা খাত সংকটের যতটা প্রভাব ছিল, তার তুলনায় কৃষি উৎপাদনে কম ব্যাঘাত ঘটেছে। ফলে এ খাতের উৎপাদন যেমন বেড়েছে, তেমনি পণ্যমূল্য বৃদ্ধি ফলে এ খাতের মূল্য সংযোজন বেশি ছিল। কৃষি খাতের প্রবৃদ্ধি বেড়ে যাওয়া অর্থনীতি ও দেশের জন্য ইতিবাচক দিক। এ খাতের প্রবৃদ্ধি যত বাড়বে, খাদ্যনিরাপত্তা নিয়ে দুশ্চিন্তা তত কমবে।