নগদ সহায়তা হ্রাস, রপ্তানিতে ধাক্কার শঙ্কা ব্যবসায়ীদের

পণ্য রপ্তানিতে সরকার খাতভেদে নগদ সহায়তা ১০% পর্যন্ত কমানোর ঘোষণা দেওয়ায় ব্যবসায়ীরা শঙ্কিত।

চামড়াশিল্প কারখানাফাইল ছবি

সাভারের চামড়াশিল্প নগরী ও এর বাইরে নিজস্ব বর্জ্য পরিশোধনাগার (ইপিটি) রয়েছে এমন কারখানার উৎপাদিত ক্রাস্ট ও ফিনিশড চামড়া রপ্তানিতে এত দিন নগদ সহায়তা বা ভর্তুকি ছিল ১০ শতাংশ। এখন ক্রাস্ট চামড়া রপ্তানির ক্ষেত্রে নগদ সহায়তা তুলে দেওয়া হয়েছে। আর ফিনিশড চামড়ায় প্রণোদনা কমিয়ে ৭ শতাংশ করা হয়েছে।

গত ২০২২-২৩ অর্থবছরে দেশের দ্বিতীয় শীর্ষ রপ্তানি খাত ছিল চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য। এই খাত থেকে রপ্তানি হয়েছিল ১২২ কোটি ডলারের পণ্য, যা এর আগের বছরের তুলনায় পৌনে ২ শতাংশ কম। চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথমার্ধে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্যের রপ্তানি নেতিবাচক ধারা থেকে বেরোতে পারেনি। রপ্তানি কমেছে ১৮ শতাংশ।

রপ্তানিতে প্রতিযোগিতা বাড়াতে প্রণোদনা কোনো দীর্ঘমেয়াদি উপকরণ হতে পারে না। এলডিসি থেকে উত্তরণের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় প্রণোদনা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে।
খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম, গবেষণা পরিচালক, সিপিডি

বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএ) সাধারণ সম্পাদক সাখাওয়াত উল্লাহ গতকাল বুধবার প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা যে চামড়া রপ্তানি করি, তার ৯৫ শতাংশই ক্রাস্ট, বাকিটা ফিনিশড। প্রণোদনাকে ভিত্তি করে ক্রাস্ট চামড়া রপ্তানি করছিলাম। এখন তা ক্ষতিগ্রস্ত হবে। আগামী কোরবানির পশুর চামড়ার দামে এর প্রভাব পড়বে।’

চামড়ার মতো অন্যান্য খাতের উদ্যোক্তারাও বলছেন, হঠাৎ করে নগদ সহায়তা হ্রাস করায় বেশ কিছু পণ্যের রপ্তানি প্রতিযোগিতার সক্ষমতা কমবে। স্বল্পোন্নত দেশের (এলডিসি) তালিকা থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের প্রস্তুতি হিসেবে পণ্য রপ্তানিতে নগদ প্রণোদনা থেকে বেরিয়ে আসার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। প্রথম ধাপে খাতভেদে নগদ সহায়তা ১০ শতাংশ পর্যন্ত কমানো হয়েছে। আবার কয়েকটি পণ্যে প্রণোদনা বাদ দেওয়া হয়েছে। এই সিদ্ধান্ত গত ১ জানুয়ারি থেকে কার্যকর। গত মঙ্গলবার এ–সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপন জারি করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক।

নগদ সহায়তা কাটছাঁটে সবচেয়ে বেশি টানাপোড়েনে পড়তে যাচ্ছে তৈরি পোশাক ও বস্ত্র খাত। প্রণোদনা কমানোর সিদ্ধান্ত তৈরি পোশাকশিল্পে অনাকাঙ্ক্ষিত ঝুঁকি ও বিপর্যয় ডেকে আনবে বলে মনে করেন পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর ভারপ্রাপ্ত সভাপতি এস এম মান্নান।

‘আসবাবের কাঁচামাল আমদানিতে উচ্চ শুল্ক রয়েছে। সে জন্য প্রণোদনাটি ডিউটি ড্র ব্যাক হিসেবে কাজ করত; সেটি কমবে। তাতে চ্যালেঞ্জ বাড়বে।’
সেলিম এইচ রহমান, বাংলাদেশ আসবাব শিল্প মালিক সমিতির চেয়ারম্যান

এদিকে পণ্য রপ্তানিতে নতুন সম্ভাবনা হিসেবে দেখা দিয়েছে কৃষিপণ্য। গত অর্থবছরে এই খাত থেকে ১১৬ কোটি ডলারের রপ্তানি আয় আসে। যদিও রপ্তানি কমেছিল ২৭ শতাংশ। চলতি অর্থবছরে আবার ইতিবাচক ধারায় ফিরেছে খাতটির রপ্তানি। কৃষিপণ্যে প্রণোদনা ২০ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১৫ শতাংশে নামিয়ে আনা হয়েছে।

গত অর্থবছরে রপ্তানি হওয়া কৃষিপণ্যের মধ্যে সবজি ও ফলমূল ছিল ৬ কোটি ডলারের। সবজি রপ্তানিকারকদের সংগঠন বাংলাদেশ ফ্রুটস, ভেজিটেবল অ্যান্ড অ্যালায়েড প্রডাক্টস এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিএফভিএপিইএ) সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ মনসুর বলেন, ‘এমনিতেই আমরা রপ্তানিকারকেরা ডলারের দাম কম পাচ্ছি। এর মধ্যে প্রণোদনা কমানো হলো। এখন রপ্তানি আরও কমবে।’

দেশের শীর্ষ পাঁচ রপ্তানি খাতের মধ্যে রয়েছে পাট ও পাটজাত পণ্য। তবে কয়েক বছর ধরেই খাতটির রপ্তানি কমছে। নতুন সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, বৈচিত্র্যময় পাটপণ্য রপ্তানিতে নগদ সহায়তা কমে ১৫, পাটজাত পণ্যে ৭ এবং পাট সুতায় প্রণোদনা ৭ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৫ শতাংশ করা হয়েছে।

বাংলাদেশ পাটকল সমিতির (বিজেএমএ) চেয়ারম্যান আবুল হোসেন বলেন, পাট খাতকে উৎসাহ দেওয়ার কথা বলে প্রণোদনা কমিয়ে নিরুৎসাহিত করা হয়েছে।

হিমায়িত চিংড়ি রপ্তানিও কমছে। গত অর্থবছরে ৩০ কোটি ডলারের হিমায়িত চিংড়ি রপ্তানি হয়েছে, যা এর আগের বছরের চেয়ে ২৬ শতাংশ কম। এই পণ্য রপ্তানিতে প্রণোদনা ১ শতাংশের মতো কমানো হয়েছে। বাংলাদেশ হিমায়িত খাদ্য রপ্তানিকারক সমিতির সভাপতি কাজী বেলায়েত হোসেন বলেন, ‘আমরা দেশে উচ্চ ফলনশীল জাতের ভেনামি চিংড়ি চাষ শুরু করেছি। আগামী দুই বছরের মধ্যে সেই চাষ সফল হলে হিমায়িত চিংড়ি রপ্তানি ঘুরে দাঁড়াবে। তত দিন পর্যন্ত প্রণোদনা দরকার। না হলে রপ্তানি বাজার হারাব আমরা।’

এদিকে আসবাব রপ্তানিতে মাঝে সম্ভাবনা দেখালেও সেটিও কমছে। গত অর্থবছরে ৯ কোটি ডলারের আসবাব রপ্তানি হয়েছে। তখন রপ্তানি কমেছিল ১৮ শতাংশ। চলতি অর্থবছরের প্রথমার্ধে পণ্যটির রপ্তানি কমার হার একই আছে। আসবাব রপ্তানিতে এখন প্রণোদনা ২০ শতাংশ থেকে কমে ১৫ শতাংশ হবে।

বাংলাদেশ আসবাব শিল্প মালিক সমিতির চেয়ারম্যান সেলিম এইচ রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘আসবাবের কাঁচামাল আমদানিতে উচ্চ শুল্ক রয়েছে। সে জন্য প্রণোদনাটি ডিউটি ড্র ব্যাক হিসেবে কাজ করত; সেটি কমবে। তাতে চ্যালেঞ্জ বাড়বে।’

জানতে চাইলে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সিপিডির গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, রপ্তানিতে প্রতিযোগিতা বাড়াতে প্রণোদনা কোনো দীর্ঘমেয়াদি উপকরণ হতে পারে না। এলডিসি থেকে উত্তরণের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় প্রণোদনা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। এটা সবাইকে মেনে নিতে হবে। তিনি বলেন, প্রণোদনা না দিলে তৈরি পোশাকের মতো বড় খাতের প্রতিযোগিতা সক্ষমতায় কোনো প্রভাব ফেলবে না। উদীয়মান খাতে কিছু সমস্যা হতে পারে। সে ক্ষেত্রে প্রণোদনার বাইরে আলাদা উদ্যোগ নিয়ে সমাধান করতে হবে।