প্রথম আলো–ডেইলি স্টারে হামলার নিন্দা ব্যবসায়ীদের

সম্পাদক পরিষদ ও সংবাদ মালিকদের সংগঠন নিউজপেপার ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন বাংলাদেশের (নোয়াব) যৌথ প্রতিবাদ সভায় বক্তব্য দিচ্ছেন জিপিএইচ ইস্পাতের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আলমগীর কবীর। উপস্থিত ছিলেন দেশের বিশিষ্ট ব্যবসায়ীরা।প্রথম আলো

প্রথম আলো ও ডেইলি স্টার কার্যালয়ে উগ্রপন্থী ও সন্ত্রাসীদের হামলা-আগুন, লুটপাট এবং সম্পাদক পরিষদের সভাপতি নিউ এজ সম্পাদক নূরুল কবীরকে হেনস্তার ঘটনায় নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়েছেন দেশের শীর্ষ ব্যবসায়ী নেতারা। তাঁরা বলেছেন, সরকার দেশের ব্যবসা–বাণিজ্য ক্ষতি করতে না চাইলে, সংবাদমাধ্যমের ব্যত্যয় ঘটিয়ে দেশকে অস্থিতিশীল করতে না চাইলে, তা প্রমাণ করতে হবে। মানুষের জানমালের নিরাপত্তা দিতে হবে।

‘মব ভায়োলেন্সে আক্রান্ত বাংলাদেশ’ শীর্ষক এক যৌথ প্রতিবাদ সভায় ব্যবসায়ী এ কথাগুলো বলেন। প্রথম আলো ও ডেইলি স্টার কার্যালয়ে হামলা ও আগুন দেওয়া এবং সম্পাদক পরিষদের সভাপতি নিউ এজ সম্পাদক নূরুল কবীরকে হেনস্তা করার প্রতিবাদে সংবাদপত্রের সম্পাদকদের সংগঠন সম্পাদক পরিষদ ও মালিকদের সংগঠন নিউজপেপার ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন বাংলাদেশ (নোয়াব) এ প্রতিবাদ সভার আয়োজন করে। গতকাল সোমবার রাজধানীর সোনারগাঁও হোটেলে এ সভা হয়। প্রতিবাদ সভা শেষে সোনারগাঁও হোটেলের পাশের রাস্তায় দাঁড়িয়ে মানববন্ধন অনুষ্ঠিত হয়।

প্রতিবাদ সভা ও মানববন্ধনে সংহতি জানাতে আসেন বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, পেশাজীবী সংগঠন, ব্যবসায়ী সংগঠন ও সাংবাদিক সংগঠনের নেতারা এবং নাগরিক সমাজের প্রতিনিধি, আইনজীবী, মানবাধিকারকর্মী, সাংস্কৃতিক কর্মীসহ নানা শ্রেণি-পেশার মানুষ। বক্তাদের অনেকেই ছায়ানট ভবন ও উদীচী কার্যালয়ে হামলারও প্রতিবাদ জানান।

প্রতিবাদ সভার এক পর্যায়ে শিল্পোদ্যোক্তা ও ব্যবসায়ী নেতাদের সংহতি প্রকাশের জন্য মঞ্চে ডাকেন সভার সঞ্চালক ও সম্পাদক পরিষদের সাধারণ সম্পাদক দেওয়ান হানিফ মাহমুদ। এ সময় একে একে মঞ্চে ওঠেন ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি মীর নাসির হোসেন, বাংলাদেশ চেম্বার অব ইন্ডাস্ট্রিজের (বিসিআই) সভাপতি আনোয়ার উল আলম চৌধুরী পারভেজ, নিট পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএর সাবেক সভাপতি ফজলুল হক, প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের চেয়ারম্যান আহসান খান চৌধুরী, বাংলাদেশ সিমেন্ট ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক সভাপতি ও জিপিএইচ ইস্পাতের চেয়ারম্যান আলমগীর কবির, মেট্রোপলিটন চেম্বারের সভাপতি কামরান টি রহমান, সাবেক সভাপতি সৈয়দ নাসিম মঞ্জুর ও ঢাকা চেম্বারের সভাপতি তাসকীন আহমেদ। পরে মঞ্চে থাকা এসব ব্যবসায়ীর পক্ষ থেকে সংহতি জানিয়ে বক্তব্য দেন আলমগীর কবির, আনোয়ার উল আলম চৌধুরী ও কামরান টি রহমান।

বাংলাদেশ সিমেন্ট ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিসিএমএ) সাবেক সভাপতি আলমগীর কবীর বলেন, ‘আমরা একাত্মতা প্রকাশ করছি আজকের এই প্রতিবাদ সভায়। সরকারের কাছে প্রশ্ন হলো, আপনারা কি আমাদের দেশের অর্থনীতি ধ্বংস করতে চান? ব্যবসা–বাণিজ্যের ক্ষতি করতে চাচ্ছেন? অথবা সংবাদমাধ্যমের ব্যত্যয় ঘটিয়ে দেশকে অস্থিতিশীল করতে চাচ্ছেন? আপনারা যদি এগুলো করতে না চান, তাহলে আপনাদের তা প্রমাণ করতে হবে।’

মেট্রো চেম্বারের (এমসিসিআই) সভাপতি কামরান টি রহমান বলেন, ‘যে ঘটনাগুলো ঘটেছে, তার নিন্দা জানাতে ও সংহতি প্রকাশ করার জন্য আজকে আমরা এখানে এসেছি।’  

প্রতিবাদ সমাবেশে ইন্টারন্যাশনাল চেম্বার অব কমার্স (আইসিসি) বাংলাদেশের সভাপতি মাহবুবুর রহমান
ছবি: প্রথম আলো

একই সভায় ইন্টারন্যাশনাল চেম্বার অব কমার্স (আইসিসি) বাংলাদেশের সভাপতি মাহবুবুর রহমান বলেন, পরমতসহিষ্ণুতা গড়ে না উঠলে বাংলাদেশে গণতন্ত্র বিকশিত হতে পারবে না। বরং সামনের দিনগুলো আরও কঠিন হতে পারে। সব সরকারের সময়ই দেশে গণতন্ত্রের ওপর আঘাত আসে মন্তব্য করে তিনি বলেন, ‘মতের পার্থক্য যদি আমরা টলারেট (সহ্য) করতে না পারি, তাহলে কিন্তু সামনের দিনে আমাদের আরও ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।’

মাহবুবুর রহমান বলেন, প্রথম আলো ও ডেইলি স্টার কারও মুখপাত্র নয়। কোনো দল বা মতের পক্ষে নয়, তারা স্বাধীন সাংবাদিকতা করার চেষ্টা করেছে এবং করছে।
বিদ্যমান আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে বাংলাদেশ চেম্বার অব ইন্ডাস্ট্রিজের (বিসিআই) সভাপতি আনোয়ার উল আলম চৌধুরী পারভেজ বলেন, ‘আমরা সরকারের কাছে কিন্তু এখন একটা জিনিসই চাই, আমাদের জানমালের নিরাপত্তা দেন। অবিলম্বে শান্তিপূর্ণ নির্বাচন ও তার মাধ্যমে পরবর্তী নির্বাচিত সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর—এটাই আমাদের দাবি।’

সভায় সংহতি জানিয়ে বক্তব্য দেন সিটি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ও ব্যাংকের শীর্ষ নির্বাহীদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) চেয়ারম্যান মাসরুর আরেফিন। তিনি বলেন, ‘আমি বুঝতে পারি না, ছায়ানট কবে কী রাজনীতি করল? ঠিক তেমনি বুঝতে পারি না, নূরুল কবীর ভাই কবে ফ্যাসিস্টের সহযোগী হলেন, আমি কিন্তু জানি না। আমি ঠিক তেমনভাবে জানি না যে আমার প্রিয় মতি ভাই (প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমান) কবে–কখন–কার দালালি করলেন, মাহফুজ ভাই (ডেইলি স্টার সম্পাদক) নিজে কখন শেখ হাসিনার সহযোগী হলেন, এগুলো বড় প্রশ্ন।’

প্রতিবাদ সভায় সংহতি জানাতে আরও এসেছিলেন ব্যবসায়ী নেতা মেট্টো চেম্বারের সাবেক সভাপতি কুতুবউদ্দিন আহমেদ ও নিহাদ কবীর, স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড বাংলাদেশের (এসসিবি) প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) নাসের এজাজ বিজয়, ঢাকা চেম্বারের সাবেক সভাপতি রিজওয়ান রাহমান, বিসিআইয়ের জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি প্রীতি চক্রবর্তী প্রমুখ।

প্রথম আলো ও ডেইলি স্টারে হামলার প্রতিবাদে সমাবেশের পর মানববন্ধন
ছবি: প্রথম আলো

সংহতি জানাতে আসা সবাইকে ধন্যবাদ জানিয়ে নোয়াব সভাপতি ও ব্যবসায়ী নেতা এ কে আজাদ বলেন, প্রতিবাদ সভায় সবাই একটা কথাই সাধারণভাবে বলেছেন, সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে প্রতিরোধ করতে হবে। তিনি বলেন, ‘আমাদের কণ্ঠকে স্তব্ধ করা যাবে না। প্রথম আলো, ডেইলি স্টার, ছায়ানট ও উদীচীতে যারা আগুন দিয়েছে, তাদের বিচার না হওয়া পর্যন্ত এবং সাংবাদিকেরা মতপ্রকাশের স্বাধীনতা না পাওয়া পর্যন্ত সংগ্রাম অব্যাহত থাকবে।’

গত বৃহস্পতিবার রাতে উগ্রপন্থী সন্ত্রাসীদের উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ও সংগঠিত হামলার শিকার হয় দেশের শীর্ষ সংবাদমাধ্যম প্রথম আলো। হামলাকারীরা ভাঙচুর ও লুটপাটের পর কার্যালয়ে আগুন দেয়। একই রাতে ডেইলি স্টার কার্যালয়েও ভাঙচুর ও লুটপাটের পর আগুন দেওয়া হয়। সে সময় সাংবাদিকদের রক্ষায় ডেইলি স্টার কার্যালয়ে গেলে সম্পাদক পরিষদের সভাপতি নূরুল কবীরকে হেনস্তা করা হয়। এ ঘটনাকে ‘গণমাধ্যমের জন্য কালো দিন’ আখ্যায়িত করে প্রতিবাদ ও নিন্দা জানাচ্ছেন অনেকেই। দুই সংবাদপত্র কার্যালয়ের পাশাপাশি বৃহস্পতিবার ছায়ানট ও শুক্রবার উদীচীর কার্যালয়ে হামলার ঘটনা ঘটে।