জমি বরাদ্দ নিয়ে সরকারি দপ্তরের বিরোধ ঠেকাতে হচ্ছে আলাদা কর্তৃপক্ষ

কক্সবাজারের মাতারবাড়ী তাপবিদ্যুৎ প্রকল্পের অবকাঠামোগত উন্নয়নকাজ চলছে দ্রুতগতিতে
ফাইল ছবি: প্রথম আলো

কক্সবাজারের মহেশখালী উপজেলায় জমি বরাদ্দ নিয়ে সরকারের এক দপ্তরের সঙ্গে আরেক দপ্তরের বিরোধ ঠেকাতে আলাদা একটি কর্তৃপক্ষ করতে যাচ্ছে সরকার। এর নাম দেওয়া হয়েছে মহেশখালী-মাতারবাড়ি শিল্প ও বাণিজ্যিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষ।

নতুন এই কর্তৃপক্ষ মহেশখালী এলাকায় শিল্প ও বাণিজ্যিক স্থাপনার অনুমোদন, জমি বরাদ্দ, পরিষেবা, লাইসেন্সসহ সব ধরনের সুবিধা নিশ্চিত করবে। কর্তৃপক্ষ গঠনের জন্য খসড়া আইনটি চূড়ান্ত পর্যায়ে আছে। অনুমোদনের জন্য এটি শিগগিরই মন্ত্রিসভার বৈঠকে উত্থাপনের কথা রয়েছে।

খসড়া আইনে বলা হয়েছে, কর্তৃপক্ষের প্রধান কার্যালয় থাকবে মহেশখালীতে। তবে প্রয়োজনে সরকার চাইলে যেকোনো স্থানে এর লিয়াজোঁ অফিস স্থাপন করতে পারবে। কর্তৃপক্ষ পরিচালনার জন্য এর প্রধান থাকবেন একজন চেয়ারম্যান। নির্বাহী সদস্য থাকবেন চারজন। একজন সচিবও থাকবেন, যিনি সরকারের যুগ্ম সচিব পদমর্যাদার হবেন।

মহেশখালী ও মাতারবাড়িতে এখন ৩৭টি উন্নয়ন প্রকল্পের কাজ চলছে। কর্মকর্তারা বলছেন, সরকারের বিভিন্ন দপ্তর আলাদা আলাদা করে এসব প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। এর ফলে কাজের সমন্বয় হচ্ছে না। কাজে ব্যাঘাত ঘটছে। এ জন্যই নতুন কর্তৃপক্ষ করার চিন্তা।

তবে মহেশখালী শিল্প ও বাণিজ্যিক অঞ্চলের জন্য আলাদা কর্তৃপক্ষ গঠনের পক্ষে নন বিশেষজ্ঞেরা। তাঁরা বলছেন, নতুন আরেকটি কর্তৃপক্ষ হলে আমলাতান্ত্রিক জটিলতা আরও বাড়বে। কর্তৃপক্ষ হলে বেশ কিছু কর্মকর্তা ভালো পদ পাবেন। সেখানে বহুতল ভবন হবে, কর্মকর্তাদের গাড়ি দেওয়া হবে। আবাসনের ব্যবস্থা করা হবে। কিন্তু কর্মকর্তাদের সেখানে নিয়োগ দিলেও তাঁরা ঢাকাকেন্দ্রিক থাকার চেষ্টা করবেন। তা ছাড়া গত এক দশকে যত কর্তৃপক্ষ হয়েছে, সেগুলোতে এখনো কাঙ্ক্ষিত গতি আসেনি। এর ফলে নতুন কর্তৃপক্ষ দিয়ে কাজের কাজ কিছু হবে না।

এ প্রসঙ্গে সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদার প্রথম আলোকে বলেন, অতীত অভিজ্ঞতা বলছে, ঢাকার বাইরে যত সরকারি সংস্থা আছে, সেখানে কর্মরত কর্মকর্তারা ঢাকার বাইরে থাকতে চান না। তাঁদের বেশির ভাগ সময় কাটে ঢাকায়। নতুন কর্তৃপক্ষ ঢাকার বাইরে হলেও সেখানে যাঁদের নিয়োগ দেওয়া হবে, তাঁরাও ঢাকামুখী হবেন। এর ফলে যে লক্ষ্য নিয়ে কর্তৃপক্ষ গঠিত হচ্ছে, তার কার্যকর ভূমিকা রাখা নিয়ে সংশয় আছে।

আলী ইমাম মজুমদার বলেন, মহেশখালীতে এখন যেসব প্রকল্প চলছে, সেগুলো সরকার বিদ্যমান কাঠামো দিয়েই পরিচালনা করতে পারে। নতুন করে কর্তৃপক্ষ গঠনের প্রয়োজন পড়ে না।

মহেশখালী ও মাতারবাড়ি এলাকাকে অর্থনীতিতে উদীয়মান এক শক্তি হিসেবে বিবেচনা করছে সরকার। এরই মধ্যে এখানে গভীর সমুদ্রবন্দর, বিদ্যুৎকেন্দ্র, এলএনজি টার্মিনাল, অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠার কাজ চলছে। মহেশখালীর চারদিকে নতুন চর জেগে উঠছে। সেখানে জমির বরাদ্দ নিতে কাড়াকাড়ি চলছে সরকারি দপ্তরগুলোর মধ্যে। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, এ এলাকায় সরকারি সংস্থাগুলোর কাজে সমন্বয় আনার পাশাপাশি সব ধরনের সেবা একটি জায়গা থেকে দিতে কর্তৃপক্ষ গঠনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে পাওয়া তথ্য বলছে, কক্সবাজারের মহেশখালী ও মাতারবাড়ি এলাকায় এখন ৩৭টি উন্নয়ন প্রকল্পের কাজ চলছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্রবন্দর, ১২ শ মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্র, ২টি অর্থনৈতিক অঞ্চল, গ্যাসলাইন, ভাসমান এলএনজি টার্মিনাল, সোনাদিয়া ইকো ট্যুরিজম পার্ক। কর্মকর্তারা বলছেন, সরকারের বিভিন্ন দপ্তর আলাদা আলাদা করে এসব প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। এর ফলে কাজে সমন্বয় হচ্ছে না, ব্যাঘাত ঘটছে। এ জন্যই নতুন কর্তৃপক্ষ করার চিন্তা।

তবে খসড়া আইনের বেশ কিছু ধারা নিয়ে এরই মধ্যে প্রশ্ন উঠেছে। যেমন ৪৩ নম্বর ধারায় বলা হয়েছে, কর্তৃপক্ষের একটি তহবিল থাকবে। যেখানে কর রেট, টোল ফি ও সার্ভিস চার্জ থেকে পাওয়া টাকা যোগ হবে।

বর্তমানে স্থানীয় প্রশাসন এ এলাকায় কর আদায় করছে। পাশাপাশি বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষ (বেজা) তাদের বিনিয়োগকারীদের কাছ থেকে কর আদায় করবে। আবার নতুন কর্তৃপক্ষ কর আদায় করবে। এতে একজন বিনিয়োগকারীকে বেশ কয়েক জায়গায় কর, সার্ভিস চার্জ ও টোল ফি দিতে হবে। দ্বৈত কর দিতে হলে ব্যবসায়ীদের মধ্যে অসন্তোষ তৈরি হবে।

জানতে চাইলে বেজার নির্বাহী চেয়ারম্যান শেখ ইউসুফ হারুন প্রথম আলোকে বলেন, ‘বিনিয়োগকারীদের যাতে দ্বৈত কর দিতে না হয়, আমরা সে বিষয়টি তুলে ধরেছি। এই ধারা বাদ দেওয়ার অনুরোধ করেছি।’ তিনি বলেন, মহেশখালীতে সরকারের অনেকগুলো দপ্তর কাজ করে। এক দপ্তরের সঙ্গে আরেক দপ্তরের সমন্বয় নেই। সবার কাজে সমন্বয় আনতে আলাদা কর্তৃপক্ষ হচ্ছে।

তবে গত এক যুগে দেশে যেসব কর্তৃপক্ষ গঠিত হয়েছে, সেগুলোর অভিজ্ঞতা সুখকর নয়। যেমন সরকারি-বেসরকারি অংশীদারত্ব বা পিপিপি কর্তৃপক্ষ গঠিত হয়েছিল এক যুগ আগে। এ দীর্ঘ যাত্রায় মাত্র একটি প্রকল্প শেষ করতে পেরেছে তারা। তা ছাড়া ২০১৫ সালে পিপিপি আইন হয়েছিল। আইন পাস হওয়ার পর সাত বছর পেরিয়ে গেলেও এখন পর্যন্ত বিধিমালা চূড়ান্ত করতে পারেনি তারা। সাধারণত আইন থাকে সংক্ষিপ্ত আকারে। একটি প্রতিষ্ঠান কীভাবে পরিচালিত হবে, তা বিধিমালায় বিস্তারিত বলা থাকে। এর ফলে পিপিপি প্রকল্পে গতি আসেনি। একই চিত্র বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা) ও দক্ষতা উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (এনএসডিএ)। এ দুটি প্রতিষ্ঠানেও কাঙ্ক্ষিত গতি আসেনি।

মহেশখালী-মাতারবাড়ি শিল্প ও বাণিজ্যিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষের কাজ কী হবে, সে বিষয়ে খসড়া আইনে বলা হয়েছে। সংস্থাটি মহেশখালী–মাতারবাড়ি এলাকার জন্য একটি মহাপরিকল্পনা গ্রহণ করবে। সেখানে শিল্প ও বাণিজ্যের ধরন অনুযায়ী এলাকা ভাগ করবে। ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা, পানি সরবরাহ, পয়োনিষ্কাশনব্যবস্থা তারা করবে। দেশি–বিদেশি বিনিয়োগকারীদের জমি বা ভবন বরাদ্দ দিতে পারবে। মহাপরিকল্পনা অনুযায়ী, শিল্প ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানকে তাদের চাহিদামাফিক জমি বরাদ্দ দেবে। বিনিয়োগকারীদের লাইসেন্স, ছাড়পত্র, প্রণোদনাসহ ওয়ান–স্টপ সার্ভিস দেবে।

সরকারের একাধিক নীতিনির্ধারক প্রথম আলোকে জানান, মহেশখালী–মাতারবাড়ি এলাকার জন্য নতুন কর্তৃপক্ষ গঠিত হলে স্থানীয় প্রশাসনের সঙ্গে কাজে জটিলতা তৈরি হবে। তা ছাড়া কর্তৃপক্ষের জন্য অফিস স্থাপন, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের আবাসন, তাঁদের কার্যপরিধি ঠিক করতে অনেক সময় চলে যাবে। কর্তৃপক্ষ গঠনের পর সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলো এটিকে কতটা সহযোগিতা করবে, তা নিয়েও সংশয় আছে। বিডার নির্বাহী চেয়ারম্যান বিভিন্ন সময়ে অভিযোগ তুলেছেন, সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলো তাঁদের সহযোগিতা করছে না।