রুশ ব্যাংকে সে দেশের মুদ্রা রুবলে হিসাব খুলে বাণিজ্য ও আর্থিক লেনদেন কীভাবে করা যায়, তা নিয়ে বাংলাদেশ ও রাশিয়ার কর্মকর্তাদের মধ্যে আলোচনা হবে। এ ছাড়া, দুই দেশের মধ্যে সহজ ব্যাংকিং লেনদেন চালু করার বিষয়েও তাঁরা আলোচনা করবেন।
এর বাইরে বিকল্প ও নিরাপদ লেনদেনের পদ্ধতি খুঁজে বের করাসহ ১০টি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে রাশিয়ার সঙ্গে আজ সোমবার তিন দিনব্যাপী দ্বিপক্ষীয় আলোচনা শুরু করছে বাংলাদেশ।
বাণিজ্য, অর্থনৈতিক, বৈজ্ঞানিক ও প্রযুক্তিগত সহযোগিতা–সংক্রান্ত রাশিয়া-বাংলাদেশ আন্তসরকার কমিশনের চতুর্থ অধিবেশনের আওতায় ভার্চ্যুয়াল মাধ্যমে এ আলোচনা শুরু হবে। ঢাকার সময় বেলা ২টা ও মস্কোর সময় বেলা ১১টায় শুরু হওয়া এ অধিবেশনে রাশিয়ার দিক থেকে নেতৃত্ব দেবেন কমিশনের চেয়ারম্যান ও রাশিয়া ফেডারেশনের ফেডারেল এজেন্সি ফর ফিশারিজের প্রধান ইলিয়া ভি শেসতাকভ। আর বাংলাদেশের দিক থেকে নেতৃত্ব দেওয়ার কথা রয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) সচিব শরিফা খানের।
মস্কোর দলে দেশটির পররাষ্ট্র, অর্থনৈতিক উন্নয়ন, শিল্প ও বাণিজ্য, কৃষি, পরিবহন, মৎস্য, বিজ্ঞান, উচ্চশিক্ষা ইত্যাদি মন্ত্রণালয়ের ১৭ জন অংশ নেবেন। আর ঢাকার দলেও থাকবেন বাণিজ্য, পররাষ্ট্র, কৃষি, তথ্যপ্রযুক্তি, বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগ, বাংলাদেশ ব্যাংক এবং বেসরকারি খাতের মিলিয়ে মোট ২০ জন প্রতিনিধি।
সাবেক অর্থসচিব মাহবুব আহমেদ যখন বাণিজ্যসচিব ছিলেন, তখন তাঁর নেতৃত্বাধীন একটি দল ২০১৩ সালের অক্টোবরে রাশিয়া, উজবেকিস্তান, কাজাখস্তান, কিরগিজস্তান ও ইউক্রেন সফর করে। এর ধারাবাহিকতায় অর্থনীতি, বাণিজ্য, বিজ্ঞান ও কারিগরি সহায়তা বিষয়ে ২০১৭ সালের ১ মার্চ গঠন করা হয় বাংলাদেশ-রাশিয়া আন্তসরকার কমিশন।
কমিশনের কার্যক্রম এগিয়ে নিতে পরে বেসরকারি খাতে গঠন করা হয় কমনওয়েলথ অব ইনডিপেনডেন্টস স্টেট (সিআইএস)-বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (বিসিসিআই), সংক্ষেপে যা সিআইএস-বিসিসিআই নামে পরিচিত। সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নভুক্ত ১১টি দেশের জোট সিআইএস। দেশগুলো হচ্ছে রাশিয়া, আজারবাইজান, বেলারুশ, ইউক্রেন, কাজাখস্তান, কিরগিজস্তান, আর্মেনিয়া, মালদোভা, তাজিকিস্তান, উজবেকিস্তান ও তুর্কমেনিস্তান।
আন্তসরকার কমিশনের প্রথম অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয় ২০১৮ সালের অক্টোবরে। প্রথমটিসহ ঢাকা-মস্কো মিলিয়ে তিনটি আলাদা অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়েছে। এবারের অধিবেশন মস্কোতে হওয়ার কথা থাকলেও বাংলাদেশ সরকারের অনুরোধে ডলার সাশ্রয়ের অংশ হিসেবে তা ভার্চ্যুয়ালি হচ্ছে বলে ইআরডি সূত্রে জানা গেছে। কোভিড-১৯–এর কারণে ২০২১ সালে সর্বশেষ অধিবেশনটিও ভার্চ্যুয়ালি মাধ্যমে অনুষ্ঠিত হয়েছিল।
শরিফা খানের আগে বাংলাদেশের তিন সাবেক ইআরডি সচিব কাজী শফিকুল আযম, প্রয়াত মনোয়ার আহমেদ এবং বর্তমান অর্থসচিব ফাতিমা ইয়াসমিন এ অধিবেশনে বাংলাদেশ থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন।
প্রথম ও চতুর্থ অধিবেশনে একই আলোচনা!
সূত্রগুলো জানায়, আজ অনুষ্ঠেয় প্রথম দিনের আলোচনায় মূল বিষয় হিসেবে থাকছে আর্থিক খাত। সেখানে গুরুত্ব পাচ্ছে ব্যাংক। তার পরের গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে জ্বালানি ও ভূতাত্ত্বিক অনুসন্ধান। এ ছাড়া থাকছে পারমাণবিক শক্তি খাতের সহযোগিতা এবং বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক খাতের সহযোগিতা। রাশিয়া-বাংলাদেশ আন্তসরকার কমিশনের পঞ্চম অধিবেশন কবে, কোথায় হবে, সে আলোচনাও হবে আজ।
ইআরডির দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা বলছেন, প্রথম অধিবেশনে যেসব আলোচ্যসূচি ছিল, তাতে তেমন কোনো অগ্রগতি না হওয়ায় ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে সেগুলোই পরের দুই অধিবেশনেও আলোচনা হয়েছে। এমনকি এবারের অধিবেশনেও প্রায় একই আলোচ্যসূচি থাকছে।
ইআরডি সচিব শরিফা খানকে মুঠোফোনে না পেয়ে প্রথম আলোর পক্ষ থেকে গত রাতে খুদে বার্তা পাঠানো হয় তাঁর হোয়াটসঅ্যাপ মাধ্যমে। খুদে বার্তা (সিন করা) দেখলেও তিনি বিস্তারিত কোনো জবাব দেননি। শুধু এটুকু জানান, তিনি মুখ্যসচিবের সঙ্গে একটি বৈঠকে যোগ দিতে যাচ্ছেন।
তবে কমিশন গঠনের পর মস্কোয় অনুষ্ঠিত প্রথম অধিবেশনে নেতৃত্ব দেওয়া সাবেক ইআরডি সচিব কাজী শফিকুল আযম প্রথম আলোকে বলেন, ‘বিষয়গুলো একই জায়গায় আটকে আছে। এ জন্য সমস্যা আছে উভয় দিক থেকেই। আমাদের দিক থেকে যদি বলি, উদ্যোগের ঘাটতি আছে ব্যাপক। আগের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে যথাযথ তদারকিও করা হয় কম। টাকা-রুবলের কারেন্সি সোয়াপের একটা আলোচনা অবশ্য উঠেছিল। দেখা যাক, এবারের অধিবেশন থেকে কী উঠে আসে।’
ডলার বা অন্য কোনো হার্ড কারেন্সিকে (প্রধান আন্তর্জাতিক মুদ্রা) এড়িয়ে দুটি দেশ নিজ নিজ মুদ্রায় লেনদেন করলে তাকে ‘কারেন্সি সোয়াপ’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। ইউক্রেনে হামলা চালানোর পর বেলজিয়াম থেকে পরিচালিত আন্তর্জাতিক লেনদেনব্যবস্থা সুইফটে নিষিদ্ধ করা রাশিয়ার ব্যাংকগুলোকে। রাশিয়া তখন সুইফটের বিকল্প হিসেবে ‘কারেন্সি সোয়াপ’ পদ্ধতিতে লেনদেন নিষ্পত্তির প্রস্তাব দেয় বাংলাদেশকে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক অবশ্য এখনো তা বিবেচনায় নেয়নি।
রাশিয়ায় বাংলাদেশের পণ্য রপ্তানিতে বড় সমস্যা হচ্ছে উচ্চ শুল্ক। শুল্কায়ন জটিলতাও আছে। দেশটির সঙ্গে আধুনিক ব্যাংক যোগাযোগও নেই বাংলাদেশের। বাণিজ্য করতে হয় তৃতীয় দেশের মাধ্যমে এবং মান্ধাতার আমলের টেলিগ্রাফিক লেনদেন (টিটি) পদ্ধতিতে। বাংলাদেশ যে রাশিয়ায় পণ্য রপ্তানি করছে, তা মূলত জার্মানি, পোল্যান্ড ও ইইউভুক্ত অন্য দেশগুলোর মাধ্যমে।
রাশিয়ার ‘স্পুতনিক’ নামক বাণিজ্যিক ব্যাংক এবং বাংলাদেশের সোনালী ব্যাংকের মাধ্যমে লেনদেন হবে—প্রথম অধিবেশনে এটি আলোচ্য বিষয় ছিল। তবে কিছু চূড়ান্ত হয়নি। ওই সময় আলোচনা হয়েছিল, বাণিজ্য ও বিনিয়োগ বিষয়ে আলোচনা ও বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য ‘সিআইএস-বিসিসিআই ফোরাম’ নামে একটি ফোরাম তৈরি হবে। সেটিও আর হয়নি।
সিআইএস-বিসিসিআইয়ের সভাপতি হাবীব উল্লাহ ডন গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘বাংলাদেশি পণ্যের জন্য রাশিয়া একটা বড় বাজার। শুরু থেকেই আমরা দাবি জানিয়ে আসছি দেশটির সঙ্গে ব্যাংকিং লেনদেন চালুর বিষয়টি নিয়ে। কারণ, বড় আকারের লেনদেন টিটির মাধ্যমে সম্ভব নয়। আর এখন তো ডলার–সংকটের সময়। টাকা-রুবলের মাধ্যমে বাণিজ্য করা গেলে উভয় দেশই লাভবান হবে।’
কাল-পরশু কী হবে
অধিবেশনের দ্বিতীয় দিন রেল ও কৃষি যন্ত্রপাতি, সার, রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চল (ইপিজেড), বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল ও হাই-টেক পার্কে রাশিয়ার বিনিয়োগ নিয়ে আলোচনা হবে।
এ ছাড়া যৌথভাবে সার কারখানা, তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) প্রকল্প স্থাপন, জ্বালানি পরিশোধন কারখানা স্থাপন, চামড়া ও চামড়াজাত কারখানা, ওষুধ এবং পর্যটন খাতে বিনিয়োগ হচ্ছে আলোচ্য বিষয়।
কৃষি ও প্রাণিসম্পদ এবং কৃষি খাতের জন্য গবেষণাগার তৈরির সহযোগিতা, সাইবার নিরাপত্তা, উচ্চশিক্ষার গবেষণা ইত্যাদি বিষয় নিয়েও আলোচনা হবে।
শেষ দিন বুধবার প্রটোকল সই হওয়ার কথা রয়েছে, যাতে দুই দেশের দুই দিনের আলোচ্য বিষয়গুলোসহ স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়গুলো অন্তর্ভুক্ত থাকবে বলে জানা গেছে।