মনের ভাব প্রকাশের সবচেয়ে কার্যকর মাধ্যম হচ্ছে কণ্ঠ। আর মানুষে মানুষে যোগাযোগের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম মুখের ভাষা। এই গলার স্বর বা কণ্ঠ অবশ্যই সৃষ্টিকর্তার অনন্য এক উপহার, যা এক শিল্পও বটে। আমাদের গলার সামনের দিকে স্বরযন্ত্র/বাগযন্ত্র অবস্থিত, যা দেখা যায় না মোটেও কিন্তু এর অস্তিত্ব ছাড়া জীবন অসম্পূর্ণ। শব্দযন্ত্রে দুটি কণ্ঠনালি (ভোকাল কর্ড) থাকে। নালি দুটির কম্পনের মাধ্যমে শব্দ তৈরি হয়।
আজ বিশ্ব কণ্ঠ দিবস। আমরা অনেকেই কণ্ঠস্বর সম্পর্কে তেমন সচেতন নই। বিশ্ব কণ্ঠ দিবসের উদ্দেশ্য হচ্ছে, কণ্ঠ ও কণ্ঠনালির সমস্যা এবং সেই সঙ্গে কীভাবে কণ্ঠকে সুস্থ রাখা যায়, তা জনগণকে জানানো। ২০০৮ সাল থেকে প্রতিবছর ১৬ এপ্রিল বাংলাদেশে ‘বিশ্ব কণ্ঠ দিবস’ পালিত হয়। সারা বিশ্বে দিবসটি পালিত হচ্ছে ২০০২ সাল থেকে।
এ বছর বিশ্ব কণ্ঠ দিবসের প্রতিপাদ্যÑ‘লিফট ইয়োর ভয়েস’ অর্থাৎ আপনার কণ্ঠস্বর উন্নত করুন। আমেরিকান একাডেমি অব অটোলারিঙ্গোলজিÑহেড অ্যান্ড নেক সার্জারির প্রস্তাবিত প্রতিপাদ্যটি আমাদের যথাযথ ও গুণগত কণ্ঠস্বর ফিরিয়ে আনার কথা বলে, যাতে আমরা নিজেকে সঠিকভাবে উপস্থাপন করতে পারি এবং আমাদের যোগাযোগের দক্ষতা উন্নত হয়।
মানুষের ব্যক্তিত্ব অনেকটাই নির্ভর করে তার কণ্ঠের ওপর। তাই সুস্থ থাকার জন্য শরীরের অন্য অঙ্গ–প্রত্যঙ্গের মতো প্রতিদিন কণ্ঠস্বরেরও যত্ন প্রয়োজন। এ জন্য দরকার কণ্ঠের পরিমিত এবং নিয়ন্ত্রিত সদ্ব্যবহার। জেনে নিন, কণ্ঠের অপব্যবহার থেকে সচেতন হয়ে কণ্ঠস্বরের যত্নেœসাত করণীয়—
১.
অযথা চিৎকার-চেঁচামেচি থেকে বিরত থাকতে হবে। উচ্চস্বরে বা অনেক জোরে কথা বললে ভোকাল কর্ডে মাইক্রোহ্যামারেজ নামক সমস্যা হয়। এতে হেমাটোমা, ফ্রাইব্রোসিস হয়ে অনেক সময় কণ্ঠের পরিবর্তন হয়ে যায়। শ্রেণিকক্ষে শিক্ষকেরা, জনসভায় রাজনৈতিক নেতারা, শিশুদের সঙ্গে মায়েরা, বাজারে ফেরিওয়ালা ও হকারসহ বিভিন্ন কণ্ঠনিভর্র পেশাজীবীরা অনেক সময় চিৎকার করে কথা বলে মনের অজান্তে নিজের কণ্ঠের ক্ষতি করে থাকেন। কণ্ঠের যত্নে জনবহুল জায়গা বা শোরগোলের স্থানে মাইক বা সাউন্ড সিস্টেম ব্যবহার করা উচিত।
২.
ধূমপান থেকে বিরত থাকতে হবে। ধূমপান সরাসরি আক্রমণ করে গলার যেকোনো সমস্যাকে আরও বাড়িয়ে দেয় এবং জটিল করে তোলে। ফলে ক্ষতি হয় কণ্ঠনালির। গবেষণায় দেখা যায়, শতকরা ৮০-৮৫ ভাগ কণ্ঠনালির ক্যানসারের রোগী ধূমপায়ী।
৩.
অত্যধিক ঠান্ডা পানি পরিহার করুন। অনেক সময় প্রচণ্ড গরমের মধ্যে বাইরে থেকে এসেই আমরা ফ্রিজের ঠান্ডা পানি পান করি, যা গলার জন্য ক্ষতিকর। যাঁদের ঠান্ডা ও অ্যালার্জিজনিত সমস্যা আছে, তাঁদের বিশেষ সতর্কতা মেনে চলা উচিত। এ ছাড়া ঘাম অনেকক্ষণ ধরে শরীরে থাকলে ঠান্ডা লেগে যেতে পারে। এর ফলেও গলা ভেঙে যায়। ঠান্ডা লেগে যদি গলা বসে যায়, তবে কথা বলা বন্ধ করতে হবে বা কমিয়ে দিতে হবে। কণ্ঠনালিকে বিশ্রাম দিতে হবে। এমনকি ফিসফিস করেও কথা বলা যাবে না। গলা ভাঙা উপশমে এ ক্ষেত্রে ভালো পদ্ধতি হলো গরম বাষ্প টানা। ফুটন্ত পানির বাষ্প যদি দৈনিক অন্তত ১০ মিনিট মুখ ও গলা দিয়ে টানা যায়, তাহলে উপকার হবে। মেনথল ইনহেলেশনও ভোকাল কর্ডকে কিছুটা আর্দ্রতা দিয়ে থাকে।
৪.
পানি পানে অনীহা নয়। পানিশূন্যতা গলা ভাঙার আরেকটি রিস্ক ফ্যাক্টর। অনেকেই পর্যাপ্ত পরিমাণ পানি পান করেন না। কণ্ঠের সুস্থতার জন্য প্রতিদিন অন্তত দুই লিটার পানি পান করতে হবে। কফি, চা, কোমল পানীয় শরীরের কোষে পানিশূন্যতা ঘটায়; তাই এসব অল্প পরিমাণ পান করতে হবে।
৫.
খাদ্যাভাস ও দৈনন্দিন জীবনযাপনে দিতে হবে বিশেষ নজর। আমাদের দেশের মানুষের একটি অভ্যাস হলো, আমরা অনেক দেরি করে রাতে খাই এবং খেয়েই শুয়ে পড়ি। এ চর্চাও কণ্ঠনালির জন্য ভালো নয়। হাইপার অ্যাসিডিটি আছে, এমন (ল্যারিঙ্গো ফ্যারিঞ্জাল রিফ্লাক্স ডিজিজ) রোগীদের গলার আশপাশে প্রদাহজনিত কারণে কণ্ঠনালি ফুলে যায়। তাদের ক্ষেত্রে রাতের খাবারের অন্তত দুই ঘণ্টা পর শুতে যাওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়। ঘুমানোর সময় মাথা যেন শরীরের তুলনায় একটু ওপরের দিকে থাকে, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। ঝালজাতীয় খাবার বর্জন করতে হবে। ঝাল থেকে বেড়ে যায় পাকস্থলির অ্যাসিড। অ্যাসিডিটির জন্যও গলা ভেঙে যেতে পারে।
৬.
কণ্ঠনালিরও বিশ্রাম দরকার। আমরা অনেক সময় প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে বিরতি ছাড়া কথা বলে যাই; চিন্তা করি না যে স্বরযন্ত্রও একটি যন্ত্র। কণ্ঠেরও দরকার রেওয়াজ বা ব্যায়াম। এ ছাড়া শারীরিক ক্লান্তিও কণ্ঠস্বরের ওপর মন্দ প্রভাব বিস্তার করে থাকে।
৭.
গলা ভাঙাকে অবহেলা করবেন না। দীর্ঘস্থায়ী স্বরভঙ্গের যে কারণ নিয়ে আমরা সবচেয়ে বেশি ভয় পাই, সেটি হলো কণ্ঠনালির ক্যানসার। এটি আমাদের দেশে ক্রমেই বাড়ছে। তাই কারও যদি স্বরভঙ্গ তিন সপ্তাহের বেশি থাকে, তাহলে অবশ্যই নাক-কান-গলারোগ বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিতে হবে। চিকিৎসকেরা বিভিন্ন পদ্ধতিতে ভোকাল কর্ড বা কণ্ঠনালি পর্যবেক্ষণ করে থাকেন। পদ্ধতিগুলো হলো ইনডাইরেক্ট ল্যারিঙ্গোস্কপি/ভিডিও ল্যারিঙ্গোস্কপি। কণ্ঠস্বরের পরিবর্তনে ব্যক্তির রোগের ইতিহাস, প্রয়োজনীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে প্রাথমিক পর্যায়ে গলা ভাঙার কারণ নির্ণয় করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
জীবিকা অর্জনের জন্যও আইনজীবী, শিক্ষক, ধর্মগুরু, উপস্থাপক, অভিনয়, বাচিক ও কণ্ঠশিল্পীদের সুন্দর কণ্ঠ প্রয়োজন। তাই স্বাভাবিক সুন্দর দিনযাপন এমনকি জীবিকা অর্জনের জন্যও সুস্থ ও সুন্দর কণ্ঠের বিকল্প নেই। একটু সচেতনতাই আমাদের কণ্ঠের সমূহ ক্ষতি থেকে রক্ষা করতে পারে।
লেখক: ডা. মো. আবদুল হাফিজ শাফী, এফসিপিএস (ইএনটি), নাক-কান-গলারোগ বিশেষজ্ঞ এবং হেড-নেক সার্জন, রেজিস্ট্রার, নাক-কান-গলা বিভাগ, সিলেট এম এ জি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল।