একটি বিদেশি জুতা কোম্পানির বাংলাদেশি হয়ে ওঠার গল্প

জুতা বলতে প্রথম যে শব্দটি মনে আসে তার নাম বাটা। স্কুলের প্রথম জুতাই হোক বা ঈদের নতুন জুতা, বাটা থাকে পছন্দের তালিকায় ৬০ বছর ধরে শিশু থেকে শুরু করে সব বয়সীদের প্রথম পছন্দ বাটার জুতা। দেশের বেশির ভাগ মানুষ কোনো না কোনো বয়সে বাটার জুতা ব্যবহার করেছেন।  

বাটা ও বাংলাদেশ একই সূত্রে

বাংলাদেশে বাটা আসে ১৯৬০ সালে। বাংলাদেশ তখনো পূর্ব পাকিস্তান। বাংলার মানুষ সবেমাত্র ভাষার অধিকার আদায় করেছে। পশ্চিমের শাসকদের নিত্য বঞ্চনা, বৈষম্য পূর্ব ভূখণ্ডের মানুষের প্রতি। পণ্য উৎপাদন হয় পূর্বে, কারখানা হয় পশ্চিমে। আয় করে পূর্ব, সুবিধা ভোগ করে পশ্চিম। প্রতিদিন বড় হচ্ছে বঞ্চনার তালিকা, আর একটু একটু করে তৈরি হচ্ছে অসন্তোষ।
পাকিস্তানিরা বাংলাভাষীদের গুরুত্বের সঙ্গে না দেখলেও বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান বাটা এ ভূখণ্ডের সম্ভাবনা দেখতে পায়। ১৯৬২ সালে তারা একটি কারখানা তৈরি করে পূর্ব পাকিস্তানে। সেই কারখানাটাই হয়ে যায় বাংলাদেশের ইতিহাসের একটি অংশ।

একজন উইলিয়াম এ এস ওডারল্যান্ড

নাম উইলিয়াম এ এস ওডারল্যান্ড। হল্যান্ডে জন্ম নেওয়া অস্ট্রেলীয় নাগরিক ওডারল্যান্ড বাংলাদেশে এসেছিলেন বাটার নির্বাহী পরিচালক হিসেবে ১৯৭০ সালে। ওডারল্যান্ডের আরেক পরিচয় হচ্ছে তিনি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের যোদ্ধা। পশ্চিম পাকিস্তানের নিপীড়ন চোখ এড়ায় না এই দক্ষ যোদ্ধার। একাত্তরের ২৫ মার্চ রাতে যখন শুরু হয় পাকিস্তানি সৈন্যদের ধ্বংসযজ্ঞ, ওডারল্যান্ড তাঁর পক্ষ নির্ধারণ করে ফেলেন। তাঁর ভাষায়, একাত্তরের মার্চে যখন পাকিস্তানি সৈন্য আর ট্যাংক ঢাকার রাস্তায় নেমে এল, আমি যেন আমার যৌবনের ইউরোপে ফেরত গেলাম।

পরম বন্ধু

টঙ্গীতে অবস্থিত বাটা বাংলাদেশে কর্মরত শ্রমিক মো. আমিন উদ্দিন বলেন, আমাদের সহকর্মী ও বড় ভাইদের কাছে শুনেছি, এখানে যারা যুদ্ধের সময় ছিল, তাদের খাবার দিয়েছে, থাকতে দিয়েছে। যুদ্ধ কীভাবে করা লাগে। দেশ স্বাধীন কীভাবে করা লাগে, চিকিৎসা কীভাবে করা লাগে। সব বুদ্ধি–পরামর্শ দিয়েছে। বাটার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা হিসেবে ওডারল্যান্ডের যাতায়াত ছিল সর্বত্র। সেই সুযোগ নিয়ে মুক্তিযুদ্ধে ওডারল্যান্ড মুক্তিযোদ্ধাদের খাদ্য, তথ্য, অস্ত্র, ওষুধ সরবরাহ করেছেন। মুক্তিযোদ্ধাদের রণ কৌশল শিখিয়েছেন। তখন আমাদের বাটার টঙ্গীর কারখানাটা ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের গোপন ক্যাম্প। তিনি কর্মীদের যুদ্ধে যেতে উদ্বুদ্ধ করতেন।

বীর প্রতীক

শুধু তা–ই নয়, ওডারল্যান্ড নিজেও জীবন বিপন্ন করে অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করেছেন। তাঁর নেতৃত্বে টঙ্গী-ভৈরব রেললাইনের ব্রিজ, কালভার্ট ধ্বংস করে যোগাযোগব্যবস্থা বিপর্যস্ত করেন মুক্তিযোদ্ধারা। তাঁর পরিকল্পনায় ও পরিচালনায় ঢাকা ও এর পার্শ্ববর্তী এলাকাগুলোতে বহু অপারেশন সংঘটিত হয়। এভাবেই ওডারল্যান্ডের হাত ধরে বাটা মিশে যায় বাংলাদেশের অস্তিত্বের সঙ্গে।
বাংলাদেশ স্বাধীন হয়। বিদেশি এই বন্ধুর প্রতি কৃতজ্ঞতাস্বরূপ বাংলাদশ সরকার ওডারল্যান্ডকে ভূষিত করে বীর প্রতীক খেতাবে। ওডারল্যান্ডই একমাত্র বিদেশি, যিনি এই রাষ্ট্রীয় খেতাবে ভূষিত হয়েছেন।

পায়ে পায়ে বাটা

বাংলাদেশের বয়স ৫০ হচ্ছে। বাংলাদেশের সঙ্গেই একটু একটু করে বেড়ে উঠেছে বাটা। মানুষের পায়ে পায়ে পাড়ি দিয়েছে দেশের সব প্রান্ত। বাটা বাংলাদেশের মানবসম্পদ বিভাগের জেনারেল ম্যানেজার মালিক মেহেদি কবির বলেন, ‘২০২১ সালে বাংলাদেশের বয়স ৫০ বছর হচ্ছে। আমরা বাটা বাংলাদেশে ২০২১ সালে প্রায় ৬০ বছর ধরে ব্যবসা করছি। বাংলাদেশ যেমন গুটিগুটি পায়ে এগিয়ে যাচ্ছে। তেমনি বাটা বাংলাদেশেও মানুষের পায়ে পায়ে এগিয়ে যাচ্ছে। এত দিন ধরে আমার দেশের মানুষকে আরামদায়ক ও স্টাইলিস্ট জুতা জোগান দিচ্ছি। বাংলাদেশের মানুষও আমাদের ওপর আস্থা রেখেছে। তাদের আস্থা ও ভালোবাসার জন্য এখনো আমরা জুতার প্রধান ব্র্যান্ড। এত দিন ধরে আমরা বাংলাদেশের মানুষকে আরামদায়ক ও স্টাইলিশ জুতার জোগান দিচ্ছি। বাংলাদেশের মানুষও আমাদের ওপর আস্থা রেখেছে। তাদের আস্থা ও ভালোবাসায় আমরা এখনো দেশের প্রধান জুতার ব্র্যান্ড বলে জানান তিনি।’

দেশের টাকা থাকছে দেশেই

বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান হলেও বাটার অধিকাংশ পণ্য তৈরি হয় বাংলাদেশে। এখানে কাজ করেন বাংলাদেশের মানুষ। এভাবে দেশের অর্থের বড় অংশ দেশেই থেকে যায়।
মালিক মেহেদি কবির বলেন, ‘বাটায় আমরা মানে বাংলাদেশিরাই বেশি কাজ করে। বাংলাদেশে অনেক দিন কাজ করার ফলে বাটা বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান হলেও বাটা কিন্তু বাংলাদেশের অস্তিত্বের সঙ্গে মিশে গেছে। আমি গর্বের সঙ্গে বলছি, চার বছর ধরে লেদার এবং ফুটওয়্যার ইন্ডাস্ট্রিজে সর্বোচ্চ করদাতা বলে জানান বাটা বাংলাদেশের মানবসম্পদ বিভাগের জেনারেল ম্যানেজার মালিক মেহেদি কবির।’
বাংলাদেশে প্রায় ৬৪ একর জায়গা নিয়ে বাটার ২টি কারখানা, একটা ধামরাই আরেকটা টঙ্গীতে। এখানে কাজ করেন ৩ হাজার কর্মী। শুধু দেশের অর্থনীতিতে অবদান রাখা নয়, বাটা বাংলাদেশের মানুষের জীবনে এক অবিচ্ছেদ্য অংশ ও পরম আস্থার নাম।
বাংলাদেশের ৫০ বছর হচ্ছে। গত ৫০ বছরে বাংলাদেশ পার করেছে নানা প্রতিবন্ধকতা। এর মধ্যে সম্প্রতি বিশ্বজুড়ে এসেছে করোনা। জীবনের এই দুর্যোগে দেশের সঙ্গে একই তালে লড়ে যাচ্ছে বাটাও।