কৃষকের আখের দাম ১ টাকা বাড়লেও চিনির দাম বেড়েছে ২৬ টাকা

টাঙ্গাইলে সদর উপজেলায় আখের খেত
ফাইল ছবি: প্রথম আলো

আগামী মাড়াই মৌসুমের জন্য আখের দাম কেজিপ্রতি ১ টাকা করে বাড়িয়েছে সরকার। তাতে চিনি কলগুলোর কাছে মণপ্রতি ২২০ টাকা দরে আখ বিক্রি করতে পারবেন কৃষকেরা। তবে এই দাম বাড়া পর্যাপ্ত নয় বলে দাবি করেছেন অনেক কৃষক।

অন্যদিকে এক বছরের মধ্যে আখের দাম কেজিপ্রতি ১ টাকা বাড়ানো হলেও এই সময়ে সরকারি চিনিকলগুলোতে উৎপাদিত চিনির দাম বাড়ানো হয়েছে প্রায় ২৬ টাকা। আখচাষিরা বলছেন, তাঁরা আখের উৎপাদন খরচের তুলনায় কম দাম পাচ্ছেন।

চলতি বছরের নভেম্বর মাস থেকে সরকারি চিনি কলগুলোতে পরবর্তী আখমাড়াই মৌসুম শুরু হবে। তার আগে গত বৃহস্পতিবার আগামী দুই মৌসুমের জন্য আখের দাম বাড়িয়ে একটি প্রজ্ঞাপন জারি করেছে শিল্প মন্ত্রণালয়।

প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্য শিল্প করপোরেশনের (বিএসএফআইসি) নিয়ন্ত্রণাধীন চিনিকল এলাকায় আখের মূল্য পুনর্নির্ধারণ বিষয়ে গঠিত স্থায়ী কমিটির সিদ্ধান্ত অনুসারে আখের মূল্য পুনর্নির্ধারণ করা হয়েছে।

বিদায়ী ২০২২-২৩ মৌসুম পর্যন্ত চিনিকলের মিলগেটে প্রতি কুইন্টাল (১ কুইন্টাল = ১০০ কেজি) আখের দাম ৪৫০ টাকা রাখা হয়। আর বহিঃ কেন্দ্রে প্রতি কুইন্টাল আখ বিক্রি করে কৃষকেরা পান ৪৪০ টাকা করে। তাতে প্রতি মণ আখের দাম মিলগেটে ১৮০ টাকা ও বহিঃ কেন্দ্রে ১৭৬ টাকা হয়।

শিল্প মন্ত্রণালয় প্রজ্ঞাপনে জানিয়েছে, আগামী ২০২৩-২৪ মাড়াই মৌসুমের জন্য আখের দাম কুইন্টালপ্রতি ১০০ টাকা বাড়ানো হয়েছে। তাতে প্রতি কেজি আখের দাম বেড়েছে ১ টাকা করে। ফলে আগামী মাড়াই মৌসুমে কৃষকেরা মিলগেটে প্রতি মণ আখ ২২০ টাকা ও বহিঃ কেন্দ্রে প্রতি মণ আখ ২১৬ টাকা দরে বিক্রি করতে পারবেন।

অন্যদিকে এর পরের মৌসুম, অর্থাৎ ২০২৪-২৫ মাড়াই মৌসুমের জন্যও আখের আগাম দাম ঘোষণা করেছে শিল্প মন্ত্রণালয়। তাতে মিলগেটে প্রতি মণ আখের দাম ২২০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ২৪০ টাকা করার কথা জানানো হয়েছে।

শিল্প মন্ত্রণালয়ের সরকারি নথিতে আখের দামের হিসাব কুইন্টালে করা হয়। তবে কৃষকেরা সাধারণত মন হিসাবে আখের দাম হিসাব করেন। এ ক্ষেত্রে কৃষকেরা ৪০ কেজিতে এক মণ হিসাব করেন।

আখচাষিরা যা বলছেন
সরকার আখের দাম বাড়ানোর ঘোষণা দিলেও আখচাষিরা বলছেন, এই দাম বৃদ্ধি পর্যাপ্ত নয়। প্রথম আলোর এই প্রতিনিধি ঠাকুরগাঁও, নাটোর ও পঞ্চগড়ের বেশ কয়েকজন আখচাষির সঙ্গে কথা বলেন। তাঁরা জানান, সরকার নির্ধারিত নতুন দামে প্রতি কেজি আখের দাম পড়ে সাড়ে পাঁচ টাকা। কিন্তু বর্তমানে তাঁদের আখ উৎপাদন খরচ হয় প্রায় সাড়ে সাত টাকা। ফলে সরকার নির্ধারিত দামে তাঁদের লোকসানে পড়তে হচ্ছে।

ঠাকুরগাঁওয়ের আখচাষি শেখ সালেকুল হক বলেন, ‘আখ চাষের জন্য অনেক যত্নের প্রয়োজন। বর্তমানে সার, কীটনাশক ও শ্রমিকের খরচ—সবই বেড়েছে। এ কারণে আখের দাম মণপ্রতি ৩০০ টাকার বেশি হওয়া প্রয়োজন। তা না হলে আমরা লোকসানে পড়ব।’

তবে বিপরীত মতও পাওয়া গেছে। যেমন জয়পুরহাট চিনিকলের আখচাষি কল্যাণ সমিতির সাধারণ সম্পাদক খাজা নাজিম উদ্দিন বলেন, ‘আখের দাম যতটুকু বাড়ানো হয়েছে, তা বর্তমান পরিস্থিতিতে ঠিক আছে। কৃষকেরা যদি ভালোমতো আখের আবাদ করতে পারেন, তাহলে এই দামে তাঁদের লোকসান হবে না।’

আখের বৃদ্ধি ১ টাকা, চিনির বৃদ্ধি ২৬ টাকা
আখের সংগ্রহ বাড়াতে সর্বশেষ ২০২২-২৩ মাড়াই মৌসুমে প্রতি মণ আখের দাম ৪০ টাকা বাড়িয়ে ১৮০ টাকা বা কুইন্টালপ্রতি ৪৫০ টাকা করেছিল বিএসএফআইসি। আগামী মৌসুমের জন্য তা আরও ৪০ টাকা বাড়িয়ে মণপ্রতি ২২০ টাকা করা হয়েছে। এতে প্রতি কেজি আখের দাম বেড়েছে ১ টাকা করে।

অন্যদিকে ২০২১-২২ অর্থবছরে মিলগেট থেকে ৭৪ টাকা কেজি দরে চিনি বিক্রি করেছিল চিনিকলগুলো। চলতি অর্থবছরে মিলগেটে চিনি বিক্রি হয়েছে ১০০ টাকা কেজি দরে। অর্থাৎ, এক বছরে মিলগেটে চিনির দাম বেড়েছে ২৬ টাকা।

কৃষকেরা তাঁদের উৎপাদিত আখের ন্যায্য দাম পাচ্ছেন না বলে দাবি করেছেন বাংলাদেশ আখচাষি ইউনিয়নের জাতীয় কমিটির সভাপতি আনসার আলী। তিনি বলেন, এক মণ (৪০ কেজি) আখ থেকে প্রায় সাড়ে তিন কেজি চিনি, ১৪ কেজি ছোবড়া, ৬ কেজি চিটা গুড় ও ২ কেজি প্রেসমাড উৎপাদিত হয়। এসব পণ্য বিক্রি করে ৬৫০ থেকে ৭০০ টাকা আয় করে চিনিকলগুলো। অথচ কৃষকেরা অনেক কম দাম পান।

আনসার আলী বলেন, কৃষকেরা আখের নতুন দাম গ্রহণ করেননি। আগামী মৌসুমের জন্য আখের দাম মণপ্রতি অন্তত ৩০০ টাকা করা প্রয়োজন। তা না হলে কৃষকেরা আখ চাষ আরও কমিয়ে দেবেন।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্য শিল্প করপোরেশনের (বিএসএফআইসি) চেয়ারম্যান মো. আরিফুর রহমান বলেন, আখচাষিদের সঙ্গে কথা বলে তাঁদের চাহিদা অনুসারেই আখের দাম বৃদ্ধি করা হয়েছে।

অন্যদিকে চিনির দাম বাড়ানোর সঙ্গে আখের দাম বাড়ানোকে সরাসরি মিলিয়ে দেখার সুযোগ নেই বলে মনে করেন বিএসএফআইসি চেয়ারম্যান আরিফুর রহমান। তিনি বলেন, বরং চিনির দাম বেড়েছে বলেই আখের দাম বাড়ানো সম্ভব হয়েছে। আখ চাষ বৃদ্ধি পেলে এবং চিনির উৎপাদন হার বৃদ্ধি পেলে আখের দাম আরও বাড়ানো সম্ভব হবে বলে জানান তিনি।